মার্কেটিংয়ের জয়জয়কার

নিউইয়র্ক শহরে আসার পরে বাংলাদেশি কমিউনিটির কোন পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে আমার ফুলটাইম কাজ করা হয়নি। কারণ কি জানেন? এখানে সাংবাদিকদের চেয়ে মার্কেটিংয়ের লোকের কদর বেশি। নিউইয়র্কের মিডিয়াকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। বাংলাদেশি কমিউনিটি-নির্ভর ছোট মার্কেট তাদের ভরসা, যেখানে সবাই সবাইকে চেনে। অনেকটা মফস্বল শহরের পত্রিকার মতো। কিন্তু বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ের টিভি চ্যানেলগুলোতে কেন এমন দশা হবে! এক টিভি চ্যানেলের প্রেজেন্টারের সরু হাতার ব্লাউজ নিয়ে ছি ছি এখন চারদিকে। জানা গেছে, সেই প্রেজেন্টার সংশ্লিষ্ট চ্যানেলে মার্কেটিংয়ে কাজ করেন। পুঁজিবাদী সমাজটাই তো দাঁড়িয়ে মার্কেটিংয়ের ওপর। আর সেখানে নারী এক ধরনের পণ্যই বটে। তবে আর ওই মেয়ের দোষ দিয়ে লাভ কি? বরং ভাবুন চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিদের কথা! যারা নিজেদের বিপণনের সুবিধার জন্য অধীনস্থদের এমন পোশাক পরতে উৎসাহিত করে।
মেয়েটি খারাপ। মিডিয়াতে এমন কথা প্রায় শোনা যায়। কেন সে খারাপ? কারণ সে ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে নানা পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে। খোলামেলা পোশাক পরেছে। উগ্র সাজগোজ করেছে। তবু তো মেয়েটার একটা যুক্তি আছে খারাপ হওয়ার। কারণ সে ওপরে ওঠার ইচ্ছা থেকে কাজটা করেছে। কিন্তু যে পুরুষ তাকে ব্যবহার করেছে, তার তো কোনো যুক্তি নেই। সে শুধু ওই মেয়েটার সঙ্গ উপভোগ করেছে। হয়তো বাড়িতে তার স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও সে এই কাজটা করেছে।
দোষ তাহলে কার বেশি? সরু হাতার ব্লাউজ পরেছে বলে ‘জাত গেল’ ‘জাত গেল’ বলে যারা রব তুলছেন, তারা কেন বলছেন না ওই টেলিভিশনে কোন ড্রেস কোড নেই? যে কেউ যা খুশি পরে ক্যামেরার সামনে চলে আসে কীভাবে! আর সংবাদ পাঠিকা নির্বাচিত হয়েছেন কিসের ভিত্তিতে? মেধা নাকি সৌন্দর্য নাকি মার্কেটিংয়ের ক্ষমতায়? করপোরেট দুনিয়ার এটাই হল প্রকৃত চিত্র। মেধা বা পরিশ্রমের মূল্য এখানে শূন্য। আপনি ভালো লেখেন, আপনি চমৎকার সব রিপোর্ট করেন, ভালো ছবি তোলেন, খুব পরিশ্রমী-ত্যাগী-বিনয়ী-সময়নিষ্ঠ, অনেক জানেন-বোঝেন-চিন্তা করেন, কিন্তু সবকিছুর মূল্য আসলে শূন্য। আপনি কতটা বিজ্ঞাপন আনতে পারেন কিংবা বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে, তার ওপরে অফিসে অবস্থান নির্ভর করে।
আইটেম গান না থাকলে আজকাল নাকি কোনো হিন্দি সিনেমা হিট করে না। সেই গানের আইটেম গার্ল হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা চলে নামকরা নায়িকাদের মধ্যে। কেন সুপারস্টার নায়িকারা আইটেম গানে থাকতে মরিয়া হয়ে উঠেন? কারণ তারা বোঝাতে চান, এখনো ফুরিয়ে যাননি তারা। আবার অনেক সময় তিন ঘণ্টা যে নায়িকা পর্দায় ছিল তার চেয়ে পাঁচ মিনিটের আইটেম গানের নৃত্যশিল্পী বেশি আলোচনায় থাকেন। দুনিয়াটা এখন দেখানোর যুগ। কে কত দেখাতে পারে, তার প্রতিযোগিতা। সৃজনশীলতা, সুকুমারবৃত্তি সেখানে গৌণ। মুখ্য হল উগ্রতা, স্থূলতা আর অর্থ।
স্কুলজীবনে পড়া ‘অর্থই অনর্থের মূল’—ভাব বাচ্যের এখন জাদুঘরে যাওয়ার সময় হয়েছে। অর্থই এখন দুনিয়ার সবকিছু। যে কারণে মার্কেটিংয়ের মানুষদের মাথায় তুলে রাখা হয় সর্বত্র। তাদের গলার জোর বেশি। চেহারার জেল্লা বেশি। অন্যদিকে বলা যায়, চেহারায় জেল্লা আছে এমন নারী-পুরুষকে বেছে মার্কেটিংয়ের কাজে দেওয়া হয়। বিজয় টিভির সেই সংবাদ পাঠিকা সেভাবে পেয়েছেন। তদুপরি পোশাকে–আশাকে অত্যন্ত উদার তিনি। সরু হাতার ব্লাউজ বিষয়ক আলোচনায় তাঁর বরং একটা লাভ হয়েছে। যারা তাকে চিনত না, বিশেষ করে পুরুষেরা, তারা এখন ভালোভাবে চিনেছে। মার্কেটিংয়ের দুনিয়ায় তার দাম বেড়েছে।
যত দিন চেহারায় জেল্লা থাকবে, তত দিনেই সুদিন। তারপরে তো অবহেলা-উপেক্ষার দিন। কম বয়সী নারীদের প্রতি টেলিভিশন মিডিয়ার পক্ষপাত বরাবরের। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েদের দিয়ে তারা খবর পড়ায়। কেউ মাস্টার্সের ছাত্রী হলে সে ডিসকোয়ালিফাইড, বয়স বেশি হয়ে গেছে। যেন শুধু মেয়েদের বয়স বাড়ে। কর্তাব্যক্তির চেয়ারে বসে থাকা পুরুষদের বয়স যেন বাড়ে না। আসলে তারা নিজেদের চেহারা আয়নায় দেখতে চায় না। তারা ভয় পায়। সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায়।
আমরা বড় হয়েছি বিটিভি দেখে। সেখানে সব বয়সী নারীরা খবর পড়তেন। অনুষ্ঠান ঘোষক আর খবর পাঠকের মধ্যে সাজগোজের তখন একটা বড় পার্থক্য ছিল। যেটা আমরা ছোটবেলায় অপরিণত বয়সেই বুঝে নিয়েছিলাম। বিটিভির নিজস্ব সরকারি বিজ্ঞাপন আছে। বেসরকারি চ্যানেলগুলোর সেটি নেই। যেকোনো উপায়ে তাদের টিকে থাকতে হবে। সরু হাতার ব্লাউজ টিকে থাকার লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত। মেয়ের দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই! যারা তাকে নিয়োগ দিল, সেই কর্তাব্যক্তিদের ধরবে কে!