আটলান্টা সাহিত্য সমাবেশের অন্দরে

আটলান্টার উইনগেট হোটেলে ঢুকতেই দেখি লবিতে এক গোঁফওয়ালা বাঙালি ভদ্রলোক বসে আছেন। হাত মেলাতেই বললেন, ‘আমি লুৎফর রহমান রিটন’। তাঁকে আবার কে না চেনে! তবে সামনাসামনি সাক্ষাৎ এই প্রথম। পরে তাঁর সঙ্গে বিস্তর আলাপ হলো।

চেক-ইন করতে শুনলাম সবাই ১১৭ নম্বর রুমে। প্রি-রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। সেখানে বিরিয়ানিও আছে। রুমে একঝাঁক সাহিত্যিকের দেখা পেলাম। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রবাসী লেখিকা পূরবী বসু বয়স-জরা উপেক্ষা করে নিজেই দাঁড়িয়ে সবার খোঁজখবর নিচ্ছেন। একজন খাবার সাধলেন। মজার বিষয়, সেই খাবারের পয়সা নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তারপর আশফাক স্বপন, যিনি অনেক আগেই ডাক্তারি ছেড়ে পুরোদস্তুর সাংবাদিক ও লেখক হয়েছেন, তিনি রেজিস্ট্রেশন করিয়ে চারটি কুপন ধরিয়ে দিলেন।

দুদিনের সাহিত্য সমাবেশে দুপুর-রাতের খাবার আর কোথাও খুঁজতে যেতে হবে না। রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছি মাত্র বিশ ডলার। তাতেই এত কিছু কীভাবে হচ্ছে! বোঝা গেল উদ্যোক্তারা গাঁটের সময় এবং টাকা, দুটোই উদার হাতে এই সমাবেশের জন্য ব্যয় করেছেন।

জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন, ‘প্রতিটি মানুষকে একটা নির্দিষ্ট কাজের জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং সেই কাজটি তার হৃদয়ে গ্রন্থিত আছে। প্রতিটি মানুষ ভেতর থেকে ঠিক সেই কাজটি করার জন্যই তাড়না অনুভব করে।’

আমি নিয়তিবাদী নই। কিন্তু ঠিক এই তাড়নার কারণেই যেন, গেল শনি ও রোববার, উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আটলান্টায় এসে জড়ো হলো প্রায় শতাধিক লেখক-কবি-সাহিত্যিক। এমনকি কলকাতা থেকে এলেন কবি কুন্তল রুদ্র। অনেকেই পরিবার–পরিজন নিয়ে এসেছিলেন। একটা জমজমাট সমাবেশ। দুদিন, দুরাত ধরে চলল বেশুমার কবিতা-গল্প, সাহিত্য-আড্ডা। আনুষ্ঠানিক শুধু নয়, অনানুষ্ঠানিকভাবেও। প্রতিটি সন্ধ্যায় সংগীতের মূর্ছনা তো ছড়ালই, তার সঙ্গে প্রাণেরও।

রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই কথাটা হালকাভাবে বলেছেন, ‘সংসারের কোন কাজেই যে হতভাগ্যের বুদ্ধি খেলে না, সে নিশ্চয়ই ভালো বই লিখিবে।’

এই সমাবেশের কবি-সাহিত্যিকেরা সাংসারিক কাজে কিন্তু মোটেও অনগ্রসর বলে মনে হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, সেজান মাহমুদের গাড়ির দরজা পাশে না খুলে ওপরের দিকে ডানার মতো উঠে গেল। দেখে আমি হতবাক। নিজের পেশায়ও তিনি খুবই সফল এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন বলেই মনে হলো। তা বলে সবাই ডানা মেলা গাড়ি নিয়ে এসেছেন, তাও বলছি না।

যা হোক, রাতে একে একে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হলো। একুশে পদকপ্রাপ্ত জ্যোতি প্রকাশ দত্ত এই ৮০ বছর বয়সেও তদারকি করার চেষ্টা করছেন। কবি রুদ্র শংকর ছুটে বেড়াচ্ছেন। সেবা লাইব্রেরির বিদগ্ধ সাহিত্যসেবী হারুন ভাই ধীর পায়ে হাঁটলেও বোঝাই যায়, তার মন

সবদিকে ছুটছে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসেছেন লেখক মোহাম্মদ ইরফান। তার মুখেই উদ্বেগের প্রকাশ বেশি।

