প্রতিশোধ দেওয়ান

১.
হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে গেল রাজনের। ঘুম ভাঙার কারণ হঠাৎ করে অফিসের একটি কাজের কথা মনে পড়ে গেল। তখন রাত আড়াইটা। পরে আর ঘুম হয়নি রাজনের। প্রথমে ঘুম না তন্দ্রা বুঝতে সময় লেগে গেল প্রায় ২ ঘণ্টা। এভাবে মোবাইল অ্যালার্মে সকাল ৮টায় ঘুম থেকে ওঠার আগ পর্যন্ত রাজনের নির্ঘুম কেটেছে পুরোটা সময়। অফিসের কাজটি খুব টেনশনের ছিল না কিন্তু নয়। এমডির সঙ্গে ফলোআপ করাটা খুব দরকারি ছিল। রাত প্রায় ৯টা বেজে যাওয়ায় এমডির রুমে আর যাওয়া হয়নি রাজনের, রাতে কেন যেন মনে হলো কেন, এমডির সঙ্গে ডিসকাসটি করা হলো না। এই মনে হওয়াটাই ছিল যত নষ্টের গোড়া। ফলে নির্ঘুম প্রতিটি সময়। সকালে ভয় শুরু অফিসে আসার পথে। রোজই উত্তরা থেকে জ্যাম ঠেলে ধানমন্ডিতে আসা একটি ঝামেলাই বটে। অফিস টাইমে সময়মতো পৌঁছানোর জন্য প্রায় ২ ঘণ্টা হাতে রেখে বের হয় রাজন। রাতে ঘুম কম হলে এই দীর্ঘ পথের মাঝে একটু ঘুমিয়েও নেয় রাজন। এতে অফিসে এসে বেশ প্রাণচাঞ্চল্য অনুভব করে রাজন। আজ সেই দীর্ঘ পথে ঘুম এলে কই?
চিন্তার কারণ তাহলে কি রাজনের ঘুম আর আসবে না! নির্ঘুম থাকলে তো শরীরে সমস্যা তৈরি হবে। এই শারীরিক সমস্যা থেকেই ঘটবে মৃত্যু! মৃত্যু চিন্তা আসা মাত্রই রাজনে একটু নড়ে চড়ে বসে। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি ঘুম আর আসবে না? কিন্তু ছাত্র বয়সে যতটুকু মনে পড়ে, ফ্রয়েড তত্ত্বে ঘুম আর স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনা হয়েছে বিস্তর। ঘুম হচ্ছে সারা দিনের পরিশ্রমের ফলে ক্লান্ত¯স্নায়ুগুলোর যখন সচেতন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্তিমিত থাকে। মানুষ ও অন্যান্য স্তন্যপায়ীসহ আরও কিছু প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য খুব দরকারি। ঘুম না হলে খুব সমস্যা তৈরি হয়, যা খুব জটিল আকার ধারণ করতে পারে। যেমন মাথা ব্যথা বা মেজাজ খিটমিট হওয়া, নয়তো কিছুই ভালো লাগে না আবার ক্লান্তিতে ভোগার ফলে সৃষ্টি হবে একাকিত্ববোধ। আর এই একাকিত্ববোধ থেকে হতে পারে ব্রেন স্ট্রোক কিংবা আত্মহত্যা।
এই পর্যন্ত ভাবতে গিয়ে রাজন কিছুটা ঘেমে উঠে যেন। আসলে চাকরি আছে কি–নেই...এই ভাবনাটাই কয়েক দিন ধরে পেয়ে বসেছে রাজনের। তারপর কালকের নির্ঘুম রাত। অফিসে কয়েক দিন থেকে কানাঘুষা চলছে লোক ছাঁটাইয়ের। কদিন আগে বন্ধু মনজুর ফোন, একটি টেলকো কোম্পানিতে চাকরি করত সে। জানাল রিজাইন করতে বলেছে। বেচারা এখন চাকরি খুঁজছে, রাতে চাকরির বাজারের দুর্মূল্যের কথা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কাল রাতে হঠাৎই বলে ফেলল, দোস্ত খামার দিই, কি বলিস? স্কুলের প্রথম দিকের ছাত্র ছিল মনজু। পড়েছিল ফিন্যান্সে। ব্যাংক–টেলকো এই দোটানায় পড়েছিল বেচারা। রাজন বলেছিল ব্যাংকে জয়েন কর। কী বুঝে মনজু টেলকোতে জয়েন করে। কাল কথাচ্ছলে বলেছিল, তোর অ্যাডভাইস শুনলে ভালো হতো। কিন্তু রাজনও জানে, কয়েকটি ব্যাংক বাদে এই সেক্টরেও সমস্যা চলছে। আসলে ভাবতে গেলে সমস্যা আছে। এই সমস্যা বেশ জটিল আকার ধারণ করছে, ফলে আর সমস্যা নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা করছে না রাজনের।

২.
