যেন এক যাযাবর

‘ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে, তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে।’ এটা ইবনে বতুতার উক্তি। আমারও এখন শুধু গল্প বলতে ইচ্ছে করছে। এই যেমন এখন আমস্টারডামের গল্প মনে পড়ছে। সকাল সকাল পৌঁছেছিলাম আমস্টারডামে। ট্রাম ও ট্রেনে করে। ট্রামে ওঠার সময় একদিনের জন্য করা ট্রায়াল কার্ড দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। আবার নামার সময়ও কার্ড পাঞ্চ করতে হয়। তারা হিসাব রাখে কে কত মাইল ভ্রমণ করছে। আমরা প্রথম অ্যানা ফ্রাঙ্কের বাড়ি যাই, যা এখন একটি মিউজিয়াম।


মানবতার দর্শনে পরিপূর্ণভাবে সুন্দরকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে কিশোরী নিজেকে উৎসর্গ করেছিল, তার জুড়ি তো এই যুগেও মেলা ভার। জার্মানির হিটলারের নিষ্ঠুরতার শিকার সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ১৩ বছরের অ্যানা ফ্রাঙ্কের বর্ণনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা তার ডায়েরি, যা একই সঙ্গে বেদনা ও যাতনার ইতিহাসে ভরা। ক্লাস সিক্সে থাকতে অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি পড়তে পড়তে জেনেছিলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ এক মেয়ের দিনরাত্রির কথা। অ্যানা ফ্রাঙ্ক জন্মসূত্রে একজন জার্মান। কিন্তু তিনি তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় অর্থাৎ চৌদ্দ বছরের জীবনের দশ বছর নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে কাটিয়েছেন। অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি শাসনের গোড়ার দিকে অ্যানার বাবা অটো ফ্রাঙ্ক, যিনি একজন জার্মান ব্যবসায়ী, তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে আমস্টারডামে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে সাড়ে চার বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে অ্যানা নেদারল্যান্ডসে চলে আসেন। নাৎসিরা যখন জার্মানির ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছিলে, তখন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে জন্মগ্রহণকারী একজন জার্মান নাগরিক হয়েও তিনি ১৯৪১ সালে তাঁর নাগরিকত্ব হারিয়েছিলেন। এক কথায় রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। ১৯৪০ সালের মে মাসের মধ্যে জার্মানরা যখন নেদারল্যান্ডস দখল করে, ফ্রাঙ্ক পরিবার তখন আমস্টারডামে আটকা পড়ে। ১৯৪১ সালে জার্মান বাহিনী নেদারল্যান্ডস দখলের পর অ্যানাকে একটি পাবলিক স্কুল থেকে ইহুদি স্কুলে স্থানান্তর করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ১৯৪২ সালের ১২ জুন তিনি তাঁর ১৩তম জন্মদিনের জন্য একটি লাল-সাদা প্লেড ডায়েরি উপহার পান। তাঁর মধ্যে তিনি প্রতি দিন জার্মান নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনি লিপিবদ্ধ করছিলেন। তাঁদের গ্রেপ্তারের পরে ফ্রাঙ্কদের শিবিরে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল।

১৯৪২ সালের জুলাই মাসে ইহুদি জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যানার বাবা অটো ফ্রাঙ্ক যে ভবনে কাজ করতেন, সেখানে একটি গোপন কক্ষে বইয়ের তাকের আড়ালে তাঁরা লুকিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালের আগস্টে গেস্টাপো বাহিনীর দ্বারা পুরো পরিবার গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনি জন্মদিনে উপহার পাওয়া এই ডায়েরি নিয়মিত লিখে যাচ্ছিলেন। ১৯৪৪ সালের অক্টোবর বা নভেম্বরে অ্যানা ও তাঁর বোন মার্গোটকে আউশভিটস থেকে বার্গেন-বেলসেন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেই কয়েক মাস পর তাঁরা মারা যান; সম্ভবত টাইফাস নামক রোগের কারণে। এগুলো পরে রেড ক্রস কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়।

বন্দী থাকার সময় অ্যানা তাঁর ডায়েরিতে ডাচ ভাষায় লিখেছিলেন ব্যক্তিগত সবকিছু। আটকের ভয়ে ভয়ে লুকিয়ে থাকাতে প্রতি দিনের জীবনযাত্রার কথা বর্ণনা করেন তিনি। তিনি সাধারণত কিশোর বয়সী বিষয়গুলোর পাশাপাশি ভবিষ্যতের জন্য তাঁর আশা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, যেখানে ছিল সাংবাদিক বা লেখক হওয়ার ইচ্ছার কথাও। অ্যানার ডায়েরি ১৯৪৪ সালের ১ আগস্টে শেষ লেখা হয়েছিল। পরিবারের একমাত্র বেঁচে যাওয়া সদস্য বাবা অটো ফ্রাঙ্ক পরে অ্যানার ডায়েরির খোঁজ পান। তিনি যুদ্ধবন্দী মানুষের বিষণ্ন পৃথিবীর খোঁজ জানান স্বয়ং পৃথিবীকেই। ডাচ ভাষায় লেখা এই ডায়েরি ইংরেজি ভাষায় প্রথম অনূদিত হয়ে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। অ্যানা ফ্রাঙ্কের বাড়ির দেয়ালগুলো ছুঁয়ে দেখা ছাড়া চিলেকোঠার জানালা দিয়ে আকাশ দেখা হয়নি আমার। বোট ট্যুর কর্তৃপক্ষ সেই ব্যবস্থা রাখেনি।

