রাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়ছে ট্রাম্পের

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

আমেরিকার শেয়ারবাজার বেশ বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চীনে তৈরি সেলফোন ও খেলনা আমদানিতে শুল্কারোপের হুমকির পর আমেরিকার শেয়ারবাজারে বড় ধরনের পতন ঘটে। পরে এই শুল্কারোপ পিছিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে শেয়ারবাজার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও ১৪ আগস্ট আবার দরপতন হয়। ভালো নেই বিশ্ব অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোও। এতে নির্বাচনের আগের বছরে ট্রাম্প প্রশাসন ও তাঁর রাজনীতি দুইয়ের জন্যই বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

বিশ্বের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি চীন ও জার্মানি সম্প্রতি যে অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশ করেছে, তা রীতিমতো হতাশাজনক। চীন ও আমেরিকায় পণ্য রপ্তানির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল জার্মানির অর্থনীতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কিছুটা সংকুচিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতে বড় ধরনের মন্দার ইঙ্গিতবাহী। এই তথ্য যখন আসছে, তখন ভারত, নিউজিল্যান্ড ও থাইল্যান্ড সুদহার কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে সুদহার কমানোর আশঙ্কা আগে থেকে থাকলেও তিনটি দেশই ধারণার চেয়েও বেশি সুদহার কমিয়েছে।

