এক দিনে তিন দেশ ভ্রমণ

(প্রথম পর্ব)

জুল ভার্ন বিশ্বভ্রমণ করেছিলেন ৮০ দিনে, শুনলেই গা কেমন জানি শিউরে উঠত সেই কিশোর বয়সে; প্রথম যখন পড়েছিলাম। আসলে জুল ভার্ন কাগজে কলমেই ঘুরে এসেছিলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। প্রকৃত অর্থে তিনি কখনো ফ্রান্সের বাইরে কোনো দেশেই যাননি।
সেই শৈশব থেকেই মনে মনে ইবনে বতুতা কিংবা মার্কো পলোর মতো দেশ–বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর শখ ছিল প্রকট। বিলাতে স্থায়ীভাবে অভিবাসনের আগে কেবল বাংলাদেশেই বসবাস করেছি মোট ২৪টি স্থানে, ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়তে সর্বসাকল্যে মোট ১৪টি স্কুলে পড়াশোনা করেছি।
অবচেতন মনে কখন যে বিশ্ব ঘুরে বেড়ানোর ভাবনা মনে এসেছে, আজ অবধি বুঝতেই পারিনি। আর সে জন্যই মনে হয়, ভ্রমণের কোনো সুযোগ পেলে তা আর সহজে হাতছাড়া না করেই বিদেশ ঘোরার জন্য হারিয়ে যাই এই একবিংশ শতাব্দীর নব্যপর্যটক মার্কো পলো অথবা ইবনে বতুতার মতো। ঠিক এমনিভাবেই ১৩ আগস্ট হারিয়ে গিয়েছিলাম জীবনের সব কোলাহল, নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্ম ফেলে সন্তর্পণে চলে গেলাম এক সপ্তাহের জন্য—গন্তব্য সেই জগৎ বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পলোর শহর ইতালির ভেনিস।
সেই ছোট শিশু বেলা থেকেই মা আর বাবার মুখে শুনেছি, প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে পরিচিত আমাদের দেশের বরিশাল নগরীর কথা, এই শহরে প্রথম গিয়েছিলাম স্কুলে পড়ার সময়ে স্কাউট ক্যাম্পিংয়ে পটুয়াখালী যাওয়ার পথে সেই ১৯৭৬-৭৭ সালে। স্কাউট টিমের ট্রুপ লিডার থাকাতে বরিশাল শহরের সঙ্গে ভেনিস শহরের মানসিক সেলুলয়েডগুলো প্রতিস্থাপন করার সুযোগ আর সেদিন হয়নি কাজের চাপে। ওই খাল, নদী, হ্রদ, সাগরের উপহ্রদ (লেগুন), গোনডোলা সমৃদ্ধ ভেনিস শহর পানির ওপর দাঁড়িয়ে আছে মনের পর্দায় সেই অনাবিষ্কৃত কৌতূহল হয়ে আজ প্রায় ৫৮ বছর যাবৎ।
১৯৮৬ সালে শরতের এক সন্ধ্যায় পরিচিত হয়েছিলাম একজন তরুণের সঙ্গে। বেশ কিছু দিন পর তাকে প্ররোচিত করে চোরা শিকার করে নিয়ে আসলাম আমার কর্মক্ষেত্রে অনেক পটিয়ে এবং এও বলেছিলাম, আমার এখানে আসলে বিদেশ ভ্রমণেরও সুযোগ আসতে পারে ভবিষ্যতে। তারপর ক্রমে ক্রমে আমরা পরিণত হলাম বন্ধুতে। তখনো মাইক্রোসফটের উইন্ডোর যুগ আসেনি, ডস বেইসেড কম্পিউটার মাত্র ১৪০ মেগা বাইট মেমোরি একটা ফ্যাক্স বা চিঠি টাইপ করতে গেলে সারা দিন চলে যেত। তাই বিদেশি প্রিন্সিপাল, বায়ার, এজেন্সি ধরতে হলে হাত দিয়ে বা ইলেকট্রিক আইবিএম টাইপ রাইটারে ছিল শ্রেষ্ঠ সম্পদ। সারা দিন হাত দিয়ে লিখে ফ্যাক্স করেই কেটে যেত ওর সারা দিন, মাথা গুঁজে কাজ করেই যেত। মাথা গুঁজে কাজ করতে লাগল ফ্রেডি-ফ্রেডরিক ডি কস্টা তেজগাঁও হোলি রোসারি রোমান ক্যাথলিক চার্চের পাদরি ফাদার গোমেজ ডি কস্টার ছোট ছেলে ফ্রেডি। ১৬৭৭ সালে এই গির্জায় ওরা ছয় পুরুষ (জেনারেশন) যাবৎ পাদরির দায়িত্ব পালন করে আসছে। ঢাকার এলিট সোসাইটির একটি বর্ধিঞ্চু পরিবার। স্কয়ার ফার্মা, ঢাকার আর্চ বিশপ থেকে শুরু করে বঙ্গভবন—সব জায়গায় আমন্ত্রণ পায় ওরা। গ্রামের বাড়ি বালু নদীর তীরে কালিয়াকৈরে।