শুনলাম, সেবা লাইব্রেরি ও পূরবী-জ্যোতি লেখক দম্পতির প্রচেষ্টাতেই মূলত এই সমাবেশ সম্ভব হয়েছে।

কানাডা থেকে এসেছেন প্রবাসী সাহিত্যিক এবং স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. হাসান মাহমুদ, এসেছেন গল্পকার সাদ কামালী। তাঁরা এই সমাবেশের পৃষ্ঠপোষক।

ওয়াশিংটন থেকে দলবেঁধে প্রবাসী সাহিত্যিকেরা এলেন, তাঁরা অবশ্য সবাই আমার পূর্ব পরিচিত এবং সুহৃদ। ভয়েস অব আমেরিকার কবি আনিস আহমেদ দীর্ঘ পথ গাড়ি চালিয়ে সস্ত্রীক পৌঁছে গেলেন। লেখক ও কবি আনোয়ার ইকবাল বিমানে এলেন। তিনিও প্রধান পৃষ্ঠপোষকদের একজন। তারপর এলেন সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানী ড. আশরাফ আহমেদ। তাঁর ভাই ডাক্তার মাহতাব আহমেদও এ বছর একটি ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশ করেছেন, সেই সুবাদে তিনিও সস্ত্রীক এলেন। চারজনের এই ভ্রাতা-বধূ পরিবার এক ঝলক দেখা দিয়ে, সবার সঙ্গে হোটেল লবিতে ছবি-টবি তুলে একটি ‘এয়ার বিঅ্যান্ডবিতে উঠলেন। ওয়াশিংটনের বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন কবি মাহবুব হাসান সালেহ। পদের মতো তাঁর উচ্চতাও বড় হওয়ায় তাঁকে দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম।

মানুষ খুব বেশি নয়, কিন্তু কমও নয়। পরদিন সকালে ভেন্যুতে যাওয়ার জন্য আমি অপেক্ষা করছি। সাদ কামালী তাঁর গাড়িতে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেন। দেখতে দেখতে ৭/৮ জন সেই গাড়ির পাশে জড়ো হয়ে গেল। মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী তাজুল ইমাম বললেন, ‘যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় ন’জন।’ সেই ভ্যানে সত্যিই সবার জায়গায় হয়ে গেল। সেখানে সিলেট নিয়ে কথা উঠল, সবাই নাকি সিলেটী ভাষা জানেন (আমি বাদে)। একজন আপাত সিলেটী বললেন, তিনি আসলে বরিশালের। তাজুল ইমাম বরিশালের ভাষায়ও কী একটা মজা করলেন। দশ মিনিটের রাস্তাটা এভাবে নানা উপভোগ্য আলাপের মধ্য দিয়ে চলে এলাম। ভেন্যু বার্কমার হাইস্কুল। বড় অডিটোরিয়াম, পাশে আরও বড় ক্যাফেটেরিয়া, তার পাশে সেমিনার রুম। ব্যবস্থা খুব ভালো।

সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো। সেখানে উদ্যোক্তারা যা বললেন তার সারমর্ম এই, প্রবাসে যাঁরা বাংলায় লিখছেন, তাঁদের অনেকেই খুব ভালো লিখছেন, যা অগ্রাহ্য করা যায় না। ‘ডায়াসপোরা’ সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা হলো। লেখক, চিকিৎসক এবং এই সমাবেশের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক শাহাব আহমেদ বললেন, দীর্ঘ প্রবাস জীবন এবং দেশ ভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কারণে, দেশের একজন লেখকের থেকে তাঁর কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। তিনি ভলগা, নায়াগ্রা আর গঙ্গাকে একই লিখায় একই সমতলে নিয়ে আসতে পারবেন।

তবে ‘ডায়াসপোরা’ সাহিত্য নিয়ে সবাই একমত হলেন না। অনেকে ‘দেশি প্রবাসী’ বলে সাহিত্যিকের বিভাজনই চান না। পূরবী বসু বললেন, তার লেখাগুলো গ্রন্থ আকারে বের করার জন্য তিনি বাছাই করছিলেন। দেখা গেল, পনেরো খণ্ডের মধ্যে চৌদ্দ খণ্ডের গল্পই দেশের প্রেক্ষাপটে লেখা। অথচ তিনি দেশ ছেড়েছেন প্রায় ৫০ বছর আগে। মূল কথা, বাংলায় মূল ধারার কবি-সাহিত্যিক যেমন দেশে আছেন, প্রবাসেও আছেন। এঁদের পরস্পরের কাজকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে, বাংলা সাহিত্য চর্চায় আরও উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসই হলো এই সাহিত্য সমাবেশ।