সিএনএনের বিশ্লেষণে বলা হয়, আমেরিকায় এখনো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও শ্রমবাজার ভালো অবস্থানে থাকলেও ভোক্তা চাহিদাই মূলত এর চালিকাশক্তি। কিন্তু বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দাভাব তৈরি হলে এটি বেশি দিন অব্যাহত থাকবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অবস্থায় বাণিজ্য যুদ্ধের রাশ টেনে ধরতে ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্কারোপ পিছিয়ে দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন, তা ইতিবাচক হলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, পদক্ষেপটি অনেক দেরিতে নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আরও বড় পদক্ষেপ নিলেই একমাত্র পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব।
বিনিয়োগ ব্যাংক স্টিফেলের প্রধান অর্থনীতিবিদ লিন্ডসে পিগজা সিএনএনকে বলেন, ‘শুল্ক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির গতি স্পষ্টভাবেই কমে আসছে। এই পরিস্থিতির আগে থেকেই অর্থনীতির এ দুর্বলতা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু শুল্ক যুদ্ধ নতুন সংকট হাজির করে বিষয়টিকে চাপা দিয়েছে।’
এই অবস্থায় প্রথমবারের মতো ভোক্তাদের কথা বিবেচনা করে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ শুনল। পরবর্তী শুল্কারোপের সময় পিছিয়ে আগামী ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে মার্কিন অর্থনীতি সীমিত সময়ের জন্য হলেও একটু চাঙা হয়েছে। তবে তা স্থায়ী হয়নি। মাত্র এক দিনেই পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ১৪ আগস্ট বন্ড মার্কেটে সৃষ্ট সতর্কবার্তা অনুসরণ করে শেয়ারবাজারে পতন হয়েছে। যাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ ৮০০ পয়েন্ট কমেছে। ৩০ বছর মেয়াদি মার্কিন ট্রেজারি নোটের মূল্যমান রেকর্ড পরিমাণ কমে এ দিন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বন্ড ও শেয়ারবাজারের প্রবণতা বলছে খুব কাছেই একটি মন্দা অবস্থান করছে।
বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ট্রাম্প প্রশাসনকে। গত কয়েক দিন ধরে বাজারে চলমান অস্থিরতার জেরে স্বয়ং প্রেসিডেন্ট তাঁর কর্মকর্তাদের একটা রাস্তা খোঁজার জন্য বলেন। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচককে বিশেষত বন্ড ও শেয়ারবাজারের সূচকগুলোকে ইতিবাচক দিকে চালিত করার রাস্তা খুঁজতে। সিএনএন জানাচ্ছে, গত এক সপ্তাহ ধরে শেয়ারবাজারের সব খবরের দিকে নজর রাখছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাজার নিয়ে তাঁর মূল হতাশাটি ফেডারেল রিজার্ভ ও এর চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলকে ঘিরে। একই সঙ্গে তিনি এখন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ক চুক্তিতে উপনীত হতে নিযুক্ত দল নিয়েও হতাশ। তাঁর দৃষ্টিতে এ দুই ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কারণেই প্রশাসন এমন বেকায়দায় পড়েছে। তিনি মনে করেন, বাণিজ্য ক্ষেত্রে এই অচলাবস্থা তাঁর অর্থনীতি ও রাজনীতি দুইয়েরই ক্ষতি করবে, যা তাঁর পুনর্নির্বাচনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যদিও তিনি নিজের আগ্রাসী মনোভাবকে কোনো দোষ দিতে রাজি নন।
অথচ গত মাসেই প্রেসিডেন্টের কিছু উপদেষ্টা অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে বলে সতর্ক করেছিলেন। বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও এসেছিল অনুরূপ সতর্কবার্তা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তার কোনো কিছুকেই আমলে নেননি। বরং বাণিজ্য আলোচনা চলার সময়েই চীনের ওপর নতুন করে শুল্কারোপের ঘোষণা আসে। সে সময় তাঁর একটাই বক্তব্য ছিল, আমেরিকার অর্থনীতি অত্যন্ত স্থিতিশীল। অথচ মাত্র এক মাসের ব্যবধানে যখন অর্থনীতির সংকটগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, তখন তিনি সব আঙুল তাক করছেন ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) দিকে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে ফেডকেই মূল দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করে তিনি আড়াল নিতে চাইছেন। তিনি বলছেন, সুদহার যথেষ্ট কমানোর সাহস দেখাতে না পারায় অর্থনীতির এই অবস্থা।
বেডমিনিস্টারে নিজের গলফ ক্লাব থেকে প্রেসিডেন্ট টুইট করেছেন, ‘চীন আমাদের সমস্যা নয়। আমাদের সমস্যা ফেডকে নিয়ে। তারা (সুদহার) খুব দ্রুত ও খুব বেশি বাড়িয়েছে। এখন কমানোর ক্ষেত্রে তাদের গতি অতি ধীর।’
কিন্তু সুদহার কমিয়েও ফেড আদতে কিছু করতে পারবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদেরা। গ্র্যান্ট থর্টনের প্রধান অর্থনীতিবিদ ডায়ান সোঙ্ক বলেন, ‘সেপ্টেম্বরের সভাতেই ফেড সুদহার কমানোর ঘোষণা দেবে—এটা নিশ্চিত। কিন্তু এটি কতটা কার্যকর হবে, তা দেখার আছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ফেডের অস্ত্রাগারে টান পড়ছে ক্রমাগত। প্রেসিডেন্ট যে যুদ্ধ করছেন, তা নিজেকে পরাজিত করার শামিল। তাঁর এই মুহূর্তে ফেডকেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কিন্তু তিনি একে দিয়ে যা করাতে চাইছেন, তা করলে ফেড খর্বশক্তিই হবে।’
মহামন্দার পর গত জুনে প্রথমবারের মতো ফেড সুদহার কমায়। সেপ্টেম্বরে আরও কমানো হতে পারে। কিন্তু সুদহার কমিয়েই বাণিজ্য যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব থেকে আমেরিকার অর্থনীতি বের হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। আর তেমনটি হলে পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এর অবধারিত প্রভাব পড়বে ডোনাল্ড ট্রাম্প তথা রিপাবলিকান রাজনীতির ওপর। নির্বাচনের আগে এটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য একটি দুঃসংবাদই বলতে হবে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি তিনি কতটা সামাল দিতে পারেন, তার ওপরই তাঁর পুনর্নির্বাচন অনেকাংশে নির্ভর করছে।