কাছা মামা

২০০০ সালে নিউইয়র্কে অটোর বিয়ের মূল অনুষ্ঠানের আগের রাত। খুররম ভাই বললেন, বুঝলে কাছা চাচার বাড়িতে এসে আমি এত সম্মানিতবোধ করছি এবং এত ভালো লাগছে যে, এমনটি এর আগে কখনো অনুভব করিনি। মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ির এত বড় আয়োজনের মাঝে বর-কনে নয়, আমিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। খুররম ভাই আমার মামাতো ভাই, লন্ডনে থাকেন, বিয়ে উপলক্ষে আজই এসেছেন। বললাম এভাবে নিজেকে এই গুরুত্বপূর্ণ ভাবার ব্যাপারটি শুধু আপনার একার নয়, আমার অনুভূতিও ঠিক একই রকম এবং এখানে আসা অবধি আমারও ভীষণ ভালো লাগছে। আর অন্য সব অতিথিদের উচ্ছ্বাস-উৎফুল্লিতা দেখেও মনে হয়, তাঁরা প্রত্যেকে একই অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
ছোট বড় আমাদের সবার মনে ভালো লাগা ও আনন্দের এই ঢেউ সৃষ্টি করার পেছনে আছে মুহূর্তেই মানুষকে সশব্দে ও সহাস্যে আপন করে নেওয়ার কাছা মামার বিশেষ ব্যক্তিত্ব। আমার ছয় মামার মাঝে তার বুদ্ধিদীপ্ত ও স্নেহসিক্ত চেহারাটিই জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে। এমন ব্যক্তিত্বের মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। আর তার সঙ্গে যখন মামির স্নিগ্ধ সম্ভাষণ ও আপ্যায়ন যোগ হয় তখন পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষটিও আনন্দে উদ্বেলিত না হয়ে পারবে না। তাঁদের দুজনকে দেখলেই আমার তা মনে হয়। তাঁদের সম্পর্কে এ অভিমত শুধু আমার একার নয়, আমার সব আপন এবং মামাতো-খালাতো ভাইবোনের সবার।
বলছিলাম আমার এক মামার কথা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তর্গত শাহবাজপুর গ্রামে আমার নানাবাড়ি ‘হাবিলী বাড়ি’ নামে পরিচিত। আট ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন নানা-নানির নবম সন্তান, আমার মায়ের খুব আদরের একটি ভাই। নাম আবুল ইকবাল মোহাম্মদ আকরাম—সংক্ষেপে লিখতেন আবুল আকরাম, ডাক নাম জানু। কী কারণে যেন আমরা তাঁকে কাছা মামা বলেই জানতাম। আবার অনেকে জানু মামা বলেও ডাকেন। নানার বদলি চাকরির সুবাদে তিনি আসামের বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। পরে জলপাইগুড়ির কোনো স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। জলপাইগুড়িতে তার বড় ভাই চাকরি করতেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বি কম পাস করে একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মে চাকরি নিয়ে করাচি চলে যান এবং সেখান থেকেই এম কম পাস করেন।
কর্মজীবন শুরু করেছিলেন করাচিতে। এরপর কর্ণফুলী পেপার মিলে চাকরি শুরুর আগেই কানাডায় কস্‌ট অ্যাকাউন্টিংয়ে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করেন। খুলনা শিপইয়ার্ডের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কয়েক বছর চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কয়েক বছর চাকরি করেন। এরপর ষাটের দশকের শুরুর দিকে ঢাকায় ‘আকরাম ট্রেডিং’ নামে একটি ইন্ডেন্টিং কোম্পানি খুলে স্বাধীন ব্যবসা শুরু করেন এবং এর স্বল্পকাল পরে আরও দুই পার্টনারের সঙ্গে মিলে ‘রিভারক্রাফট ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে একটি জাহাজ মেরামতের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল থেকে ইমিগ্রান্ট হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস ও ব্যবসা করছিলেন। ১৯৫৬ সালে তৎকালীন সিলেট জেলার অন্তর্গত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্রাম বানিয়াচঙের সম্ভ্রান্ত ‘হাসান মঞ্জিল’ পরিবারের কন্যা সাইয়া খানমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ মামির আপন চাচাতো ভাই। তাঁদের চার সন্তানের মধ্যে জীবিত তিনজন আমেরিকায় বসবাস করে। প্রায় এক দশক পরে নিউইয়র্কে যখন আমার সঙ্গে আবার দেখা হয়, তখন এই মামাতো ভাইগুলোর প্রতিজনকে ‘সোনার টুকরা ছেলে’ বলে মনে হয়েছিল। মামা সানফ্রান্সিসকোতে ছোট দুই ছেলের বাসায় বেড়াতে গিয়ে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ৮২ বছর বয়সে মারা যান। তার বিধবা স্ত্রী নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের রংকনকমা শহরে স্বামীর ৩০ বছরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে বাস করলেও ছেলে ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে সারা বছর পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান।
মামাকে নিয়ে আমার সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি যা মনে আছে তখন আমার বয়স পাঁচের নিচে। তা জানি, কারণ ১৯৫৬ সালে মামার বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। তারও আগের, ধারণা করি প্রায় এক বছর আগের ঘটনা সেটি। আম্মা, বড় আপা, ছোট আপা, আমি ও আমার ছোট আরও দুই ভাইকে নিয়ে রেলগাড়িতে করে আব্বা আমাদের চট্টগ্রাম অথবা চন্দ্রঘোনা স্টেশন-সংলগ্ন একটি রেস্ট হাউসে রেখে এসেছিলেন। পরদিন কাছা মামা এসে একটি খোলা স্পিডবোটে করে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে তাঁর বাংলোয়। সেখানে আমরা বেশ কয়েকদিন বেড়িয়েছিলাম। সেখানেই প্রথম রেফ্রিজারেটর দেখলাম, ঘরে বানানো আইসক্রিম খেলাম। বাথরুমে একটি টিউব টিপে টিপে সাদা রঙের টুথপেস্টও প্রথম খেয়েছিলাম। এরপরের কিছুটা আরও স্পষ্ট স্মৃতি হচ্ছে তাঁর বিয়ের সময়ের। সে কথায় পরে আসছি।
১৯৬২ সালে ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমি কিছুদিন খুলনার খালিশপুরে নিউজপ্রিন্ট মিলে কর্মরত ছোট মামার পরিবারের সঙ্গে কিছুদিন কাটিয়েছিলাম। আম্মার জন্য প্রাণ কাঁদত, আমি উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকতাম কিছু দূরে খুলনা শিপইয়ার্ডে কর্মরত কাছা মামা কখন আসবেন। তাঁর হাসি ও আদর মাখা সম্ভাষণ শুনলেই আমি মায়ের অভাব কিছুটা ভুলে যেতাম। সেই সময় পুরো পরিবারসহ ইফু খালাম্মা সেখানে বেড়াতে এলে আমিও কাছা মামার বাসায় দিন দশেক থাকতে যাই। চারদিকে গাছপালা ও চমৎকার গাজিবো নিয়ে তাঁদের বাড়িটি ছিল বিদেশি বাংলো বাড়ির আদলে তৈরি। ছিল বেশ কয়েকজন চাকর, মালি ও সুইপার। একজন শিক্ষিত খ্রিষ্টান আয়া তাঁদের দ্বিতীয় ছেলের দেখাশোনা করা ছাড়াও বাসার তদারকি করত। শীত মৌসুম মোটে শুরু হয়েছে। মামা মামিকে বললেন, নাসিমের (আমার ডাক নাম) গায়ে কোনো সোয়েটার নেই, তুমি ওকে একটি সোয়েটার বানিয়ে দিয়ো। মামি সেদিনই বাজার থেকে উল কিনিয়ে এনে আমার জন্য সোয়েটার বুনতে লেগে গেলেন। সাত দিন শেষে খয়েরি রঙের নতুন হাতকাটা সেই সোয়েটারটি গায়ে দিয়ে ছোট মামার খালিশপুরের বাসায় ফিরে এসেছিলাম।