প্রথম দিন সকালের অংশে ছিল স্বরচিত কবিতা, তারপরেই স্বরচিত গল্প পাঠ। দ্বিতীয় দিনও একই। এর মাঝে অনেকগুলো সেমিনার হয়ে গেল।

ভেবেছিলাম গল্প শুনতে বোরিং লাগবে। কারণ গল্প খবরের মতো রিডিং পড়ার বস্তু নয়। অনেক আগে টিএসসিতে এমন আয়োজন করেছিল। সেখানে উদ্যোক্তারা একমত হয়েছিলেন, কবিতার মতো স্বরচিত গল্প পাঠ উপভোগ্য নয়। শ্রোতার ধৈর্য ধরে রাখা কঠিন হয়। কিন্তু এই আটলান্টায় সেটার ব্যতিক্রম ঘটল। গল্পগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল।

শামীম আল আমীন, যিনি একটু আগেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করলেন, তিনি গল্প লিখেছেন সম্প্রতি মেক্সিকো বর্ডারে পানিতে ডুবে যাওয়া অভিবাসন ইচ্ছুক ছোট্ট শিশুটি ও তার পরিবার নিয়ে। শুধু প্রবাস জীবন নয়, দেশ নিয়েও গল্প শোনা গেল। অচিরেই বুঝতে পারলাম, অনেক গুণী লেখক আছেন যাদের নামও হয়তো সেভাবে কেউ জানেন না।

গল্প পাঠের আসরে সঞ্চালক এবং দর্শকের কিছু মন্তব্য করার সুযোগ ছিল। পরিমিতিবোধ রেখেই দর্শক, যারা নিজেরাও সাহিত্যিক অথবা তাদের নিকটজন, একটি অংশগ্রহণমূলক গল্পের আসরই তৈরি করে ফেললেন। তাতে দুপুরের খাওয়া হলো দেরিতে, দুটার দিকে।
আমার আরও আশঙ্কা ছিল, ফেসবুকে যেমন অনেক স্বঘোষিত কবি বেরিয়েছে, এখানেও তেমন কিছু একটা হবে। আমার আশঙ্কা আবার ভুল প্রমাণিত হলো। একটা বিস্তারিত ঘটনা বলি।

আমার পাশে দুটি চেয়ার খালি ছিল। একজন পুরুষ আমার পাশের চেয়ারে এবং একজন নারী তার পাশের চেয়ারটাতে এসে বসলেন। নারীটিই আমার সঙ্গে কথা শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলেন। আমি কবিতা পড়ব, না গল্প পড়ব? পুরুষটি কিছু বলছিলেন না। আমি তাদের সম্পর্কও নির্ণয় করতে পারছিলাম না। কথায় কথায় মিশুক নারীটি জানালেন, তিনি নিজে সফটওয়্যার প্রোগ্রামার, মৃদুভাষী স্বামীটিও তেমন কিছু একটা করেন। থাকেন অস্টিনে। বাড়িতে গেস্ট রেখে তাঁরা এত দূর কবিতা পড়তে এসেছেন। ভদ্রলোকের হাতে পাঁচ-সাতটি প্রিন্ট করা পাতা দেখতে পাচ্ছি। দুজনেই চাইছেন, আমি কবিতাগুলো পড়ে মন্তব্য করি। কিন্তু আমি নিজের ওপরে ভরসা করতে পারলাম না। অন্যকে খুশি করার জন্যেও ‘ভালো হয়েছে’ বলাটা আমার জন্য দুরূহ। বোদ্ধা নই, কিন্তু নিজে খানিক লেখালেখি করি তাই যেকোনো লেখার মানটা ধরে ফেলতে পারি বলে আমার ধারণা। আমার মতো একজন অখ্যাত মানুষকে পড়তেই বা বলছে কেন, তারও মাথা মুণ্ডু কিছু বুঝলাম না।

