যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি কূটনীতিকদের পদত্যাগ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন তুঙ্গে, তখন বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি কূটনীতিকেরা নীরবে বসে থাকতে পারেননি। বিভিন্ন দেশের পাকিস্তানি মিশন থেকে তারা পদত্যাগ করেন এবং বিদেশে বাংলাদেশের সপক্ষে জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

আমেরিকায় ৪ আগস্ট ১৪ জন বাঙালি কূটনীতিক একযোগে পাকিস্তান দূতাবাস এবং জাতিসংঘ মিশন থেকে পদত্যাগ করেন। নিউইয়র্ক টাইমস ওয়াশিংটন থেকে পাওয়া এই সংবাদটি তাদের ৫ আগস্ট সংখ্যায় গুরুত্বের সঙ্গে ছাপে যার শিরোনাম ছিল, ‘আমেরিকায় পাকিস্তানি মিশন থেকে ১৪ পদত্যাগ। বাঙালিরা ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনছে—কিছু আশ্রয়ের অনুরোধ’ [14 Pakistanis quit at mission in U.S.—Bengalis charge crimes by Yahya government— some request asylum]
সংক্ষেপে সংবাদটি ছিল—

১৪ জন পাকিস্তানি কূটনীতিক যাদের সবারই পরিচয় বাঙালি, তারা আজ তাদের দূতাবাস ও জাতিসংঘ মিশন থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ভাষায় ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের’ অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেছেন।

আমেরিকার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাচারালাইজেশন সার্ভিসের একজন মুখপাত্র জানান, পাকিস্তানের কূটনীতিক যারা পদত্যাগ করেছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন। মুখপাত্র বলেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টকে (পররাষ্ট্র দপ্তর) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কূটনীতিকদের ব্যক্তিগত উপাত্ত সংগ্রহের জন্য বলা হবে। যদিও স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন, তবুও আভাষ পাওয়া গেছে বাঙালি কূটনীতিক যাদের বিষয়ে কংগ্রেসের দৃঢ় সমর্থন আছে, তাদের বিষয়ে বিবেচনা করা হবে।

এই দলের নেতা এবং পাকিস্তান দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর এ এম এ মুহিত ওয়াশিংটন জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা মনে করেন, তারা আর চুপ করে থাকতে পারেন না যখন পাকিস্তান সরকার, ‘সভ্য আচরণের প্রাথমিক নিয়ম লঙ্ঘন করে মানবতারবিরোধী অপরাধ’ সংঘটিত করছে।

এই গ্রুপ তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে ‘বাংলা দেশ সরকার’ অথবা ‘বাঙালি জাতি’ ঘোষণা করেন। প্রতিনিধিরা বলেন, এটি হলো বাঙালি জাতির ‘আশা এবং আকাঙ্ক্ষা’ যারা আগে ছিলেন পাকিস্তানের অধিবাসী।

গত মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি দমাতে মাঠে নামে। এই আন্দোলনের নেতারা পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এখন পূর্বাঞ্চলের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত এবং তিন দিকে ভারতের সীমান্ত বেষ্টিত, যেখানে ৭ কোটি ২০ লাখ লোকের বাস যাদের বেশির ভাগই বাঙালি। পশ্চিম পাকিস্তানে সাড়ে ৫ কোটি লোকের বাস এবং তাদের বেশির ভাগই হলো পাঞ্জাবি ও পাঠান।
এই পদত্যাগের ফলে পাকিস্তানি দূতাবাসের লোকবল অর্ধেকে নেমে এসেছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টে তালিকাভুক্ত ১০ জন অসামরিক কর্মকর্তার মধ্যে ছয়জনই পদত্যাগ করেছেন।

নৃশংসতার অভিযোগ

এ এম এ মুহিত ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতার শিকার, তারা গ্রামগুলোতে আগুন দিচ্ছে, নারীদের অপহরণ এবং ধর্ষণ করছে, যুবকদের বেয়নেটের খোঁচায় রক্তাক্ত করে ও হত্যা করছে। মুহিত আরও বলেন, ‘তারা শুধু সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেনি, প্রতিদিন তার মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। এমনকি ইয়াহিয়া ক্ষুধার্ত বাঙালিদের খাদ্য সরবরাহ দিতেও বাধা দিচ্ছে।’

যে সব কূটনীতিক আজ পদত্যাগ করেছেন, তাঁরা হলেন—জাতিসংঘের সহকারী স্থায়ী প্রতিনিধি এস এ করিম; দূতাবাসের একজন মিনিস্টার, ই করিম যিনি অসুস্থ বলে জানা গেছে ; শিক্ষা কনস্যুলার এ এস এস কিবরিয়া; দূতাবাসের অর্থ ও হিসাব কর্মকর্তা এ আর চৌধুরী এবং থার্ড সেক্রেটারি এস এম আলী।

পদত্যাগী কর্মকর্তারা গতকাল হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভে পাকিস্তান ও গ্রিসে সাহায্য স্থগিতের বিল পাশ হওয়ায় উল্লসিত।

পদত্যাগকারীরা ‘এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে কোনো রকম অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য দেওয়া প্রশ্নই আসে না, এই রকম সাহায্য শুধু গণহত্যায় উৎসাহই জোগাবে’ বলে মন্তব্য করেন।

কূটনীতিকদের সংবাদ সম্মেলনের এক ঘণ্টার মধ্যই প্রেসিডেন্ট নিক্সন সেক্রেটারি অফ স্টেট উইলিয়াম পি রজার্স এবং তার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি এ কিসিঞ্জারের সঙ্গে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধে হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভের সমালোচনা করেন। এটি এখন পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য সিনেটে যাবে।

প্রেসিডেন্ট নিক্সন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তানে সাহায্য স্থগিত পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। এর ফলে পাকিস্তানের জাতিসংঘের সঙ্গে কাজ বিঘ্নিত হবে ‘পাকিস্তান আভাস দিয়েছিল তারা খাদ্য সহায়তা বিতরণে ইচ্ছুক’।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখার কথা বলেন। নিক্সন ঘোষণা করেন, আগামী সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশনার প্রিন্স সদুরুদ্দিন আগা খান এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। কংগ্রেস ও সর্বসাধারণের

পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের সামরিক ব্যবস্থার নিন্দার বিষয়টি তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমরা এই বিষয়ে প্রকাশ্য কিছু বলতে চাই না, এটা সম্পূর্ণভাবে হিতে বিপরীত হবে। এই বিষয়ে আমরা ব্যক্তিগত মাধ্যমে আলোচনা করব।’

হোয়াইট হাউস সূত্র জানায়, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সংবাদ সম্মেলনে ‘পশ্চিম পাকিস্তান সরকার’ বলা আমেরিকা কর্তৃক পাকিস্তানে দুইটি রাজনৈতিক সত্তার স্বীকৃতি নয়।

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]