ক বি তা র এ ক পা তা

জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে একজন বাঙালি দেশান্তরি হয়ে ঠাঁই গাড়েন না কেন, সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর ভাষা ও সংস্কৃতি। দেখতে দেখতে গত কয়েক দশকে উত্তর আমেরিকায় কয়েক লাখ বাংলাদেশি বাঙালি বসত গড়েছেন। বিকশিত হয়েছে বাংলা সাহিত্য, বিস্তৃত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতি। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলা সাপ্তাহিকগুলো সে গৌরবের অংশীদার।

একেবারে শুরু থেকেই প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা তার পাতায় পাতায় বাংলা ছোটগল্প, কবিতা ও সংস্কৃতি চর্চার প্রতি উৎসাহী ও মনোযোগী থেকেছে। এ সংখ্যা থেকে চালু হচ্ছে কবিতার বিশেষ মাসিক আয়োজন। ইংরেজি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের নিয়মিত আয়োজন ‘কবিতার এক পাতা’ সব কবিতাপ্রেমী ও প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার পাঠকদের সাদর আমন্ত্রণ।

দিনগুলো
মাহবুব হাসান

কাঠের বারান্দা হয়ে ঝুলে আছে দিন আমার
তুমিও আছ তেমনি
জীবন তো আর বাসাবাড়ি নয়
তবু ভাসমান আমাদের চার দিগন্ত।

নিঃসঙ্গ অ্যাটিক খুব কি ভালো?
একা একা কথা বলা মানুষের স্বভাবে
আক্রান্ত
চিলেকোঠা মানুষ নয়
তবু তার আছে ভাবনার খামার!

সেখানে সৃষ্টি হয় শব্দমালা বাংলার
তারা উড়ে যেতে পারে এই ভয়ে রোদহীন দিন
আনন্দ ভৈরবী বাজায়।
আমি তার ভেতরে বাস করি।


দেশে দেশে
শামস আল মমীন

নিউইয়র্কের আইল্যান্ডগুলো সারা রাত
নেভে জ্বলে, কিন্তু
বহু বহু দেশে
এবং বাংলাদেশে,
এইক্ষণে, চারিদিক ফরসা হয়ে আসে..
টেবিলে টেবিলে উষ্ণ রুটি, কমলার রস, আর
মেলামাইনের মায়াবী প্লেটে গোল গোল সব
ডিমের কুসুম
স্বাগত জানায়..

সুপ্রভাত, হে সুসময়। কিন্তু
ফেরিঘাটে,
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে
কুলিদের লাল লাল জামার ভেতর থেকে
সকালের সুশোভিত আলো
নদীভাঙা উদ্বাস্তুর
ম্লান মুখ থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসা
বিড়ির ধোঁয়ার মতো
আস্তে আস্তে
মিশে যাচ্ছে গ্রাম ও শহরে।

টাইম স্কয়ারে ছটফট করা আলোর ঝলক দেখতে দেখতে
কখন যে একটি বালক
হঠাৎ পিছলে পড়ে মিরপুরে, সাভারের
রপ্তানিমুখী পোশাক তৈরি কারখানার ফটকে;
মালিবাগ মগবাজারে
রেললাইনের ওপর
হাঁটু গেড়ে বসে থাকা বৃদ্ধের উদাস চোখে।
বিদেশ ফেরত দম্পতির স্ফীত অনুদানে
উলিপুর কুড়িগ্রামে
চকচক করে ওঠে মাদ্রাসার ঢেউটিন।

বস্তির অস্থির শীতে জড়সড় শিবু কাকা
রিলিফের কম্বল হাতে
ফোকলা দাঁতের বিষণ্ন হাসিতে আনন্দ ছড়ায়
মঙ্গাপীড়িত উলিপুরে..
এই সব দুপুর রাত্রি এবং
নীরব সকাল
ঘুরে ফিরে আসে;
আমরা জানালা খুলে দেখি
কলতলে ভিড়,
ঝাড়ু-হাতে রঘুনাথ ফুঁ দেয় গরম চায়ে,
আর
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে
পাগলিটা...
তখনো গভীর ঘুমে।