ভাবলাম, চোখে চশমাটাই হয়তো কাজে দিয়েছে। যা হোক, কবি পত্নীর প্ররোচনায় কাগজগুলো আমাকে হাতে নিতেই হলো। এক পাতা পড়তেই অকুণ্ঠ চিত্তে বললাম ‘ভালো হয়েছে’। প্রায় সব কটি কবিতা সেখানে বসেই পড়ে ফেললাম। বুঝতে অসুবিধা হলো না, এখানে যাঁরা এসেছেন, সবাই আসলে গুণী। সবার ভেতরে সাহিত্য প্রতিভা জ্বলজ্বল করছে।

বিকেলে বই পরিচিতি অনুষ্ঠানে এত বই জমা পড়েছে যে, আয়োজকেরা বললেন, ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে বই নিয়ে কথা শেষ করতে হবে। ৪০ সেকেন্ডে তেমন কিছু বলে শেষ করা যায় না। তবে কেউই নিয়মভঙ্গ করলেন না। এর মধ্যেও অনেক বইয়ের পরিচয় পেয়ে গেলাম। শুনে অবাক হলাম, মার্কেজের ‘One Hundred Years of Solitude’ একজন বাংলায় অনুবাদ করেছেন। আনিসুজ্জামান, তিনিও একজন পৃষ্ঠপোষক। তিনি বললেন, সরাসরি স্প্যানিশ থেকেই বইটি তিনি অনুবাদ করেছেন। থাকেন সানডিয়েগোতে। মাত্র কয়েকদিন আগে সেখানে গিয়েছিলাম, পাশেই মেক্সিকোর ছোট শহর টিহুয়ানা থেকে ঘুরে এসেছি। তাতে তিনি জানালেন, আশির দশকের শেষে মেক্সিকোর টিহুয়ানার একটা মহল্লার সবাই তাঁকে একনামে চিনতেন। বুঝলাম, এত ভালো স্প্যানিশ তিনি কীভাবে শিখেছেন। এ শুধু বই পড়ে শেখা নয়, মানুষ ও মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে ভেতর থেকে একটি ভাষা শেখা।

ওদিকে ডাক্তার, লেখক ও প্রকাশক হুমায়ুন কবীর ‘ঘুঙুর’ নামের একটি বইয়ের স্টল দিয়ে বসেছেন। সেখানে বেশ কিছু সময় কাটালাম। তিনি ঘুমের ওপর যে বইটি লিখেছেন, সেটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। বাংলায় যে এমন একটি বই আছে, সে কথা আমার জানাই ছিল না। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই নাকি প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গেছে।

সন্ধ্যায় স্থানীয় শিল্পীরা গান গাইলেন। তারপর তাজুল ইমাম ও সেজান মাহমুদ নিজেদের লেখা ও সুর করা গান গাইলেন।

সেদিন রাতে ছিল একসঙ্গে তিনজনের জন্মদিন—জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, সেজান মাহমুদ ও মোহাম্মদ ইরফানের। হোটেল লবিতে রাত বারটায় কেক আনা হলো। এরই মধ্যে তাৎক্ষণিক ছড়া বানিয়ে ফেললেন কাজী জহিরুল ইসলাম, তার দেখাদেখি সেজান মাহমুদও। সেখানে যোগ দিলেন মেহের আফরোজ শাওন। তারপর চলল দীর্ঘ আড্ডা। পূরবী বসুর রুমে এই আড্ডা যখন শেষ হলো, তখন সকাল ছয়টা বাজে। গল্পে ‘না’ এবং ‘নয়’ এর ব্যবহার নিয়েই কথা হলো আধা ঘণ্টা। শেষে কে যেন বিরক্ত গলায় ছন্দ মিলিয়ে বললেন ‘না/নয় নিয়ে আলাপ আর নয়’। তাতে আড্ডা ঘুরে আরেক জায়গায় উপস্থিত হলো।

