হলুদ ক্যাবিদের জন্য বেইলআউটের প্রস্তাব

মেডালিয়ানের সর্বনিন্ম মূল্য ১,৭৫,০০০ ডলার করার প্রস্তাব
মেডালিয়ানের সর্বনিন্ম মূল্য ১,৭৫,০০০ ডলার করার প্রস্তাব

নিউইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মিলে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে নিউইয়র্কের ট্যাক্সি ক্যাবচালক ও মালিকেরা অনেক দিন ধরেই সংকটের মধ্যে রয়েছেন। একদিকে ঋণজাল বিস্তার, অন্যদিকে মেডালিয়নের দামে কোনো সীমা নির্ধারণ না করে দেওয়ায় বিপাকে পড়েন চালক-মালিক দুইই। এর সঙ্গে অ্যাপভিত্তিক বিভিন্ন রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম চলে আসায় কমে আসে ক্যাবিদের আয়। এ অবস্থায় ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয় তাঁদের, যা শামাল দিতে না পেরে অনেক চালক এরই মধ্যে আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত বেছে নিয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে কিছুটা আশার আলো নিয়ে হাজির হয়েছেন নিউইয়র্ক নগরের কাউন্সিলম্যান মার্ক লেভিন।
নিউইয়র্কে বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার ইয়েলো ক্যাব রয়েছে। ইয়েলো ক্যাবের মেডেলিয়ানের দাম অতীতে ১৪ লাখ ডলার পর্যন্ত ছিল। বর্তমানে তার দাম এক লাখ বিশ হাজার ডলারে নেমেছে। এই দরপতনে বহু ইয়েলো ক্যাবচালক এবং মালিক হতাশ।
কাউন্সিলম্যান মার্ক লেভিনের পাশাপাশি সম্প্রতি নতুন আরেকটি আইন ইয়েলো ক্যাবচালক ও মালিকদের জন্য সুখবর নিয়ে আসছে। নিউইয়র্কের সিনেট এবং অ্যাসেমব্লিতে একটি বিল আসছে, যাতে মেডালিয়ানধারীদের বেইল আউট বা প্রণোদনা চাওয়া হয়েছে । সিনেট বিল এস৬০৮৫ বা ট্যাক্সি মেডালিয়ান গ্যারান্টি প্রোগ্রাম নামের বিলটি ইয়েলো ক্যাব মেডালিয়ানের দাম কমপক্ষে ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলার নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এই বিল পাস হলে প্রত্যেক ক্যাবের মালিকেরা ১ লাখ ৭৫ হাজার ডলার পর্যন্ত ব্যাংক থেকে লোন নিতে পারবেন।

