১৫ আগস্ট আর নাশতা হল না

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ভর্তি হই চট্টগ্রাম সরকারি বাণিজ্য কলেজের প্রথম বর্ষে। ভর্তি শেষে ছাত্রাবাসে সিট নেওয়া ও বাকি আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি নিতে নিতে গ্রীষ্মের ছুটিতে মার্চ মাস শেষে কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। মাসখানিক সুনামগঞ্জে ছুটি কাটিয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কলেজে ফেরত আসি। আজ থেকে প্রায় ৪৪ বছর আগে সুনামগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম আসতে পুরো দুদিন লেগে যেতো। চট্টগ্রাম যেতে আগেভাগে হ্রাসকৃত মূল্যে প্রথম শ্রেণির টিকিট (স্লিপিং বার্থসহ)সংগ্রহ করতে হতো সিলেট রেলস্টেশন থেকে। ছুটির শেষে কলেজে ফিরে আসছি দ্বিতীয়বারের মতো। আসার সময় প্রথম হাতঘড়ি উপহার পেলাম আব্বার কাছ থেকে। Tresss ব্র্যান্ডের ঘড়ি। সুনামগঞ্জ বাজারে তখন একটিমাত্র দোকানে ভালো ব্র্যান্ডের ঘড়ি বিক্রি হত।
এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল বড্ড সেকেলে। ১৯৭৫ সালে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট পৌঁছতে ৫/৬ ঘণ্টা লেগে যেত। সিলেট এসে মামার বাসা, না–হয় চৌহাট্টায় বড় আপাদের বাসায় দুপুরের খাবার খেয়ে তৈরি হতাম চট্টগ্রামে যাত্রার উদ্দেশ্যে। চট্টগ্রামগামী জালালাবাদ এক্সপ্রেস সিলেট থেকে ছেড়ে যেতো সন্ধ্যা ৮টায়। অগ্রিম টিকিট কাটা থাকত বলে সিট দখলের টেনশন ছিল না। রেলস্টেশনে যেতে হতো কিন ব্রিজ দিয়ে। ব্রিজ পেরোতে সময় লাগত অনেক বেশি। প্রায় দুই ঘণ্টা পূর্বে রওনা দিতে হতো। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ব্রিজটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় তখন পুনর্নির্মাণের কাজ চলছিল। ব্রিজে শুধু ছোট ও হালকা যান চলাচলের অনুমতি ছিল। বড় যানবাহন নদী পার হতো বর্তমান উপশহরের পাশে ফেরি ঘাট দিয়ে। কিন ব্রিজে সব সময় ট্রাফিক জ্যাম লেগেই থাকত। রেলস্টেশন ছিল বর্তমান স্টেশনের আরও পশ্চিমে। ব্রিজ পার হয়ে বাম দিকের রাস্তা ছিল সরু ও ব্যস্ত। ঢাকাগামী বড় গাড়িগুলোতে যাত্রী ওঠানামার জন্য ওই পথে ভিড় লেগেই থাকত।
রিকশা নিয়ে বাক্সপেটরাসহ কিন ব্রিজের মুখে পৌঁছালে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা ধাক্কা শ্রমিকেরা রিকশা যাত্রীসহ ঠেলে ওপরে তুলে দিত। পারিশ্রমিক ছিল ১ টাকা। ব্রিজ পার হয়ে বামের রাস্তা ধরে ঐতিহাসিক লাল রঙের সিলেট রেলস্টেশন। এখানে এসে স্যুটকেস ওঠানো নিয়ে চলতো কুলিদের সঙ্গে বাদানুবাদ। সবকিছু সেরে চেপে বসা চট্টগ্রামগামী জালালাবাদ মেইল ট্রেনে। দেশে সব সময় রেলের সময়সূচি নিয়ে একটি প্রচলিত কৌতুক ছিল। নয়টার গাড়ি কয়টায় ছাড়ে? যাত্রার শুরুতে লেট ছিল তখনকার সময়ে নিত্যদিনের বিষয়। সব ঝক্কি–ঝামেলা সেরে জালালাবাদ মেইল ট্রেন চট্টগ্রাম গিয়ে পৌঁছতো পরদিন সকাল বেলা। রিকশা বা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে যেতে হতো কলেজ হোস্টেলে। একদিন পর কলেজ শুরু হবে।
যথারীতি ক্লাস শুরু হলো। সবই স্বাভাবিক। তবে কলেজে সব ধরনের রাজনৈতিক চর্চা ছিল অনেক সীমিত। কলেজে আমরা নতুন। তাই কলেজের সব কার্যক্রমে নতুন ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল অনুমতি সাপেক্ষে। জুন মাসে নির্ধারিত ছিল ষাণ্মাসিক পরীক্ষা। পরীক্ষার রুটিন দেওয়ার পর দাবি উঠল পরীক্ষা পেছানোর। অজুহাত, বন্ধ থাকায় প্রস্তুতি নেওয়া যায়নি। কলেজের অধ্যক্ষ মরহুম শাফায়েত আহমদ সিদ্দিকী। ভীষণ কড়া। নিয়মের ব্যাপারে খুবই সচেতন। স্যারের কাছে কোন ধরনের অজুহাত বা কোন রাজনৈতিক সুপারিশ কাজে আসেনি। সবাই ধরেই নিলেন পরীক্ষা দিতেই হবে। থাকতাম কলেজের লাগোয়া ছাত্রাবাসে। সুপার ছিলেন কমার্স কলেজের আরেক কিংবদন্তি অধ্যাপক প্রয়াত আবদুর রহীম চৌধুরী। গ্রামের বাড়ি ছিল কর্ণফুলীর অপর পারে আনোয়ারা থানার শিকলবাহা গ্রামে। স্যারের কড়া নিয়মের বেড়াজালে হোস্টেলের সব ছাত্রকে থাকতে হতো। তাই কেউ কেউ কলেজ হোস্টেলকে বলতেন রহিমিয়া এতিমখানা। আর কলেজকে তো সবাই জানত আরেক নামে, সেটি ছিল সিদ্দীকিয়া মাদ্রাসা।