মিথিলার আজ মন খারাপ। প্রজেক্ট প্রোফাইল যা করেছিল, তার লাভ হলো কই। সব শেষ। ক্লায়েন্ট বলে গেল, অল আর বোগাস। সেই থেকে মিথিলার মন খারাপ। কত দিনের চেষ্টা, রাতদিন পরিশ্রম এই মিটিংয়ে শূন্য। অসার হয়ে বিছানাতে পড়ে আছে মিথিলা। নিবির খুব হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে ছিল মিথিলার দিকে। রাগে আরও ক্ষেপে উঠেছিল মিথিলা। কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনি। হাসিতে অপমান, পুরোটাই সহ্য করতে হয়েছিল মিথিলার। আসলে প্রজেক্টটা প্রথমে দুজনকেই দেয় আশফাক স্যার। পরে নিবিরকে বাদ দিয়ে মিথিলাকে একাই দায়িত্ব দেয় ক্রিয়েটিভ হেড আশফাক আহমেদ। নিবির বলেছিল, দেখব ক্লায়েন্ট তোমারটা অ্যাকসেপ্ট করে কিনা?
-অবশ্যই করবে। জেন রেখ, তোমার থেকে ভালো প্রজেক্ট বানাতে পারি আমি।
আচ্ছা, নিবিরের কোন হাত নেই তো প্রজেক্ট চয়েস না করার ক্ষেত্রে। স্যারকে ফোন দেব? বিষয়টি শেয়ার করব? না না, স্যারকে ফোন দেওয়ার কোন মানে নেই, যেহেতু বিষয়টি অনুমান। যদি স্যার নিবিরকে চাকরিচ্যুত করে দেয়।
রাজনকে ফোন করে মিথিলা।
-কী, আজ ফোন করলে না যে? রাজন জানতে চাইল।
-মনটা ভালো নেই?
-কী হয়েছে।
জবাবে অফিসের বিষয়টি খুলে বলল মিথিলা।
-ভেরি স্যাড। তোমার প্রজেক্ট তো ফেল করার কথা না। নিবির বাগড়া দেয়নি তো?
কথাটি শুনে মিথিলা একটু থমকালো যেন। রাজনওতো নিবিরকে সন্দেহ করছে? কিন্তু রাজন ওদের প্রভাবিত করবে কীভাবে?
-কথা বলছ না যে? ওপাশ থেকে রাজন বলে উঠে।
-জান, আমারও মনে হয়েছিল...কিন্তু নিবির খুব স্ট্রেট ফরোয়ার্ড ছেলে। কোম্পানির জন্য ওর সিরিয়াসনেস সবারই জানা। কী হলো, ঠিক বুঝতে পারছি না। এই কথা বলার মাঝে আশফাক আহমেদের ফোন। রিং হচ্ছে দেখে মিথিলা বলে উঠে। এই রাখি স্যার ফোন করেছে। ফোনটি কেটে আশফাক আহমদকে ফোন করে মিথিলা।
-আসসালামুআলাইকুম স্যার...আপনি ফোন করেছিলেন?
-ক্লায়েন্ট থেকে ফোন করেছিল?
-অ্যানি নিউজ স্যার...
-ঠিক বুঝতে পারছি না..ওরা ফোন করে জানাল, মিথিলাকে একটু আসতে হবে।
-কোথায় স্যার...
-ওদের অফিসে...
-তাহলে নিশ্চয় স্যার প্রজেক্ট ওরা লাইক করেছে।
-আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু বলল ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। গ্রুপের চেয়ারম্যান তোমাকে দেখা করতে বলেছে।
-আপনি কী বলেন স্যার...যাব...
-বুঝতে পারছি না। চেয়ারম্যান যেহেতু অফিসে ডেকেছে যাও, দেখ কী বলেন।

৩.
