আপনার বিছানা গোছান

বেসিল SEAL ট্রেনিং বা প্রশিক্ষণের সেনানিবাস প্রশান্ত মহাসাগরের প্রায় ১০০ গজ নিকটবর্তী ক্যালিফোর্নিয়ার করোনাডো সমুদ্র সৈকতে অবস্থিত তিন তলা বিশিষ্ট একটি অদ্ভুত ভবন। ভবনটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত না থাকায় রাতে জানালা খুলে আপনি জোয়ার-ভাটার ও সমুদ্রতরঙ্গের ফেনা বালুর ওপর ছড়িয়ে পড়ার শব্দ শুনতে পারবেন।

সেনানিবাসের কক্ষগুলো অমসৃণ খসখসে। অফিসারের কক্ষ; যে কক্ষে আমি আরও তিনজন সহপাঠীর সঙ্গে ঘুমাতাম, সেই কক্ষে চারটি বিছানা আর ইউনিফর্ম ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা ছাড়া কিছুই ছিল না। সেই সেনানিবাসে ভোরবেলা আমাকে আমার নেভির তাক গুছিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিছানা গোছাতে হতো। এটা ছিল দিনের সর্বপ্রথম কাজ। আমি জানতাম, আমার দিন আমার SEAL ইনস্ট্রাক্টরদের ইউনিফর্ম পরিদর্শন, দীর্ঘ সাঁতার, লম্বা দৌড়, প্রতিবন্ধকতার পথ এবং একটানা হয়রানিতে ভরপুর থাকবে।

‘মনোযোগ দিয়ে শুনুন’ বলে চিৎকার করে আমাদের দলনেতা লেফটেন্যান্ট গ্রেড ডেন ল স্টিউয়ার্ড ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে আমাদের কক্ষে প্রবেশ করলেন। যেহেতু একজন প্রধান কর্মকর্তা আমার দিকে আসছিলেন, আমি ঝট করে দু-পায়ের গোড়ালি এক করে বিছানার পায়ের কাছে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। সেই কঠোর ও আবেগহীন ইনস্ট্রাক্টর আমার নীল ইউনিফর্মের আট পার্শ্ব যুক্ত, খাস্তা ও সঠিকভাবে বাঁধা নিশ্চিত করতে মাথা থেকে পরিদর্শন শুরু করলেন। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রতি ইঞ্চিতে তিনি তাঁর চোখ দিয়ে ভালোভাবে দেখলেন। জামা থেকে ট্রাউজার পর্যন্ত কি ভাঁজগুলো সমানভাবে আছে? কোমরের বেল্টের পিতল ব্রেস কি আয়নার মতো উজ্জ্বল ও ঝলঝল করছে? আমার জুতা কি এমনভাবে পালিশ করা আছে যে, তিনি তাঁর আঙুলগুলো প্রতিচ্ছবিতে দেখতে পারছেন? SEAL ট্রেনিংয়ের শিক্ষানবিশের সেই উচ্চ মান চেক করার পর তিনি আমার বিছানা পরিদর্শন করতে গেলেন।

বিছানাটি সেই কক্ষের মতোই সাধারণ ছিল; শুধু একটি স্টিলের ফ্রেম ও একটি তোশক। নিচে একটা চাদর দিয়ে সেই তোশক মোড়ানো এবং ওপরে আর একটি বিছানা চাদর। সেন ডিগো শহরের সন্ধ্যার ঠান্ডায় একটু ওম পেতে তোশকের নিচে ধূসর বর্ণের একটি ভাঁজ করা কম্বল শক্ত করে বাঁধা ছিল।

বিছানার পায়ের দিকে চতুর্ভুজ আকারে দ্বিতীয় একটি কম্বল কৌশলে ভাঁজ করা ছিল। লাইটহাউস ফর দি ব্লাইন্ড নামক কোম্পানিতে তৈরি একটি বালিশ মাথার দিকে মাঝখানে ও পেছনের কম্বলের সঙ্গে ৯০ ডিগ্রি করে রাখা ছিল। এটাই ছিল স্ট্যান্ডার্ড। পুরোপুরি এই নিয়মের সামান্য বিচ্যুতি হলে সেটা বড় ধরনের ভুল ধরে নেওয়া হতো এবং সে জন্য সমুদ্র সৈকতে যতক্ষণ না পর্যন্ত মাথা থেকে পা পর্যন্ত বালুতে না ভরে, ততক্ষণ পর্যন্ত গড়াগড়ি করানো হতো; যাকে ‘সুগার কুকি’ বলা হতো।

