নানকার বিদ্রোহ এবং শোষণমুক্ত কৃষক

এইতো কিছুদিন আগে কৃষিপ্রধান আমাদের দেশে মহান কৃষকদের ধানের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে বিভিন্ন মিটিং-ফিটিং, সভা-সমিতি হয়ে গেল। কিন্তু কতটুকু অধিকার ও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন আমাদের দেশের সব সাধকের বড় সাধক কৃষকেরা? সেই ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসন আমল এবং সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশের আজ প্রায় অর্ধশত বছরেও কৃষকেরা শাসক গোষ্ঠীর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে নিজ অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে যাচ্ছেন। এমন এক ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী অধিকার আদায়ের সংগ্রামের নাম নানকার কৃষক বিদ্রোহ।
ব্রিটিশ আমলে নান বা রুটি দিয়ে কেনা গোলামকে নানকার বলা হতো। নানকার প্রথায় তৎকালীন জমিদারেরা কৃষকদের গোলাম বানিয়ে খাদ্য-শস্য ও অধিকার শোষণ করত। নানকার প্রথা বিলোপ, কৃষকের জমির অধিকার আদায় ও জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সিলেট অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কৃষকেরা তখন প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৪৯ সালের ১৮ আগস্ট পুলিশ, ইপিআর আর জমিদারদের পেটোয়া বাহিনী সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার তিলপাড়া ইউনিয়নের সানেশ্বর ও উলুউরি গ্রামের মধ্যবর্তী সুনাই নদীর তীরে আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে শহীদ হয়েছিলেন ব্রজনাথ দাস(৫০), কটুমনি দাস (৪৭), প্রসন্ন কুমার দাস (৫০), পবিত্র কুমার দাস (৪৫) ও অমূল্য কুমার দাস (১৭)।
ওই ঘটনার ১৫ দিন আগে সুনাই নদীতে জমিদারের পোষ্যদের লাঠির আঘাতে নিহত হন রজনী দাস নামের এক কৃষক। তাঁদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৫০ সালে তৎকালীন সরকার জমিদারি প্রথা বাতিল করে কৃষকদের জমির মালিকানার স্বীকৃতি দেন। তখন থেকে সেই নানকার আন্দোলনের মহান শহীদদের স্মরণে প্রতি বছর ১৮ আগস্ট ‘নানকার বিদ্রোহ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন স্থানীয়েরা। তবে আজ প্রায় ৭০ বছরেও মেলেনি সেই আন্দোলনের কোন জাতীয় স্বীকৃতি, যা আমাদের পুরো জাতিকে জমিদারি প্রথার শোষণ থেকে মুক্তি দিয়েছিল।
প্রতি বছরের মতো চলদি বছরও স্থানীয়েরা যথাযোগ্য মর্যাদায় ৭০তম ঐতিহাসিক নানকার কৃষক বিদ্রোহ দিবস পালন করেছেন। কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তাঁরা কৃষক শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার তিলপাড়া ইউনিয়নের সানেশ্বর ও উলুউরি গ্রামের মধ্যবর্তী সুনাই নদীর তীরে নির্মিত শহীদ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং নানকার বিদ্রোহের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেন। বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ডের সভাপতি আবদুল ওয়াদুদের পরিচালনায় এতে সভাপতিত্ব করেন বিয়ানীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. আবদুস শুকুর।
আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. সরওয়ার হোসেন, বিশেষ অতিথি ছিলেন বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আতাউর রহমান খান, বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মজির উদ্দিন আনসার, সিলেট মহানগর শ্রমিক লীগের সভাপতি এম শাহরিয়ার কবির সেলিম, তিলপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. ইসলাম উদ্দিন, বিয়ানীবাজার উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক জামাল হোসেন, বিয়ানীবাজার উপজেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি আনিসুর রহমান, সিলেট জেলা মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ডের সহসভাপতি কবি ওয়ালী মাহমুদ প্রমুখ।
আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন নানকার স্মৃতি রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কেতকী রঞ্জন দাস, শিক্ষক সাধন দাস এবং মিন্টু কান্ত দাস প্রমুখ। আলোচনায় বক্তারা বলেন, কৃষকদের ন্যায্য অধিকার আদায় ও শোষণ মুক্তির আগ পর্যন্ত এই সংগ্রাম চলবে। আলোচনায় তাঁরা নানকার কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসকে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তরুণ সমাজকে দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের ইতিহাস জানাতে অনুরোধ করেন এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এই দিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের স্বীকৃতি দাবি করেন।
নানকার কৃষক শহীদ স্মৃতিসৌধে ১৮ আগস্ট পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বিয়ানীবাজার পৌরসভা, বিয়ানীবাজার সাংস্কৃতিক কমান্ড, উলুউরী গ্রামে প্রতিষ্ঠিত নানকার স্মৃতি পাঠাগার, সানেশ্বরের নানকার স্মৃতি সংসদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, কানাডা আওয়ামী লীগ, বিয়ানীবাজার জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এবং উলুউরী নানকার স্মৃতি যুব সংঘ।
নানকার বিদ্রোহ একটি জাতীয় অধিকার আদায়ের আন্দোলন। এই আন্দোলনের গৌরব ও ভয়াবহতার ইতিহাস নিপুণ হাতে বর্ণিত হয়েছে অজয় ভট্টাচার্য রচিত ‘নানকার বিদ্রোহ’ গ্রন্থে। এই আন্দোলনের সাক্ষী হিসেবে আজও আমাদের মধ্যে আছেন দেশের ইতিহাস জানা অনেক গুণীজন এবং মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও লেখক তাজুল মোহাম্মদ। আমরা এ বিদ্রোহের ইতিহাসকে যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয়ভাবে স্মরণ করে দেশের মহান কৃষকদের জন্য করতে পারি একটি জাতীয় শোষণ মুক্তির দিন, গড়তে পারি আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি স্বপ্নের দেশ; সোনার বাংলাদেশ।