ঢাকায় কাছা মামার বাসাটি ছিল সব আত্মীয়স্বজনের খোঁজ–খবরের জায়গা। কারও সঙ্গে অনেক দিন কোনো যোগাযোগ না থাকলেও সেই বাসায় গেলেই খোঁজ পাওয়া যেত, কারণ অন্য কারও সঙ্গে না হলেও কাছা মামা ও মামির সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ অবশ্যই ছিল। কোনো পার্টি বা দাওয়াত না থাকলেও তাস খেলার অছিলায় প্রতি শুক্র বা রোববার তাঁদের বাসার অফিস ঘরে কিছু লোক জড়ো হতোই। তা জেনেই ওই বাসায় হাজির হয়ে পাশের বসার ঘরে বসে রেকর্ড প্লেয়ারে মামার নতুন কেনা নজরুল গীতির রেকর্ড ছেড়ে ফ্যানের নিচে ঠান্ডা বাতাস খেতাম। আমার মতোই সেখানে জড়ো হতে থাকে খসরু, খুররম ভাই বা নোমান ভাই। পাশের ঘর থেকে মামা উঠে এসে কখন এসেছি জিজ্ঞেস করেই বলতেন, দুপুরের খাবার না খেয়ে যেন কোনোমতেই যেন না যাই। বয়সের দিক থেকে আমি ছিলাম মামা থেকে অনেক অনেক ছোট, কোনো কিছু নিয়ে একত্রে বসে আলোচনা করার মতো মোটেই নয়। কিন্তু তাঁর স্নেহের পরিধি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, আমরা সব বয়সের ভাগনা-ভাগনি, ভাতিজা-ভাতিজি প্রত্যেকেই তা গভীরভাবে উপলব্ধি করতাম।
কোনো ভাতিজা বা ভাগনের হোস্টেলে থাকার জায়গা নেই? কেন কাছা মামার বাসা আছে না? সেখানে আমার জানা মতে, মাসের পর মাস থেকে লেখাপড়া করেছেন নোমান ভাই, মেঝভাই (জেসিম ভাই), খসরু, থাকি, ছোট আপা (রুবি আপা) ও খুররম ভাই। হোস্টেলের খাবার খেতে পার না? ফজলুল হক হল, রোকেয়া হল বা ঢাকা কলেজ হোস্টেল থেকে তাঁদের বাসায় গিয়ে উঠলেই হলো। তোমার কিছুই বলতে হবে না, চাইতেও হবে না। দরজা খোলার শব্দ শুনে শোয়ার ঘর থেকে মামির গলার আওয়াজ শোনা যেতো। শান্ত ও নিম্নস্বরে তিনি বলছেন, ইয়াসিন (বাসার কাজের ছেলে) তোর নাসিম (আমার ডাক নাম) ভাইকে টেবিলে খাবার দে। আহা কী কাঙ্ক্ষিত ও সুস্বাদু ছিল সে সব খাবার! কোনো শ্যালক বা শ্যালিকার বিয়ে হচ্ছে মামার প্রশস্ত ও বিশাল বাসায়। আমি ও আমার মতো আরও অনেক ছেলে–ছোকরা ভাগনে–ভাগনিকে দাওয়াত দিতে মামা ও মামির কখনো ভুল হতো না। আহা কী আনন্দেরই না ছিল সে সব দিন।
১৯৭৩ সালে প্রথমে মামা একা ঢাকা ছেড়ে বিলাত চলে যান। আমি তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সব ঠিক হয়ে গেলে ছেলেদের নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় মামি আমাকে খবর পাঠালেন। মামার প্রায় অব্যবহৃত দামি দুটি প্যান্ট দিয়ে বললেন, আমি যেন দরজিকে দিয়ে কাটিয়ে বা অল্টার করিয়ে নিজে ব্যবহার করি। আমি তা করিয়েছিলামও। হালকা সবুজের মাঝে ফ্যাব্রিকের ডিজাইন করা একটি প্যান্ট আমার খুব পছন্দের ছিল, অনেক দিন ব্যবহার করেছিলাম।
বিলাত থেকে তাঁরা আমেরিকায় এসেছিলেন ১৯৭৩ সালে। ১৯৮৩ সালে আমার আমেরিকায় আসার মাস কয়েক আগে তাঁদের তৃতীয় ছেলে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। সেই শোকে নিমজ্জিত মামা–মামি আমি ও আমার স্ত্রীকে আপ্যায়ন করতে ত্রুটি করেননি। আমরা এ দেশে আসার নয় মাস পরে আমাদের প্রথম ছেলের জন্ম হল। তাকে দেখতে মামা-মামি তাঁদের তিন পুত্রকে নিয়ে এসেছিলেন। মেরিল্যান্ডে আমাদের এক বেডরুমের সেই অ্যাপার্টমেন্টে মেঝেতে বিছানা করে দুই বা তিন দিন ছিলেনও আমাদের সঙ্গে। সেটি যে আমার জন্য কত বড় সৌভাগ্য ও