একদিন কথায় কথায় সে আমাকে বলল, সে আসলে একজন এগ্নোস্টিক (অজ্ঞানবাদী) অর্থাৎ সে ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে সন্দেহ প্রবণ এবং ধর্ম পালনে তেমন আগ্রহী নয়। ওর এই ধরনের খোলামেলা কথায় আমি ওর ব্যাপারে আরও কেমন জানি আগ্রহী হলাম। বন্ধুত্ব গাঁড় থেকে আর গাঁড় হয়ে গেল ক্রমে ক্রমে। আমাদের দুজনের একটা মিল খুঁজে পেলাম, সেও আমার মতো পর্যটক হতে চায়। সারা জীবন অবিবাহিত একাকী থাকার তার বাসনা।
আমাদের ইতালিয়ান কোম্পানির ক্রেতা মারথা বিয়াঙ্কা। বাংলাদেশে তাঁর প্রথম আসার পর ফ্রেডিসহ আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। মারথা যখন জানতে পারল, ফ্রেড ও রোমান ক্যাথলিক তখন ওর আমাদের ওপর আরও কেমন জানি আস্থা বেড়ে গেল। ফ্রেড যখন বলতে লাগল প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাস, ক্লিওপেট্রা, মার্ক অ্যান্থনি, জুলিয়াস সিজার, অগাস্টাস, কনস্টান্টিনোপলের সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন, বিযেন্টাইন এবং অটোমানের ইতিহাস—মারথা এসব একজন বিদেশির মুখে শুনে হতভম্ব, বিহ্বল ও স্তম্ভিত। ফ্রেডির দিকে ওর চোখের মায়াবী চাহনি দেখেই বুঝে ফেললাম কেল্লা ফতে। মারথা আর ফ্রেডি এখন দুই দুইটি কন্যার মাতা–পিতা। সেই ফ্রেডির আমন্ত্রণে আজ আমি ইতালির ভেনিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি। ত্রিশ বছর পর ওর সঙ্গে দেখা হবে আবার। ত্রিশ বছরের জমে থাকা কত কথা।
ইজি জেটে দুই ঘণ্টার ফ্লাইট লুটন (ইংল্যান্ড) থেকে। ফাতিমা সব গুছিয়ে দিল ব্যাগে। ঘাড়ে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঢুকলাম বিমানবন্দরে। বোর্ডিং কার্ড অনলাইনে চেক করে নিয়েছিলাম আগেই। সোজা সিকিউরিটি চেক করে ঢুকে পড়লাম স্টারবাকসে। সেখানে বসে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর লেখা একটা বই পড়তে শুরু করলাম। পড়তে পড়তে ফ্লাইট প্রায় মিস করেই ফেলেছিলাম।বইটির ওপর একটি রিভিউ লিখব ভেবে পড়ছিলাম। আর গুরুত্বপূর্ণ লাইনগুলো হাইলাইট করতে গিয়ে কখন যে ফ্লাইটের গেট বন্ধ করে দিয়েছিল, তা একেবারে খেয়াল করিনি। হঠাৎ দেখেই দিলাম দৌড়, আধা বন্ধ গেট টেনে ধরে ঢুকে পড়লাম।
দুই ঘণ্টা বই পড়তে পড়তে চলে গেল, মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বিশাল সাগর, আর একটা দ্বীপের মতো জায়গা। প্লেন অবতরণের পর ফ্রেডি ফোনে যে বাসের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছিল, সেটি স্ক্যান করেই বাসে উঠে বসলাম। মার্কো পলো এয়ারপোর্ট থেকে ভেনিস শহরের প্রধান বাস স্টপে যেতে হবে, সেখানে ফ্রেডি আমার জন্য অপেক্ষা করবে। নীল আকাশ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তা–ঘাট। ঘড়ির কাটায় কাটায় বাস ছাড়ল, বাসের এসিতেও গরম উপলব্ধি করলাম। ইংল্যান্ডে সকালে ৫-৬ ডিগ্রি। