বিশ্বব্যাংকের সেই প্রতিবেদন

জুলাই মাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি দলের সরেজমিনে পূর্ব পাকিস্তান সফর ও তাদের প্রতিবেদন। ৩০ মে থেকে জুন ১১ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক মিশনের পূর্ব পাকিস্তান ভ্রমণের প্রতিবেদনটি নিউইয়র্ক টাইমস ১৩ জুলাই তাদের পত্রিকায় ছাপে।

বিশ্বব্যাংকের সেই প্রতিবেদনটির ওপর ভিত্তি করে নিউইয়র্ক টাইমস–এর বৈদেশিক সংবাদদাতা টেড জুলক আরেকটি প্রতিবেদন তৈরি করেন যার শিরোনাম ছিল, ‘বিশ্ব ব্যাংক ইউনিট বলছে পাকিস্তানে সাহায্য এখন অর্থহীন’ [World Bank unit says Pakistan aid is pointless now]

সংক্ষেপে প্রতিবেদনটি এ রকম—
পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি পূর্ব পাকিস্তানে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক কোন উন্নয়ন প্রচেষ্টা ‘কমপক্ষে আগামী বছর পর্যন্ত স্থগিত রাখাতে হবে’। সেখানে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাঙলার স্বাধীনতাকামীদের দমাতে তীব্র দমননীতি অবলম্বন করছে। রিপোর্টটিতে বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ধান উৎপাদন না হওয়ার কারণে তীব্র অনাহার এড়াতে ব্যাপক খাদ্য সহায়তার কথা বলা হয়েছে।

বেসামরিক প্রশাসনের তাগিদ
বিশ্বব্যাংক ব্যাপকভাবে সামরিক উপস্থিতি হ্রাস এবং বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতি জোর দিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীরা ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোন রকম রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। ওই মিশন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার অনুমোদন ক্রমে এই মত দিয়েছেন। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিরা মনে করেন, পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করবে, সেখানকার অর্থনীতিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ব্রিটেন ও কানাডার একই মত থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে অর্থ সাহায্যের পক্ষে।
১০ হাজার শব্দের বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদন অনুসারে গত ২১ জুন পাকিস্তানে সহায়তা দানকারী ১১ রাষ্ট্রের কনসোর্টিয়ামও তাদের সাহায্য বন্ধ রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। আমেরিকা তাদের সঙ্গে একমত হয়নি।