চলতি বছরে বিলটি কমিটি থেকে অনুমোদন পায়নি। কিন্তু অ্যাসেম্বলিম্যান মার্কোস ক্রেসপো এবং সিনেটর জেসিকা রামোস এই বিলকে স্পনসর করে বলেছিলেন, তাঁরা আগামী বছর এই আইনটি নতুন করে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন। বিলটি যদিও এই বছর পাস হয়নি, কিন্তু অ্যাসেম্বলিম্যান মার্কোস ক্রেসপো সিটিঅ্যান্ডস্টেটকে জানান, বিলটি আগামী বছরে পাশে তিনি অনেক আশাবাদী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিটি ও ব্যাংক মিলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধি করে চালকদের ঋণ দিয়ে ক্যাবের প্রসার ঘটিয়েছে। পরে আবার এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই মেডালিয়নের দাম কমানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। এতে করে ঐতিহ্যবাহী হলুদ ক্যাবের আয় সংকোচনের প্রেক্ষাপটে নতুন মালিকদের পক্ষে মেডালিয়ন বিক্রি করে অন্য পেশায় যাওয়াও অসম্ভব হয়ে ওঠে। এদিকে বাড়তে থাকে ঋণের বোঝা। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন অভিবাসীরা। কারণ, চালক থেকে মেডালিয়ন মালিক হওয়া ব্যক্তিদের সিংহভাগই অভিবাসী। এখন তাঁদের দুর্দিনে সেই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা নগর কর্তৃপক্ষ—কেউই ঠিকমতো পাশে দাঁড়াচ্ছে না। ঠিক এখানটাতেই আপত্তি মার্ক লেভিনের।
কাউন্সিলম্যান লেভিন ভুক্তভোগী মেডালিয়ন মালিকদের ‘বেইল আউট’ করার কথা বলছেন। সিটি কাউন্সিলের যেকোনো জনপ্রিয় নেতার মতো মার্ক লেভিনও ক্ষুদ্র ব্যবসা ও নগর উন্নয়নের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত ক্রেডিট ইউনিয়নের একজন ভক্ত ছিলেন। পরে জানলেন, হলুদ ক্যাব চালকদের ঋণদানকারী সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে এ ক্রেডিট ইউনিয়ন, যার কারণে অনেক মেডালিয়ন চালক, মালিক ও বিনিয়োগকারী আজ দেউলিয়া।
মার্ক লেভিন বলেন, ‘আমি এ ক্ষেত্রে ক্রেডিট ইউনিয়নের ভূমিকা ও কার্যকলাপে হতভম্ব। তাদের আচরণ নিঃসন্দেহে লুণ্ঠনের সমতুল্য।’
বলেই থামলেন না। লেভিন সমস্যা থেকে পরিশ্রমী ক্যাব চালক ও মেডালিয়ন মালিকদের উদ্ধারের জন্য তাদের ‘বেইল আউট’ ঘোষণা করার জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন নগর পরিষদে। লেভিনের প্রস্তাবটি পাস হলে, ত্রুটিপূর্ণ ঋণনীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা উপকৃত হবে। মেডালিয়ন মালিক তথা বিনিয়োগকারীরা পাবেন ক্ষতিপূরণ।
লেভিনের মতে, ‘এই মানুষগুলোর পায়ের তলা থেকে কার্পেট সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। নগরী এদের কাছে ঋণী। তাই এই চালক-মালিকদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে নগরীকেই। এই সংকটের সমাধান আমরা করতে পারব। অযৌক্তিক ব্যয় ছাড়াই এটি করা সম্ভব।’
প্রশ্ন হচ্ছে ট্যাক্সি মেডালিয়ন মালিকদের ঋণ ক্ষমা করে দিলে, অর্থটা পরিশোধ হবে কীভাবে? এটা আসলে একটা পরিকল্পনা, যেখানে নগর কর্তৃপক্ষ ঋণগুলো কিনে নেবে এবং বাস্তবতা মেনে সহজ ও ন্যায়সম্মত শর্তে পুনঃঅর্থায়ন করবে। লেভিন বলেছেন, ‘আমরা ঋণদাতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করব। মেডালিয়ন অর্থায়নের বহু খাতে ক্ষতি স্বীকার করতে হবে তাদের। প্রাথমিক বোঝাটি তাদেরই আসলে নিতে হবে। তাই বর্তমানের ঋণের অঙ্কটিকে ব্যাপকভাবে অবমূল্যায়ন করে ঋণদাতাদের আমরা বাধ্য করব ওই সব ঋণ নগরীর কাছে বিক্রি করতে।’
এ ক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষকেও কিছুটা ভর্তুকির বোঝা নিতে হতে পারে। লেভিনের মতে, এ বোঝা নগরীর নেওয়াই উচিত। কারণ এই মেডালিয়ন থেকে নগর কর্তৃপক্ষ শ কোটি ডলার আয় করেছে এক সময়। তাই প্রতি মেডালিয়নের জন্য নগর কর্তৃপক্ষকে যদি ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলারের ঋণের বোঝাও নিতে হয়, তবে তা-ই নেওয়া উচিত।
উল্লেখ্য, ২০০৩ থেকে ২০১৪ সাল—মোটামুটি এক যুগ ধরে মেডালিয়নের মূল্যকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করে, সুবিধাজনকভাবে মূল্য নির্ধারণ করে তা বিক্রির মাধ্যমে ৮৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করে নিউইয়র্ক নগর কর্তৃপক্ষ। এ তথ্যটিকে সামনে রেখেই ক্ষতিগ্রস্ত মেডালিয়ন মালিক-চালকদের সহায়তায় পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে মেডালিয়ন বাবদ নেওয়া দায়ের পরিমাণ এ থেকে আয়ের চেয়ে অনেক কম হবে।
এ প্রসঙ্গে ব্রঙ্কসের মেডালিয়ন মালিক মোহাম্মদ রহমান বলেন, ‘টিএলসি ও নিউইয়র্ক নগরী বুকলেট ছাপিয়ে প্রত্যেক হেক লাইসেন্সধারীর কাছে মেইল করেছিল ওই সময়। রঙিন বুকলেটে দেওয়া বর্ণনায় ছিল মেডালিয়নে বিনিয়োগের লাভজনক বিভিন্ন দিক। এভাবে প্রলোভন দেখিয়ে চালকদের ফাঁদে আটকানো হয়। নিউইয়র্ক নগরীর এমন প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে ২০০৪ সালে একটি প্রাইভেট মেডালিয়ন কিনে নিজে ভুক্তভোগী হয়েছি। সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। তবে মার্ক লেভিনের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে, দেরিতে হলেও কিছুটা স্বস্তি হয়তো ফিরে আসব।’
মর্টগেজ কেলেঙ্কারির আরেক দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি হচ্ছে বয়স্ক চালকদের সময়মতো অবসর গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হওয়া। এ অভিশাপের কারণে মেডালিয়ন ক্যাবিদের ৬০-৭০ বছর বয়সেও গাড়ির চাকা ঘুরিয়ে উপার্জন করতে হচ্ছে। কোন অবসরকালীন ভাতার সংস্থানও নেই তাঁদের জন্য। এ ক্ষেত্রেও ‘ব্ল্যাককার ফান্ড’ ও ‘ওয়ার্কার্স কম্পেনসেশন’-এর অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন লেভিন।