খুশির ব্যাপার ছিল, তা বলে বা লিখে বোঝাতে পারব না। কারণ তাঁদের আতিথ্য পেতে আমাদের যেকোনো আত্মীয় লালায়িত হয়ে থাকতেন। সেখানে আমার মতো বয়সে এত ছোট ও নগণ্য এক ভাগনের আরও নগণ্য অ্যাপার্টমেন্টে এই মামা–মামির আসা ছিল আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ঘটনা। তারপর যখন শুনলাম, নয় বছর আগে এ দেশে এলেও এবং নিউইয়র্ক রাজ্য ও কানাডার টরন্টোতে তাঁর আরও তিনজন ভাগনি ও ভাতিজা বাস করলেও এই প্রথম তাঁরা কারও আতিথ্য গ্রহণ করেছেন, তখন নিজেকে পরম সৌভাগ্যবান মনে করার সমূহ কারণ ছিল বৈকি।
এরপর আরও তিনবার মামা–মামি এসেছিলেন আমাদের বাসায়। আমরাও গেছি তাঁদের ওখানে অনেক বার। মামার জাদুমাখা সম্ভাষণটিতে প্রচ্ছন্ন থাকত পরম আত্মীয়তা, আন্তরিকতা ও আপন করে নেওয়ার এক অসামান্য সুর। টেলিফোনে হোক বা সামনাসামনি হোক, আমার নাসিম নামটি উচ্চারণ করার সময় ‘সি’ শব্দটিকে এত লম্বা করে বলতেন যে, তখনই ভালো লাগার প্রথম ছোঁয়াটি পাওয়া যেতো। পরে লক্ষ্য করেছি, অন্যদের বেলায়ও তিনি তাই করতেন। খাওয়া–দাওয়া, পোশাক, জুতা এবং জীবনধারণের সবকিছুতেই তাঁর এক শৌখিন রুচির ছাপ ছিল। আমরা বা অন্য কেউ তাঁদের বাসায় বেড়াতে গেলে কী খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করবেন, সে ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। ডিনার টেবিলে দেখে দেখে নিজ হাতে খাবার তুলে দিতেন। নাশতার টেবিলে রাখা সুন্দর ও মুখরোচক পনির নিজ হাতে কেটে প্লেটে তুলে দিতেন। ঢাকা থেকে কোনো আত্মীয় এসেছে খোঁজ পেলেই হুকুম জারি করেছেন, তাঁদের নিয়ে যেন অবশ্যই তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে যাই। উপহার দিতেন প্রাণ উজাড় করে।
একবার বিভিন্ন শহরে বেড়িয়ে ছেলেদের ছাড়া মামা-মামি নিজেরাই এলেন উড়োজাহাজে করে। মামার শ্যালক-সম্পর্কীয় এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত ছিল। নিউইয়র্ক থেকে অটো ফোন করে বলল, অনেক দিন হয়ে গেছে মা ও বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি। তাই ছোট ভাই মিটোকে নিয়ে সে কাউকে না জানিয়েই মামার শ্যালকের বাসায় গিয়ে উঠবে। আমার কাছে সেই বাসার ঠিকানা চাইল। দরজা খুলে ওরা যখন ঘরে ঢুকল, তখন আমি মামা–মামির চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সেখানে যুগপৎ বিস্ময় ও আনন্দের যে মিশ্রণের বহিঃপ্রকাশ দেখেছিলাম, তা যেকোনো অঙ্কন শিল্পীর জন্য দুর্লভ একটি দৃশ্য হতে পারত।
মামার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লক্ষ করলাম, মামির অসামান্য গুণাবলির কথা কিছুই বলা হলো না। মামির উদারতা, প্রশ্রয় ও আতিথেয়তা না থাকলে চট্টগ্রাম, খুলনা, ঢাকা ও নিউইয়র্কে জানু মামার বাসাটি কি আমাদের আত্মীয়স্বজনের তীর্থস্থান হয়ে উঠতে পারত? তা প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে খিদের তাড়নায় সময়ে–অসময়ে যখনই তাঁদের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছি, দরজা খোলার সাড়া পেয়েই কাজের ছেলেটিকে আমাকে খাবার দেওয়ার মামির নির্দেশ শুনতে পেয়েছি। রাতে ও দুপুরে সামান্য বিশ্রামের সময় ছাড়া তাঁকে কখনো কোথাও বসে থাকতে দেখিনি। রান্নাঘরে না থাকলে শোয়ার ঘরের বিছানা গোছাচ্ছেন, কাপড় ভাঁজ করছেন অথবা বসার ঘরটি