স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে চোখের কোন দিয়ে আমি আমার ইনস্ট্রাক্টরকে দেখতে পারছিলাম। তিনি ক্লান্তভাবে আমার বিছানার দিকে তাকালেন। বিছানার কোনা ভাঁজ করে তিনি আমর কম্বল ও বালিশ সঠিকভাবে সমান করা আছে কি না, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখলেন। তখন পকেট থেকে একটা কোয়ার্টার (কয়েন) বের করে কয়েকবার টুসকি মারলেন। এটা আমাকে বোঝানোর জন্য যে, বিছানার চূড়ান্ত পরিদর্শন আসছে। সব শেষে কয়েনটি ওপরে টুসকি মেরে তোশকের ওপর ফেললেন এবং এটি হালকা বাউন্স দিল। এটা কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ বাউন্স দিল যে তিনি তা ধরে ফেলার জন্য পর্যাপ্ত ছিল।

হেলেদুলে আমার দিকে মুখ করে ইনস্ট্রাক্টর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন। তিনি কোন কথা বললেন না। সঠিকভাবে বিছানা গোছানোতে প্রশংসা পাওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। এটা আমার কাছে প্রত্যাশিত ছিল। এটা আমার দিনের প্রথম কাজ ছিল এবং ভালোভাবে এটা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটা আমার নিয়মানুবর্তিতার প্রদর্শন। এটা আমার বিস্তারিত মনোযোগ দেখাল এবং দিন শেষে এটি আমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার মতো একটি জিনিস হতো যে, আমি কিছু একটা ভালোভাবে করেছি যার জন্য আমি গর্ববোধ করতাম; কাজটা যত ছোট কাজই হোক না কেন।

নেভিতে আমার সারা জীবন বিছানা গোছানো এমন একটা ধ্রুব জিনিস ছিল যে, আমি প্রতিদিন তা গণনা করতে পারতাম। একজন যুবক SEAL হিসেবে বিদেশে USS গ্রেবেকের (আমেরিকার নেভির দ্বিতীয় জাহাজ) সামরিক পতাকাবাহী একটি বিশেষ অপারেশনের সাবমেরিনে অসুস্থ হয়ে আমাকে জাহাজের চিকিৎসাকক্ষে যেতে হয়, যেখানে চারটি বিছানা ওপর ওপর পালি করে রাখা ছিল। সেই চিকিৎসাকক্ষের দায়িত্বে থাকা জেদি ডাক্তার প্রতিদিন ভোরে আমাকে আমার তাকের বিছানা গোছাতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই এ রকম মন্তব্য করতেন যে, যদি বিছানাগুলো সঠিকভাবে গোছানো না থাকে, আর কক্ষটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকে তাহলে কীভাবে নাবিকেরা ভালো স্বাস্থ্যসেবা আশা করবেন? আমি পরে বুঝতে পারি, তাঁর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অনুভূতি ও আদেশ কীভাবে আমার সামরিক জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে কাজে এসেছিল।
৩০ বছর পরে নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়েছিল। পেন্টাগনকে রক্ষা করা হয়েছিল এবং সাহসী আমেরিকানদের পেনসিলভানিয়ার ওপর একটা উড়োজাহাজে মরতে হয়েছিল।

সেই আক্রমণের সময় আমি একটি মারাত্মক প্যারাস্যুট দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাসায় ছিলাম। একটি হাসপাতালের বিছানা হুইল দিয়ে আমার সরকারি কোয়ার্টারে নেওয়া হয়েছিল এবং আমি দিনের বেশির ভাগ সময় বিছানাতে শুয়ে শুয়ে আরোগ্য লাভের চেষ্টা করছিলাম। আমি সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু আমার বিছানাটা ছাড়তে চেয়েছিলাম। যেভাবে প্রত্যেক SEAL–এ আমি আমার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রত্যাশিত ছিলাম।