এতসব কড়া নিয়ম মেনেও আমরা ছিলাম অনেক স্বাধীন। তবে রাতের চলাফেরা ছিল বেশ সীমিত। বাকি জীবনযাপনে স্বাধীনতা ছিল প্রচুর। সবকিছু ছিল হাতের নাগালে। জীবনযাপনের ব্যয় তখন এত বেশি ছিল না। সকালের নাশতাসহ সারা মাসের ফুড চার্জ ছিল মাত্র ১৬ টাকা। নাশতার মেন্যু ছিল আর্মি স্টাইলে। আটার তৈরি মাঝারি আকারের দুখানা রুটি। সঙ্গে সবজি, না হয় চানার ডাল। সুনামগঞ্জের বাসায় সকালে একেক দিন একের জাতের নানা মুখরোচক নাশতা তৈরি হতো। আর এখন প্রতিদিন সাদামাঠা একই নাশতা। তাই হঠাৎ এই পরিবর্তন মেনে নেওয়া কষ্টকর ছিল সে সময়ে। সে জন্যই মাঝে মাঝে বাইরে এসে সকালের নাশতা করতাম হোস্টেলের লাগোয়া ছোট বাজারে। বাজারের নাম মাদারবাডি রোড বাজার। দুটি লন্ড্রি, একটি লাকড়ির দোকানসহ ছোট্ট একটি মুদি দোকান। পাশে ছোট একটি রেস্টুরেন্ট। মালিকসহ তিনজন কর্মচারী। বাবা মালিক ও শেফ দুটোই আর দুই ছেলে সহকারী। খুবই মজার পরোটা অথবা পাতলা সেঁকা রুটি বানাতো। সঙ্গে ডিমের অমলেট নয়তো আলু ভাজি।
আগের রাতে রুমমেটদের নিয়ে গল্পে মেতে ছিলাম সারা রাত। সকালে সবাইকে নিয়ে চললাম নাশতা করতে। দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। আনুমানিক সকাল ৭টা। দোকানের সামনে যাওয়ার আগেই লন্ড্রির সামনে ছোট জটলা। সবাই দাঁড়িয়ে খবর শুনছে। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে জটলা করে কখনো খবর শুনতে দেখিনি। তাই মনে একটু খটকা লাগল। বিষয় কি? কোন অশুভ কিছু নয়তো? একটু কৌতূহল নিয়ে দু/চার পা এগিয়ে যেতেই কানে আসল অজানা–অচেনা একটি কণ্ঠ, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি। রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন।’—এই মর্মান্তিক ঘোষণা শোনার পরই পুরো শরীরে একটি ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এ কীভাবে সম্ভব? হিমালয় সমান জনসমর্থন নিয়ে যিনি একটি দেশ স্বাধীন করলেন। পৃথিবীর বুকে বাঙালি জাতির নিজস্ব পতাকা এনে দিলেন। নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেওয়ার সুযোগ হল যে মানুষটির জীবনের ত্যাগে, সেই মহাপুরুষ আজ নেই। শুধু আমরা নয়। আশপাশের কারও কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। অথবা বিশ্বাস করতে চাইছে না অনেকে।
পরক্ষণেই মনে হল সুনামগঞ্জে আব্বার কথা, যিনি পঞ্চাশের দশক হতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি তথা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত। মনে শঙ্কা এল। কিছুটা ভয় করতে লাগল। মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল নিমেষে। বাকি বন্ধুদের তাগাদা সত্ত্বেও আর এগোতে মন চায়নি। লন্ড্রির সামনে থেকে ধীর পায়ে নাশতা না খেয়েই ছাত্রাবাসে চলে আসি। আসার পথে ভাবছি, এ কেমন অকৃতজ্ঞ জাতি। সারা বিশ্বে এই অকৃতজ্ঞ জাতি মুখ দেখাবে কী করে। যে জাতি তার আপন পিতাকে রক্ষা করতে পারে না। সেই জাতি দেশ তথা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে কীভাবে? সেই সব অনেক প্রশ্নের উত্তর না জেনেই ছাত্রাবাসের নিজের রুমে ফিরে এলাম। পরক্ষণেই মনে পড়ল লন্ড্রির সামনে থাকা ক্ষুদ্র জমায়েতের মধ্যে এক মধ্য বয়সের লোকের আকুতি আর হাহাকার আর স্বগতোক্তি, ‘নেতা আপনি ভুল মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন। আপনি জনগণের নেতা। যদি জনতার মাঝে থাকতেন। জনতাই তার বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আপনাকে রক্ষা করত।’
অজানা সেই বঙ্গবন্ধু ভক্তের চোখে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখেছি, সেই অকুতোভয় সৈনিকরা কি এখনো বঙ্গবন্ধুর দলে আছে? আমরা হয়তো জানি না। সময় ও ইতিহাস কোনো দিন সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে হয়তো।