গুছিয়ে রাখছেন। প্রায় অস্ফুট স্বরে দেওয়া নির্দেশ আয়া অথবা কাজের ছেলেদের কাজের ততোধিক নিবিষ্ট মনে করে যাচ্ছে। ফলে বিগত ৫০–৬০ বছরে তাঁদের বাড়ির কোনো জিনিসই একদিনের জন্যও অগোছালো দেখিনি। নিউইয়র্কে তাঁদের পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে বক্তৃতায় আমি বলেছিলাম, ‘শুনেছি মিটো (তাঁদের দ্বিতীয় ছেলে) এনওয়াইইউ-র এক্সক্সক্স স্কুল থেকে ম্যানেজমেন্টের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেছে। কিন্তু আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি, এনওয়াইইউ অথবা অক্সফোর্ড হার্ভার্ডের শিক্ষকেরা আমাদের কাছা মামির কাছে প্রশিক্ষণ নিলে মিটোর চেয়ে অনেক ভালো ভালো ছাত্র উপহার দিতে পারতেন।’
শেষের দিকে ফোন করে শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলে হাসতে হাসতে মামা বলতেন, আর কত বাবা, বয়স তো কম হলো না, ৮২ পেরিয়েছে। এই বয়সে ভালো যা আশা করা যায়, তেমনই আছি। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাস। সানফ্রান্সিসকো থেকে মামির ফোন পেলাম। ছোট ছেলে আসিফের বাসায় বেড়াতে গিয়ে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী মামা। পরদিন আটো জানাল, ডাক্তাররা বলছেন একে একে মামার কিডনি, হার্ট ও ফুসফুস কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। চাইলে যন্ত্রপাতি দিয়ে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে, সব পার্থিব অর্থেই তিনি এখন মৃত। জীবিতাবস্থায় মামা সব সময় বলতেন, শুধু যন্ত্রপাতি দিয়ে যেন তাঁর আয়ু দীর্ঘায়িত করা না হয়। অতি দুঃখজনক ও কষ্টকর হলেও এই অবস্থায় মামার শেষ ইচ্ছাই পূরণ করার কথা ওরা চিন্তা করছে। নিতান্ত অপারগ হয়ে মামিও তাই জানালেন। ৩১ জানুয়ারি প্রাণ বায়ুটি তাঁর দেহ ছেড়ে কোথায় চলে গেল! তিন দিন পর প্রায় তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে তাঁর মৃতদেহ সমাহতি করতে নিউইয়র্কে আনা হলো। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য স্মরণকালের একটি অন্যতম তুষারপাতের মাঝে আমি আমার ছোট ভাই আদেলের সঙ্গে নিউইয়র্কে তাঁর কবরের ওপর এক মুঠো মাটি তুলে দিলাম।
প্রায় নয় বছর আগে জানু মামা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। মামি নিউইয়র্কের সেই বাড়িটিকে ছবির ন্যায় অবিকল আগের মতোই সাজিয়ে রেখেছেন অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন ও মমতার মোড়কে। আমাদের প্রতি তাঁর স্নেহ ও আতিথেয়তার বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি আজও।
যে কথোপকথন দিয়ে এই লেখাটি শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে যাই। শুক্রবারের কাজ শেষে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা ড্রাইভ করে নিউইয়র্কের বিয়েবাড়িতে পৌঁছাতে রাত দশটা বেজে গেল। খাওয়া–দাওয়া ও গল্পগুজবে মত্ত দেশ–বিদেশ থেকে আসা অতিথিদের মামা অভ্যর্থনা জানালেন। বাসার সিমেন্ট বাঁধানো উঠানে শামিয়ানার নিচে বসে মামার বড় ছেলে অটো আমার খাওয়ায় সঙ্গ দিচ্ছিল। কাল ওরই বিয়ের অনুষ্ঠান। পরদিনের মূল অনুষ্ঠানে পরিবেশনের জন্য একপাশে দিনের মতো উজ্জ্বল আলোর নিচে অল্পবয়সী একদল ছেলেমেয়ে বাদ্যের সঙ্গে নাচের মহড়া দিচ্ছিল। ঠিক