যখন আমি এতটুকু সুস্থ হলাম যে, বিছানার সাহায্য লাগবে না তখন আমি প্রথম যে কাজটি করলাম তা হলো আমি আমার বিছানার চাদর সঠিকভাবে টেনে গুছিয়ে, বালিশ ঠিকঠাক মতো রাখলাম যাতে এই ঘরে যে কেউ ঢুকলে আমি চিকিৎসার জন্য বিছানা প্রদর্শন করতে পারি। এটা ছিল আমার জখম জয় করে নিজ জীবনে পদার্পণের নিজস্ব ভঙ্গি।

৯/১১–এর চার সপ্তাহের মধ্যেই আমাকে হোয়াইট হাউসে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে আমি পরের দুই বছর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নতুন কার্যালয়ে কাটাই। ২০০৩ সালের অক্টোবরের মধ্যেই আমি ইরাকের বাগদাদে আমাদের অস্থায়ী সদর দপ্তরে ছিলাম। প্রথম কয়েক মাস আমরা আর্মিদের খাটে ঘুমাতাম। সে যাই হোক, আমি প্রতিদিন ভোরে আমার বিছানা গুছিয়ে রাখতাম, মাথার দিকে বালিশ খাটের ঠিক জায়গায় রাখতাম এবং সেই দিনের জন্য প্রস্তুতি নিতাম।

২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার সেনাবাহিনী সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁকে বন্দী করা হয় এবং সে সময় আমরা তাঁকে একটি ছোট্ট কক্ষে রাখি। তিনিও আর্মিদের খাটে ঘুমাতেন তবে তাঁর জন্য চমৎকার বিছানা চাদর ও আরামদায়ক কম্বল ছিল। আমার সৈন্যরা যে তাঁকে ঠিকমতো সেবা দিচ্ছেন, তা নিশ্চিত করতে আমি একদিন সাদ্দামকে দেখতে যাই। পরিতৃপ্তির অনুভূতি নিয়ে লক্ষ্য করলাম, তিনি তাঁর বিছানা গুছিয়ে রাখেননি। তাঁর বিছানার চাদর মুচড়ে খাটের পায়ের দিকে যাচ্ছিল এবং তিনি তা সোজা করে রাখতে অনিচ্ছুক ছিলেন।

পরের দশ বছর আমার ইরাকের সেনানায়ক থেকে, ব্যক্তিগতভাবে প্রধান নৌ সেনাপতি থেকে নাবিক নিয়োগে, রাষ্ট্রদূত থেকে কেরানি টাইপিস্টসহ সবচেয়ে সেরা ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়। যেসব আমেরিকান প্রবাসে যুদ্ধের সাহায্যে ছিলেন, তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে এই মহান দেশে আসেন।

সবাই বুঝতে পারছিলেন, জীবন খুবই কঠিন এবং কিছু কিছু সময় আপনি এমন ছোট কিছু করতে পারবেন যা আপনার সারা দিনের ফলাফলকে প্রভাবিত করবে। যুদ্ধে সৈন্যরা মারা যান, পরিবারবর্গ শোকে থাকেন, আপনার দিন দীর্ঘ হয় ও উদ্বেগে ভরপুর থাকে। আপনি এমন কিছু খোঁজেন, যা আপনাকে সান্ত্বনা দেবে, যা আপনার দিন শুরু করতে উৎসাহিত করবে, যা কিছু কুৎসিত ভাষায় আপনার গর্বের অনুভূতি হতে পারে। কিন্তু, এটা শুধু যুদ্ধ নয়। এটাই দৈনন্দিন জীবন গঠনের প্রয়োজনীয়তা। কিছুই আপনার বিশ্বাসের শক্তি ও স্বস্তিকে প্রতিস্থাপন করতে

পারবে না, কিন্তু কিছু কিছু সময় বিছানা গোছানোর মতো সহজ একটি কাজ আপনার দিন শুরু করতে এবং শেষ পর্যন্ত সঠিক তৃপ্তি দিতে ঊর্ধ্বে ওঠাবে।

আপনি যদি আপনার জীবন পরিবর্তন করতে চান, এমনকি সরা পৃথিবীকে, আপনার বিছানা গুছিয়ে শুরু করুন।
(উইলিয়াম এইচ মেকরেভেনের লেখা থেকে অনুবাদ)