সময় আটকে আছে দেশ ছাড়ার দিনে

দেশ ছেড়ে চলে আসার ১০ বছর হতে যাচ্ছে এই মাসে। ২০০৯ সালের আগস্টের এক মেঘলা বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায় সেই যে দেশ ছাড়লাম, এরপর আর দেশের স্মৃতি বলতে বার তিনেক সপ্তাহ দু-একের জন্য ঘুরে আসা। আমার কাছে তাই বাংলাদেশ এখনো ২০০৯ পূর্ব সময়টাতেই আটকে আছে। আমি মানুষটাই বোধ হয় ওই সময়ে আটকা পড়ে আছি।
দেশে গেলে পাঁচ মিনিটের রিকশা ভ্রমণ শেষে পুরোনো অভ্যাসবশত ১০ টাকা বের করতে গিয়ে থমকে যাই। কারণ এখন তো সাধারণ ভাড়া ২০-২৫ টাকার কম না। স্কাইপ আর চাইমের ভিড়ে মনটা হাহাকার করে ওঠে হলুদ আইকনের ইয়াহু মেসেঞ্জারের জন্য। ব্যাটিংয়ের শেষ কথা বলতে এখনো শচীন টেন্ডুলকারকেই মনে হয়, কোহলি কিংবা স্মিথ না। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এত এত ম্যাচ জিতল গত ১০ বছরে, কিন্তু আমি এখনো সেই ২০০৭ ওয়ার্ল্ড কাপে! ভারতের সঙ্গে জয়ের আনন্দে। এর সঙ্গে আর কোনোটার তুলনা নেই। কোনো এক অজানা কারণে আমার একটা অংশ চাচ্ছে আমি যেন সেই সময়ের স্মৃতিগুলো সযত্নে ধরে রাখি, হারাতে না দিই। কিংবা হয়তো এগুলো কিছুই না, ২০০৭-০৮ এর সময়টা আমার খুব ভালো কেটেছে বলেই হয়তো স্মৃতিগুলো এখনো এত তীব্র হয়ে আছে।
তখন মাত্র ব্যাচেলর শেষ করেই ১৫ হাজার টাকা বেতনে একটা চাকরি শুরু করেছি। দিনের বেলা পিএইচপি-মাইসিকুয়েল দিয়ে নানা রকমের বিজনেস ওয়েবসাইট ডিজাইন করি। অফিস শেষে সহকর্মীদের সঙ্গে চা-শিঙারা-আড্ডা। এরপর এলাকায় এসে স্থানীয় বন্ধুদের সঙ্গে আরেক দফা চা-শিঙারা-আড্ডা। এলাকার বন্ধুরা বেশির ভাগই তখনো হয় স্টুডেন্ট, অথবা মাত্র পড়া শেষ করে বিভিন্ন ধান্দা করার তালে আছে। তাই সবারই অফুরন্ত সময়। আড্ডায় যোগ দিতে আমারই সব সময় দেরি হতো। আড্ডা শেষ করে রাত নয়টার দিকে বাসায় আসা, খাওয়া-দাওয়া, টিভি দেখা। এরপর বাসার সবার সঙ্গে দিনের আপডেট পর্ব শেষ করে রুমে গিয়ে ডিভিডিতে লেটেস্ট মুভি, কিংবা ইয়াহু মেসেঞ্জারে চ্যাট কিংবা নতুন ক্রেজ সামহোয়্যারইন ব্লগে ব্লগরব্লগর। আর শুক্র-শনিবার তো ছিল ঈদের মতো! সব মিলিয়ে ভাবনা চিন্তাহীন স্বর্গীয় জীবন। এভাবে দিন পার করতে করতেই মনে হলো দেশে আর আমার মেধার সঠিক সুবিচার হচ্ছে না! তাই যে করেই হোক বাইরে গিয়ে হাতি ঘোড়া মারতেই হবে। একে একে জিআরই-টোফেল কুপোকাত হলো। আর আমি ক্যাথে প্যাসিফিকের উড়োজাহাজে চেপে চলে এলাম আংকেল স্যামের দেশে। সেই যে এলাম, এরপর থেকে যেন ফর্মুলা ওয়ানের রেসিং কারে চড়ে বসেছে আমার সময়। তীব্র গতিতে এখান থেকে ওখানে ছুটছে আর আমি হাঁসফাঁস করতে করতে কোনো রকম তাল মিলিয়ে যাচ্ছি। তাই সময়-সময় জীবনের কাছে প্যারা খেয়ে যখন চাতক পাখির মতো একটু ব্রেক খুঁজি, তখন ২০০৭-০৮ এর সময়টা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই মায়াবী জগতে। আমি সেখানে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিই, ক্লান্ত পথিকের মতো আঁজলা ভরে পান করি স্মৃতির সুধা। তাই হয়তো অবচেতন মন চায় না ওই সময়ের কোনো স্মৃতিকে হারিয়ে ফেলি। তাই হয়তো ২০০০ সালকে মনে হয় ১০ বছর আগের কথা, ২০ বছর না!