কোনো উন্নতি দেখা যায়নি
বিশ্বব্যাংকের সাউথ এশিয়ান ডিপার্টমেন্টের প্রধান মত দেন যে—‘স্বাভাবিক অবস্থা আসার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত। মানুষ একটা ভীতির মধ্যে বাস করছে, ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম একেবারে স্থবির।’ তিনি আরও মত দেন, ‘সামরিক বাহিনীর প্রতিশোধমূলক বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অব্যাহত আছে। বিদ্রোহীদের কার্যক্রমও অব্যাহত আছে এবং এর ফলে সেনাবাহিনী প্রতিশোধ নিচ্ছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২৫ মার্চের পর থেকে কমপক্ষে ২ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে যাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। প্রায় ২৫ লাখ মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলে এক সদস্য অর্থনীতিবিদ বেন ডার হেডেন তার প্রতিবেদনে কুষ্টিয়া শহরকে তুলনা করেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কোন জার্মান শহর যা বোমায় সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।’ হেডেন আরও বর্ণনা করেন, ‘কুষ্টিয়ার ৯০ ভাগ বাড়ি, দোকান, ব্যাংক ও অন্যান্য দালান–কোঠা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এবং সেখানকার জনসংখ্যা ৪০ হাজার থেকে ৫ হাজারে নেমে এসেছে। এটি হলো পাকিস্তানি বাহিনীর ‘মাইলাই’।
গত সপ্তাহে আমেরিকার নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষ সহকারী হেনরি কিসিঞ্জারের ভারত ও পাকিস্তান সফরের ফলে ২৫ মার্চের আগে পাকিস্তানের সঙ্গে করা সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের চুক্তিতে কোন প্রভাব পড়বে কিনা মার্কিন কর্মকর্তারা সে বিষয়ে মতামত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। নিক্সন প্রশাসন বিশ্বাস করে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য স্থগিত করা উচিত নয়। তাঁর প্রশাসন চলতি বছরে পাকিস্তানকে ১১৮.৩ মিলিয়ন ডলার সাহায্য অনুমোদন চেয়ে কংগ্রেসের কাছে প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে।
একই দিন বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতাংশ দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস আরেকটি প্রতিবেদন ছাপায় যার শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ওপর বিশ্বব্যাংক দলের প্রতিবেদনে উদ্ধৃতাংশ’ [Expcerpts from World Bank group’s report on East Pakistan]
এই প্রতিবেদন থেকেই নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলের সফরের আরও বিস্তারিত বর্ণনা এখানে স্থান পেয়েছে। বিশেষ করে প্রতিনিধি দল নিজ চেখে যশোর, খুলনা, মোংলা, ফুলতলা ও কুষ্টিয়াতে যা দেখেছে সংক্ষেপে তার কিছু বিবরণ—
যশোর: আকাশে বিমান থেকেই বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিরা যশোরের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন এবং প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন— যশোরের দিকে এগিয়ে যেতেই সেটা পরিষ্কার হলো সেনারা এখানে তীব্রভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। আকাশ থেকেই আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রামগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম, একটি দালানে তখনো আগুন জ্বলছিল।
খুলনা: খুলনায় রাস্তা ও নদীর ধারে, জুবলি জুট মিল ও নিউজপ্রিন্ট কারখানার আশপাশে ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ দৃশ্যমান।
মোংলা: এখানে চালনা নদী বন্দরের শ্রমিকেরা বাস করে। নৌবাহিনীর গোলাবর্ষণ সব বাড়িঘর ধ্বংস করেছে।
ফুলতলা: মনে হয় এর অবস্থা আমার দেখা অন্যান্য এলাকার চেয়ে ভালো। মাত্র ৫০ ভাগ বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে।
কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ার ৯০ ভাগ বাড়ি, দোকান, ব্যাংক এবং অন্যান্য দালানকোঠা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এবং সেখানকার জনসংখ্যা ৪০ হাজার থেকে ৫ হাজারে নেমে এসেছে। এটি হলো পাকিস্তানি বাহিনীর ‘মাইলাই’।
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন ও আমেরিকার পাকিস্তানের পক্ষে আচরণে কঠোর সমালোচনা করে নিউইয়র্ক টাইমস আরেকটি সম্পাদকীয় লেখে যা ছাপা হয় ১৪ জুলাইয়ের পত্রিকায়। সম্পাদকীয়টির শিরোনাম ছিল, ‘পাকিস্তান নিন্দিত’ [Pakistan condemned]

সংক্ষেপে সম্পাদকীয়টি ছিল
গত মাসে পূর্ব পাকিস্তান সফর শেষে বিশ্বব্যাংক মিশনের প্রতিবেদনটি বাংলায় পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের পর বিধ্বংসী অবস্থার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র। এই প্রতিবেদনটি ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খানের সরকারকে কোন সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যে দেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করে। প্রতিবেদনটির উদ্ধৃতাংশে এই অঞ্চলে ব্যাপক হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। একজন সদস্য কুষ্টিয়া শহরকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমায় বিধ্বস্ত কোন জার্মান শহরের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারা দেখেছেন ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ হিসেবে কীভাবে বাড়িঘর ধ্বংস করা হয়েছে, মানুষ হত্যা করা হয়েছে।
কর্মকর্তাদের পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অবগত হওয়ার পরও পাকিস্তানে আমেরিকার সামরিক সরবরাহ পাঠান অমার্জনীয় অপরাধ। ইতিমধ্যে যে সামরিক চালান পাকিস্তানের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছ, তা ফিরিয়ে আনা উচিত যেমনভাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর খাদ্যশস্যের চালান চট্টগ্রাম থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। পাকিস্তানে আরও সামরিক এবং আর্থিক সাহায্য স্থগিতের পরিষ্কার কারণ বর্তমান। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না পর্যন্ত শুধু ত্রাণ সাহায্য দেওয়া যেতে পারে। অনেক মানুষ বর্তমানে হয় অন্তরীণ অথবা পলাতক আছেন।
গত মাসে প্যারিসে পাকিস্তানকে সাহায্যকারী এগারো জাতির কনসোর্টিয়ামের দশ জাতি বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে কাজ করলেও আমেরিকা তা মানতে অস্বীকার করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তানকে আমেরিকার সাহায্য ধারণাতীত এবং নিন্দনীয়।
(চলবে)

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]