সকাল ১০টায় গুলশানে এসেছে মিথিলা। জিগাতলা থেকে গুলশান, ঠিক ১০টায় আসতে গিয়ে বেশ ভোরেই তৈরি হয়ে রওনা হয়েছে মিথিলা। এখন প্রায় ১১টা বাজে। আসার পর থেকে শুনছে, চেয়ারম্যান সাহেব মিটিংয়ে আছে, এখনো তাই। কী করবে বুঝতে পারছে না। একটু বিরক্তও লাগছে। এরই মধ্যে দুজন ভিজিটর দেখাও করে গেছে, কিন্তু মিথিলাকে বলছে মিটিংয়ে আছে। এই সময়ে রিসিপশনিস্ট জানাল, চেয়ারম্যান ডাকছে।
বেশ সুন্দর আধুনিক ডিজাইনের অফিস, রুচির ছাপ সবখানে। বেশ প্রশস্ত লন দিয়ে নিয়ে গেল সিকিউরিটি। দরজা খুলে প্রবেশ করল মিথিলা। চেয়ারম্যানকে দেখে রীতিমতো অবাক মিথিলা! কাকে দেখছে সে? ভার্সিটির জুনায়েদ ভাই। সালেহ জুনায়েদ ফয়সাল। সেই ব্যাচে ফয়সাল নামে আরেকজন থাকায় জুনায়েদ নামেই পরিচিত ছিলেন ডিপার্টমেন্টে। জুনায়েদ মিথিলাদের থেকে চার ব্যাচ সিনিয়র ছিল। ড্রেস–আপ গেট–আপে তেমন ভালো লাগেনি মিথিলার কোন দিন। আসলে মিথিলা জুনায়েদকে নিয়ে ভাববে তেমনটি হওয়ারও কথা নয়। কিন্তু জুনায়েদ কী মনে করে একদিন পথ আগলে তার ভালোবাসার কথাটি বলেছিল মিথিলাকে। সারা রাত যারপরনাই বিরক্তি নিয়ে রাতটি পার করেছিল মিথিলা। এই রকম আনস্মার্ট একটি ছেলেকে সে কেন ভালোবাসতে যাবে!
পরদিন আর ভার্সিটি গিয়ে জুনায়েদকে পাচ্ছিল না। পেল গিয়ে মল চত্বরে। প্রপোজ করার জন্য তিরস্কার করে মিথিলা চলে এসেছিল। এরপর আর কেন জানি মিথিলার সঙ্গে জুনায়েদের দেখা হয়নি।
আজ জুনায়েদ মিথিলার সামনে। একটি কোম্পানির চেয়ারম্যান। বেশ পরিপাটি ভাব।
মিথিলা দোটানায় পড়ে যায়। জুনায়েদ বুঝতে পেরে বসতে বলে। চা খাবে কিনা জানতে চায়। মিথিলা মানা করে। এবার মিথিলা বুঝতে পারে বসিয়ে রাখার কারণ। মিথিলাই বলে উঠে।
-আপনি খুব ব্যস্ত। সময় নেব না। কি কারণে ডেকেছেন যদি বলেন।
-যদি বলি অপমানের প্রতিশোধ নিতে।
-কারও মন্দ লাগাটা অপমান হয় কি করে? মিথিলা বলে উঠে।
-তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করতে পার কিন্তু বন্ধুদের সামনে কথাটি নাও বলতে পারতে। জোর করে কিছু হয় না জানি। কিন্তু তুমি একবারও ভাবলে না, আমার বন্ধু যেখানে মেয়েরাও ছিল, তাদের সামনে যখন বলছিলে আমি সেদিন আর কাউকে মুখ দেখাতে পারছিলাম না। আমি ধীরে ধীরে ভার্সিটিতে যাওয়া কমিয়ে দিই, বন্ধ করতে পারলে ভালো হতো। তোমার প্রজেক্ট দেখে আমি আর রাগ ধরে রাখতে পারলাম না। সবার সামনেই রিজেক্ট করেছে কোম্পানি। কেমন লাগল মিথিলা? এবার আমার ব্যাপারটি বুঝতে পারছ তো?
মিথিলা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে জুনায়েদের দিকে। তখনই আশফাক আহমেদের ফোন। ফোনটি ধরবে না ইগনোর করবে বুঝতে পারে না মিথিলা। ফোনটি বেজে যেতে থাকে।