শুধু ভ্যান গঘের শিল্পকর্ম দেখতেই আমস্টারডামে অসংখ্য পর্যটক আসে। জীবদ্দশায় ভ্যান গঘের মাত্র একটা শিল্পকর্ম বিক্রি হয়েছিল। হতাশা ও অর্থকষ্ট মিলে বিষিয়ে তুলেছিল জীবন। সে জন্য ৩৭ বছর বয়সে এসে তাঁকে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মৃত্যুর পর তাঁর সৃষ্টি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে আজ অবধি। মানুষের পরাজয়ের অনুভূতি বড় তীব্র।

আবার ঝাঁক বেঁধে সাইকেল স্ট্যান্ডে বা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য সাইকেল। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সাইকেলে করে সারা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই দেশে মানুষের চেয়ে সাইকেলের সংখ্যা বেশি। আশপাশের কড়া ট্রাফিক আইনের দেশগুলোর মতো এ দেশকে মনে হয়নি আমার। বরং মনে হয়েছে নিয়মগুলো ট্রাফিক লাইটগুলোর মতোই একবার জ্বলছে, একবার নিভছে। মানুষের ইচ্ছে হলে মেনে নিচ্ছে, ইচ্ছে না হলে নিজের ধ্যান ধারণা খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোন পথে চলবে।

আমস্টারডামকে কী নাম দেওয়া উচিত? দ্য সিটি অব হারবার, নাকি সাইকেলের শহর, না খালবিলের শহর? নাকি টিউলিপের শহর? গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেকটা অবস্থাপন্ন বাসাবাড়ির সামনে নিজস্ব পুকুর, ঘাটে মতো এদের আছে খাল। বন্যার প্রকোপ ঠেকাতে আমস্টেল নদীতে বাঁধ দিয়ে স্থানীয় জনগণ আমস্টারডাম শহর বানিয়ে ফেলেছিল। আর আমস্টেল নদীর শাখা প্রশাখা থেকে খালগুলোর শুরু। মোট এক শ কিলোমিটারের মতো ১৬৫টি ছোট-বড় খাল বানানো হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। খালগুলোর ওপর হাজারের বেশি ছোট ছোট সেতু থাকায়, মনে হয় আমরা সমন্বিত দ্বীপের শহরে এসেছি। এখানে ওরা খালকে বলে গ্রাখট। গ্রাখটের প্লুরাল গ্রাখটেন। গ্রাখটেনের ওপর প্রাচীন কতগুলো সেতু। সেতুর ওপর রং বেরঙের তালা পাওয়া যাবে। এই রঙিন তালা সাধারণত নিজেদের ভাব-ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে ঝোলানো হয়। কখনো কখনো ভাব-ভালোবাসা মিলিয়ে গেলেও তালাগুলো চিহ্ন হয়ে সেতুতে রয়ে যায়।

অ্যানা ফ্রাঙ্কের বাড়ির পাশ থেকে বোট ট্রিপে উঠলাম আধা খোলা বোটে। সাদা পোশাকের নাবিক আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা পছন্দসই জায়গায় বসলাম। মাইক্রোফোনে বাজছিল একের পর এক স্থাপনার বর্ণনা।

ইউরোপের এই শহরে মারিজুয়ানা (গাঁজা) ফ্রি। আর রেডলাইট ডিস্ট্রিক্টের হাতছানির কারণে যুবকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় একটি শহর এটি। দারুণ হ্যান্ডসাম সব যুবকের দল পৃথিবীর নানা দেশ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়িয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেডলাইট ডিস্ট্রিক্টে ঢুঁ মারার সাহস করেই ফেললাম শেষ পর্যন্ত। যদিও আমার সঙ্গে আমার মেয়ে ও ভাতিজি রয়েছে। তুমুল গাঁজার গন্ধে মাতাল লালচে আলোর এক নিষিদ্ধ জগৎ। মনে হলো, আমি কোনো মুভি দেখছি। হেঁটে হেঁটে ধোঁয়ার জগৎ পার হলাম। বইয়ে পড়া কিংবা মুভি বা প্রামাণ্যচিত্রে দেখা কিছু সেক্স টয় স্টোর, সেক্স শপ, হুক্কা বার, জীবন্ত মেয়ে কীভাবে সেজে গুঁজে নিজেকে খদ্দেরের কাছে পণ্য করে তোলে, তা দেখলাম ঘুরে ঘুরে। বিস্ময় কাটবার আগেই আমরা আবার ভ্যান গঘ মিউজিয়ামের পাশে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে এসে বসলাম। পানিতে পা ডুবিয়ে অস্তগামী সূর্য দেখছিলাম। চাঁদ উঠল। আমার মন বড় চঞ্চল। পৃথিবী কী বিচিত্র! আমি পৃথিবীর একপ্রান্তে নীল পাহাড়ের পাশে জন্ম নেওয়া মেয়ে। বাস করি পৃথিবীর রাজধানী খ্যাত নিউইয়র্কে। আবার ইউরোপের অন্যতম পর্যটন নগরী আমস্টারডামে ভ্যান গঘের মিউজিয়ামের পাশে আজ বসে আছি। মনের কোণে

ভূপেন হাজারিকার গান বাজছে—
‘আমি ইলোরার থেকে রং নিয়ে
দূর শিকাগো শহরে গিয়েছি
গালিবের শের তাসখন্দের
মিনারে বসে শুনেছি।’

অবশেষে এই গান গুনগুন করতে করতে বাসায় ফিরলাম। প্রচুর হেঁটেছি সারা দিন। তাই ক্ষুধার্ত ছিলাম। যদিও দুপুরে খেয়েছি ফ্রায়েড রাইস, বাকলাভা ও চুরশ। বাসায় ডিনারে সোহরাবের (ভাতিজি জামাই) রান্না করা পোয়া মাছ, চিংড়ি, সবজি ও ঘন ডাল অমৃতের মতো লাগল। মনে হলো, এই যাযাবর জীবন মন্দ তো না!