২০০৯ সালের ৭ আগস্ট। প্রথমবারের মতো দেশ ছেড়ে বাইরে যাচ্ছি। উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা মিলেমিশে একাকার। ওই দিন সারা দিন মেঘলা ছিল আকাশ। বিমানবন্দরে আসতে আসতে হালকা বৃষ্টিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। সিটে বসে টেকঅফের জন্য অপেক্ষা করার সময় উড়োজাহাজের জানালা দিয়ে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা দেখছিলাম। ধীরে ধীরে উড়োজাহাজ বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে হংকংয়ের দিকে যাচ্ছে। আমার তখন হঠাৎ দেশে ফেলে আসা বৃষ্টির কথা খুব মনে পড়তে লাগল। বৃষ্টিটা কি থেমে গিয়েছে এখন? নাকি আরও জোরে ঝড় হয়ে নামছে? দেশে আমার রুমের সামনে ছিল নানা রকমের ফলের গাছ, জোরে ঝড় হলে একটা আরেকটার সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে দেখার মতো একটা দৃশ্য তৈরি করত। সেই দৃশ্য দেখতে বারান্দায় বসে থাকতাম। এখনো কি সেরকম কিছু হচ্ছে? বারান্দাটা কি আমাকে মিস করছিল তখন? আমি হঠাৎ করে অনুধাবন করলাম আমি আর সেই বৃষ্টির কোনো অংশ নই! দেশের সেই বৃষ্টির ওপর আমার আর কোনো অধিকার নেই! দীর্ঘ ২৫ বছরের সম্পর্ক যেন নিমেষেই অর্থহীন হয়ে গেল।
ফ্লাইটের কয়েক দিন আগে থেকেই আম্মু প্রতিদিন ভোরে আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদত। আম্মু আসার শব্দ পেয়েই আমার ঘুম ভেঙে যেত। কিন্তু আমি বুঝতে দিতাম না। তখন ভাবতাম এত কান্নাকাটির কী আছে! ফ্লাইটে বসে এক বুক শূন্যতা নিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে কান্না আসছে। দেশের বৃষ্টির জন্য, আমার ফেলে আসা রুমের জন্য, বাবা-মার জন্য, বন্ধুদের জন্য এমনকি বাসার নিচের বিড়ালটার জন্য অসম্ভব মায়া হতে লাগল। তখনো কী আর বুঝেছি যে দূরত্ব তৈরি করছি, এক জীবনে তা আর ঘোচানো সম্ভব নয়! দিন দিন তা বেড়ে বেড়ে অলঙ্ঘনীয় এক দেয়াল তৈরি করে ফেলেছে। যা ভাঙা নিতান্তই ছা-পোষা আমার কম্ম নয়। আমার অবচেতন মন আমাকে ওই সময়ে আটকে রাখতে নানা ফন্দি ফিকির করলেও দিন শেষে অক্ষম স্মৃতিচারণের বেশি কিছু করতে পারি না। আসলে আমাদের বেশির ভাগের জন্যই দেশ থেকে দূরে থাকাটা এক ধরনের ট্রেডঅফ। আমরা নিজেদের নিরাপদ জীবন, সন্তানের ভবিষ্যৎ আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ট্রেডঅফ করি বাবা-মা-ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবে ভরা একটা পূর্ণ জীবনকে, নিজের দেশকে। এটা নিয়ে অভিযোগ করার আসলে কিছুই নেই। কারণ এটা আমাদেরই পছন্দ। কিন্তু মন, সে বড় অদ্ভুত উপায়ে কাজ করে। সে বুঝতে চায় না হোয়াই উই কান্ট ইট দ্য কেক অ্যান্ড হ্যাভ ইট টুও। এ জন্যই সময়ে সময়ে বড়ই উদাস লাগে।
ড. জাফর ইকবাল স্যারের আমেরিকা নিয়ে একটা লেখায় শেষের কথাগুলো আমার খুব পছন্দের—‘...বিদেশে দীর্ঘদিন থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনকে উপভোগ করে কখনো যদি দেশের জন্য বুক টনটন করে, তখন কী করতে হবে? তখন তারা আবার এ দেশটাতে ফিরে আসতে পারবে। মা যেমন করে তার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে, দেশমাতৃকাও ঠিক সে রকম করে তার সন্তানের জন্য গভীর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে, অপেক্ষা করে আছে। আমি বাড়িয়ে বলছি না-আমি এটা জানি...’
আমি অনেক দিন পর্যন্ত মনে করতাম এটা একটু বাড়িয়ে বলা, কিন্তু এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, নট সো শিওর!