পরদিন সমান আগ্রহে অনুষ্ঠান এগিয়ে চলল। স্বরচিত কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন রুদ্র শংকর। তিনি মঞ্চে ডেকে নিলেন লুৎফর রহমান রিটন ও হাসান মাহমুদকে। বাংলা কবিতার তিনটি ছন্দ-স্বরবৃত্ত, অক্ষর বৃত্ত ও মাত্রা বৃত্ত নিয়ে তাঁরা কথা বললেন। এর মাঝে আবার লুৎফর রহমান রিটন গতানুগতিকের বাইরে চলে গেলেন। তিনি বললেন, ছন্দের সংজ্ঞা জানলেই যদি কবিতা লেখা যেত, তাহলে বাংলার সব অধ্যাপকেরা বড় বড় কবি হয়ে যেতেন। ছন্দ জেনেও কিছু হয় না, না জানলেও ক্ষতি হয় না। যারা সমাবেশে এসেছেন, তারা ছন্দের কিছু জেনেই তো এসেছেন। আরও বললেন, এসব সাহিত্য সমাবেশে লাভ হলো, অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। হারিয়ে যাওয়া পুরোনো বন্ধু ফিরে পাওয়া। যেমন, তিনি এবং শাহাব আহমেদ একই সঙ্গে ঢাকা কলেজে পড়েছেন, তারপর হারিয়ে গিয়েছিলেন কয়েক যুগের জন্য। মন্ট্রিয়েলে কোনো এক সাহিত্য সম্মেলনে তাঁদের আবার দেখা হয়ে যায়।

রিটনের আরেকটি মূল্যবান কথা হলো, সাহিত্য রচনা দলবেঁধে করা যায় না। সাহিত্য রচনা করতে হয় এককভাবে।

আমি তাঁর কথার সঙ্গে শতভাগ একমত। আপনি যদি সাহিত্য সম্মেলনে না এসে থাকেন, তাতেও আপনার সাহিত্য রচনার ক্ষমতায় এক বিন্দু কমতি হয়নি। এসে থাকলে কিছু মধুর রসাস্বাদন করেছেন মাত্র। যারা কবি-সাহিত্যিক হতে চান, প্রচুর পড়ুন ও প্রচুর লিখুন।
সারা দিন আমি এবং আমার মতো কয়েকজন সাহিত্য সমাবেশে সংগীতানুষ্ঠানের প্রাধান্যের নিকুচি করলাম। কিন্তু রোববার সন্ধ্যায় আটলান্টার স্থানীয় শিল্পী ও নিউইয়র্কের দুর্ধর্ষ যন্ত্রীরা মিলে যে অদ্ভুত সূর মূর্ছনার তৈরি করলেন, তখন আমরা আমাদের ‘নিকুচি’ তাৎক্ষণিক ফিরিয়ে নিলাম। শেষে গাইলেন মেহের আফরোজ শাওন। তাতে যেন সাহিত্য সমাবেশের ষোলোকলা পূর্ণ হলো।

কিন্তু হোটেলে ফিরে বুঝলাম, এই সমাবেশ ষোলোকলার নয়, আঠারো কলার। রাত বাজে সাড়ে বারটা। সবাই লবিতে এসে উপস্থিত। কিছু একটা করতে হবে। কারও মধ্যেই যেন নিদ্রা-ক্লান্তি নেই। এই যে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত আশিতে পা দিলেন, তিনিও ঠায় বসে আছেন। কিছু একটা করো, শুনি।

শেষে একটি করে গান, একটি করে কবিতা, এভাবে চলতে থাকল। সুললিত গলায় শাওন, মনিকা আর শামা অনেক গান গাইলেন, তার ফাঁকে ফাঁকে উপস্থিত কবিরা একটি করে কবিতা পড়লেন। শেষ অনুরোধ করলেন পূরবী বসু, ‘আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি...’—এই গানটা শুনবেন তিনি।

না, তাতেও শেষ হয়নি। কার অনুরোধে যেন সেজান মাহমুদ নিজের লেখা একটি সুন্দর মারফতি টাইপের গান গাইলেন। তাতে ‘লাঠি খেলা শেষ হইলো না’ কথাটি বারবার আসছিল। সেই লাঠি খেলা মানে কী, কেউ বলতে পারল না। রচয়িতা নিজে বলতে রাজি হলেন না। এই যে লাঠি খেলার মানে না জেনেই সবাই অংশি; সে খেলার আবার শেষও নেই, সেখানেই তো জীবনের দারুণ দুর্বোধ্যতা!

না, সেখানেও শেষ হলো না। এই সমাবেশ আসলে চলতেই থাকবে। সেই গুরুভার নিজ কাঁধে নিয়েছেন আনিসুজ্জামান, যিনি সরাসরি স্প্যানিশ থেকে বাংলায় একটি বিখ্যাত বই অনুবাদ করেছেন। আগামী বছর সানডিয়েগোতে এই বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ হতে যাচ্ছে বলে আয়োজকেরা ঘোষণা দিয়েছেন। এতই ভালো লাগল যে, সর্বান্তকরণে সেখানেও যাওয়ার ইচ্ছা রাখি।