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে বের হয়েছি। এখানে ৩২-৩৪ ডিগ্রি গরম, প্রচণ্ড রোদ। ঘামতে শুরু করেছি অনেক দিন পর। ২০ মিনিটেই ভেনিসে পৌঁছে গেলাম, রাস্তার দুই পাশের অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের উপহ্রদ (লেগুন) আর স্পিড বোট, প্রমোদ তরী আর পাল তোলা ডিঙিতে এমেচার নৌকা চালকেরা সাগরের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। ওই গভীর সমুদ্রে একা একা মেয়েরে শালতি (ডোঙা) এক কাঠের দুই পাশে বইঠাটা দিয়ে বামে ডানে বইঠা চালিয়ে এগিয়ে চলেছে সেই দিগন্তের দিকে। নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি সাগরের পানিতে পড়েছে এমনভাবে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন, এই মাত্র কোনো শিল্পী আপন মনে বসে বসে মোটা তুলি দিয়ে নীল রং দিয়ে জলরাশিকে পেন্ট করে চলে গেছে। সূর্যের কিরণের বিচ্ছুরণ ঢেউয়ে ঢেউয়ে আলোর প্রতিফলিত রশ্মি বিকিরণ করছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো রমণী তার আঁচলটি বিছিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে অপেক্ষা করছে তার পরদেশি নাবিক প্রেমিকের জন্য।
বাসের জানালা দিয়ে বামে আর ডানে তাকিয়ে অপরূপ উপহ্রদের দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে চলে আসলাম ভেনিসে বুঝতেই পারিনি। বাসটা থামল। চারদিকে তাকিয়ে খুঁজলাম ফ্রেডিকে, অনেক দুরে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে হাফ পেন্ট পরা মাঝ বয়সী এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে ক্যাপের উপরে সানগ্লাসটা রাখা। ৩০ বছর পর একটু থমকে গিয়ে ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে নামলাম আর দেখলাম, ফ্রেডি আমাকে চিনতে পেরে এগিয়ে আসছে, মুখে ৩২টি দন্ত বিকশিত সেই পুরোনো হাসি। একে অপরকে জড়িয়ে ধরলাম-বুকে ধরে রাখলাম অনেকক্ষণ। ৩০ বছরে প্রচুর বদলে গেছি আমরা দুজনই। ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়েই হাঁটতে থাকলাম ভেনিসে বাস স্টপের পাশেই অদূরে ভেনিস রেলওয়ে স্টেশনের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে কথা, কুশল বিনিময় হলো। পরিবার নিয়ে কথা হল। স্টেশনে এসে দুটি টিকিট কিনল তাঁর শহর পরডেনোনে যাওয়ার জন্য। রাত ১২টার ট্রেনে যাব আমরা; প্রায় ১ ঘণ্টার জার্নি।
কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ার আগেই হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখতে চাই ভেনিস শহরটাকে। স্বপ্নের শহর ভেনিস। ইতালিতে এর আগে চার চার বার গিয়েছি। কিন্তু উত্তর ইতালিতে আসা হয়নি একবারও। ফাতেমা হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অবতার।
(চলবে)