ইন্টারপ্রিটার
ফকির ইলিয়াস

গোলাপের চোখের দিকে আমি কখনোই তাকাবার
সাহস করি’নি। আমার লাল চোখগুলো কখনোই
ধারণ করতে পারে’নি গোলাপের লাল।
তাকাই’নি শাদা গন্ধরাজের দিকেও। ভয় ছিল—
আমার রক্তের হিমোগ্লোবিনে বেড়ে যেতে পারে
শ্বেতকণিকা। অথবা নিই’নি কর্পূরের গন্ধ,
ডেটলে ধুই’নি হাত। সূর্যের অমরতা নিয়ে যে
আলো-জীবাণু আমার হাতে লেগে আছে, চাই’নি
তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক।

পড়ে দেখি’নি এমন অনন্তের অনুবাদ কোষ।
যে শীতল মেঘের প্রেমগল্প শুনেছিলাম—
তা দিয়ে লিখি’নি বিনীত মৃত্তিকার ভূমিকা।
একটি শালিখ যে গ্রামে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল,
আমি সেই গ্রামের পথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে
কিছু পঙ্‌ক্তি গোপন করেছি পাতাদের নিচে!

অনুবাদক হে!
তুমি আমার পত্র-পাঁজরগুলো তোমার ভাষায়
পুনরায় এই তৃণলতায় লিখে দাও।

বৃক্ষ নদী
কাজী জহিরুল ইসলাম

বৃক্ষেরও আছে নদী, উঁচু ডালে বেঁধে রাখে
আমার নিজস্ব গাছ পাতার আড়ালে ঢাকে
তার দুটি গোপন গাঙ,
যদি আমি দেখে ফেলি।
যদি আমি অসময়ে নেমে পড়ি;
অসময়ে, জলকেলি!

ওম দেয়, জল দেয়, পরিযায়ী পাখিদের।
ভালোবেসে গৃহ দেয় দেহের ফাটল খুলে
এসেছে যে পথ ভুলে ছায়া দেয় তাকে।

আমাকেই দেয় না শুধু, দিয়েছে যা বাকিদের।
আমিও খর চৈত্রে দিই প্রচণ্ড ঝাঁকুনি,
ঢেউ তুলি প্রাইভেট গাঙে
টের পাই কিছু ভাঙে
ভেঙে পড়ে শব্দহীন, আমি কম্পন গুনি,
শুনি, শব্দহীন শব্দ-বল্লরি

সিকস্তির ডাক
তমিজ উদ্‌দীন লোদী

খুব সাদামাটা নদী সিকস্তির বাঁক যেন ডাকে
এসো হে বালক তুমি মোহনায় মায়ামুগ্ধময়
জ্যোৎস্না ধোয়া মুগ্ধ বিভাবরী ঋদ্ধ সেটুকু সময়;
যদিও এখনো ঈর্ষা মৃত্যুভয় প্রতিহিংসা থাকে।

তবুও অচেনা ঢেউয়ে মেতে ওঠে পুরোনো মাতাল
ফেলে দ্বন্দ্ব ফেলে ক্রোধ ফেলে বহুল সংশয়
বিপ্রতীপ কোণ থেকে জেগে ওঠে লাল সূর্যোদয়
প্রজন্ম প্রজন্ম থেকে ভালোবাসা উথাল-পাতাল ।

কী করে উপেক্ষা করি সেই চেনা সিকস্তির ডাক
যদিও পলির পাঁকে ঠেসে গেছে যৌবনের হাঁক।

অপেক্ষা অথবা উপেক্ষা
সাজ্জাদ বিপ্লব

অপেক্ষা করা যেমন শক্ত
উপেক্ষা করাও তেমনি কঠিন
গ্রানাইট পাথর যেন এ বুকের ওপর
সে তুমি বুঝবে না!
তুমি দেখলে জল, নরম আর কী মোলায়েম
যেমনটি তোমার পক্ষে স্বাভাবিক

কিন্তু এই দেখা একটু রিভার্স করে বা অন্য অ্যাঙ্গেলে দেখো, দেখো বিপ্রতীপ কোণ থেকে
দেখবে, সরল পথও কেমন সুন্দর এঁকেবেঁকে চলে গেছে, সোজা তোমার দিকে

স্পষ্ট এবং পরিষ্কার
যাদের চোখে ঠুলি ও ধুলোবালি
কেবল তাদের চোখেই
তুমি কাঁটা।
আমার কাঙ্ক্ষিত গোলাপ।