যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান সম্পর্ক, বরফ গলেও গলছে না

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও  ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: এএফপি
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: এএফপি

ফ্রান্সে জি-৭–এর শীর্ষ বৈঠকে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফের নাটকীয় আগমনের ভেতর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে অব্যাহত ঠান্ডা ও গরম লড়াই কমার আভাস মিলেছে, এ ব্যাপারে অধিকাংশ ভাষ্যকার একমত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে বলেছেন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তাঁর অনুমতি নিয়েই জারিফকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

গত বছর মে মাসে ইরানের সঙ্গে বহুজাতিক পারমাণবিক চুক্তি এককভাবে বাতিলের পর থেকে দেশটিকে একঘরে করতে ও তার অর্থনীতি বিপর্যস্ত করতে ট্রাম্প নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে ইরানের বৈধ তেল রপ্তানি এখন কার্যত শূন্য ব্যারেলে এসে পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশের ভেতর ক্রমবর্ধমান নাগরিক অসন্তোষ এড়ানো ইরান সরকারের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। চূড়ান্ত বিপর্যয় এড়াতে যেভাবে সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী ইরান। কিন্তু সমঝোতার সব পথ ট্রাম্পকে অনুসরণ করেই যাবে, এ কথা ইরান খুব ভালো করেই জানে।
জি-৭ বৈঠক চলাকালে কোনো একসময় ট্রাম্প ও জারিফ মুখোমুখি হতে পারেন, পত্রপত্রিকায় এমন জল্পনাকল্পনা হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ট্রাম্প অবশ্য বলেছেন, অবস্থা অনুকূল হলে তিনি ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতে আগ্রহী। জবাবে সোমবার এক টেলিভিশন ভাষণে রুহানি তাঁর সম্মতি জানিয়ে বলেন, আমাদের আলাপ-আলোচনায় যেতে হবে, একটা সমাধান আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সমস্যার সমাধানে এ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।

আজ মঙ্গলবার অবশ্য রুহানি তাঁর সুর বদলে ফেলেন। এদিন এক বিবৃতিতে তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র যতক্ষণ ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করছে, ততক্ষণ এমন আলোচনার কোনো মানে নেই। আলাপ-আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি সব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন।

কোনো কোনো ভাষ্যকারের ধারণা ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে রুহানির প্রাথমিক আগ্রহ প্রমাণ করে এ ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির সম্মতি রয়েছে। তাঁকে না জানিয়ে এমন বৈঠকের ব্যাপারে নিজের সম্মতির কথা তিনি জানাতেন না। কিন্তু এখন যে উল্টো কথা বলছেন, তাতে মনে হয় এ ব্যাপারে কট্টরপন্থীদের আপত্তি এখনো কাটেনি। কার্নেগি এন্ডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস সংস্থার ইরান বিশেষজ্ঞ আরিয়ানা তাবাতাবাই মন্তব্য করেছেন, ইরানের জন্য এই দুই নেতার মুখোমুখি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইরানের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বাতিল। রুহানির সর্বশেষ বক্তব্য থেকে সে কথাই প্রমাণিত হলো।

অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে ইরানের যেমন ট্রাম্পের সাহায্য লাগবে, তেমনি ২০২০ সালের পুনঃ নির্বাচনের মুখে নিজের ‘ইমেজ’ ঝালাই করতে ট্রাম্পেরও চাই ইরান প্রশ্নে অগ্রগতি। পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ রোধে ইরানের সঙ্গে এই চুক্তিটির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ওবামার নাম জড়িয়ে আছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, সে কারণেই চুক্তিটি ট্রাম্পের এত অপছন্দ। এখন তিনি নিজে একটি ভিন্ন চুক্তি করতে চান, এমনকি সে চুক্তিতে যদি পূর্বের তুলনায় বড় কোনো পরিবর্তন না–ও থাকে। ‘ডিল মেকার’ হিসেবে নিজের সাফল্য প্রমাণে এই চুক্তি তাঁরও প্রয়োজন।

অন্য ইউরোপীয় নেতাদের সমর্থনে এই দুই দেশকে এক টেবিলে বসাতে যে উদ্যোগ ফরাসি প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করেছেন, তাঁর বিশ্বাস সে উদ্যোগ সফল হওয়ার যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। সোমবার ট্রাম্পকে পাশে রেখে এক সংবাদ সম্মেলনে স্মিত হাসিমুখে মাখোঁ বলেন, তিনি আলোচনার ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে আশাবাদী। আলোচনার মাধ্যমে সংকটের একটি সমাধান খুঁজে পাব বলে আমি মনে করি, তিনি বলেন।

আজ অবশ্য মাখোঁর গলার স্বর কিছুটা নিস্তেজ হয়ে আসে। সম্মেলন-পরবর্তী এক ভাষণে তিনি বলেন, ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রকে মুখোমুখি আলোচনায় বসানো বেশ কঠিন, তবে সংকট সমাধানে একটি পথ খুঁজে পাওয়া সম্ভব বলে তিনি এখনো মনে করেন। এর আগে তিনি বলেছিলেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এমন একটি বৈঠক আয়োজন করা সম্ভব। মঙ্গলবার অবশ্য কবে সেই বৈঠক হবে সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে রাজি হলেন না।