মামার মতোই আমার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে অটো বলল, আব্বার মুখে শুনেছি শাহবাজপুরে তাঁদের বিয়ের অনুষ্ঠানে সব আত্মীয়স্বজন এসেছিলেন এবং অনেক দিন পর্যন্ত সবাই খুব আমোদ ফুর্তি করেছিল। আমেরিকার জীবন ব্যবস্থায় তো অনেক দিন ধরে সবাইকে পাওয়া যায় না, তবে মনে হলো আব্বাকে খুশি করার জন্য যত আত্মীয়কে পারি আমার বিয়ে উপলক্ষে আবার জড়ো করাই না কেন। তা আপনি কষ্ট করে এত লম্বা ড্রাইভ করে এসেছেন, আমি খুব খুশি হয়েছি।
বললাম, আসলে খুশি আমিই হয়েছি। আজ কত বছর পর লন্ডন থেকে আসা খুকি আপা ও খুররম ভাইকে কাছে পেলাম, ঢাকা থেকে আসা তোমার নানি ও দুই খালাকে তো দেখলাম মনে হয় দুই যুগ পরে, কানাডা থেকে আসা হাজি ভাই ও বদলি ভাবি, আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে পুরো পরিবারসহ আসা টিনা, বাবুয়া, ভুট্টো, শাহীন, মালা, মানিক, এক্সক্স এবং আরও অনেক আত্মীয়স্বজন যাদের অনেককেই আমি চিনি না, তাঁদের সবাইকে একসঙ্গে পেয়ে যে আমার কী খুশি লাগছে, তা তুমি জান না। আর এখানে এসে এই অপরিচিত পরিবেশে আমার ছোট ছোট দুই ছেলে ও তোমার ভাবি যে কোথায় লাপাত্তা হয়ে গেল, তা থেকে বুঝতে পারছি ওরাও খুব উপভোগ করছে। কাজেই বলতে পারি সবাইকে আনন্দ দেওয়ার তোমার উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছে।
ভেতরে সিডি প্লেয়ারে মৃদুস্বরে একের পর এক বেজে চলেছে মামার পছন্দের নজরুল গীতি। চা, মিষ্টি ও বিভিন্ন জাতের পিঠা নিয়ে মামা–মামি সবাইকে নিয়ে বসার ঘরে গোল হয়ে বসলেন। একপাশে স্তূপ করে রাখা রঙিন কাগজে মোড়া বিয়ের অসংখ্য বড় বড় উপহারসামগ্রী। পুরোনো দিনের স্মৃতি ও হাসিঠাট্টা দিয়ে চলল আড্ডা। এক সময় মামা দৃষ্টি আকর্ষণ করে কষ্ট করে আসার জন্য ধন্যবাদ জানালেন। মামি উপহারসামগ্রী হাতে নিলে কে একজন বলল, আজ এসব খোলা কেন, কাল বিয়ের পরে খুললে হয় না? মামি বললেন, কালকেরটা কালকে হবে, আজকেরটা আজই হয়ে যাক। এই বলে গায়ে লেখা নামটি পড়ে প্যাকেটটি একেকজন অতিথির হাতে তুলে দিতে লাগলেন। তখন বোঝা গেল, সাজিয়ে রাখা এসব উপহার বিয়ের বর-কনের জন্য নয়, বিয়েতে আসা সব অতিথির জন্য। কেউ কেউ সেই আসরেই মোড়ক খুলে উপহারটি দেখে নিজের অজান্তেই হা হু শব্দ করে আনন্দ প্রকাশ করল। এভাবে দেখা প্রতিটি উপহারের সঙ্গেই প্রাপকের সামঞ্জস্য দেখে ক্রেতার উন্নত রুচি ও পছন্দের প্রশংসা না করে কেউ পারেনি। পছন্দগুলো সবই ছিল মামা–মামির।
পরদিন সকালে বিয়ে বাড়িতে ফিরে গেলে মামা গাছের নিচে উঠানের ঘাসে শীতল পাটি বিছিয়ে বাদাম ও মুড়ি নিয়ে আমাদের সঙ্গে বসলেন। যোগ দিলেন খুকি আপা, হাজি ভাই ও মামার এক ভায়রা। সেই ছোটকালের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। মামার গলার সঙ্গে তার প্রিয় নজরুল গীতিতে গলা মেলালাম। চোখের সামনে বহু বছরের পুরোনো কিছু স্মৃতি আবছা আবছা ভেসে উঠল। কাছা মামার বিয়ে উপলক্ষে শাহবাজপুরে সব আত্মীয়স্বজনের আগমন ঘটেছে। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। প্রায় সময়ই আম্মার কাছাকাছি বা আপার অথবা কাজের ছেলের কোলে কোলে থাকি। বাহির বাড়ি থেকে ভেতরর বাড়িটি আলাদা ছিল অনেক লম্বা ঢেউটিনের দোচালা একটি ঘর দিয়ে। বাইরে থেকে একটি মনে হলেও আসলে ভেতরে ছিল বেড়া দিয়ে ভাগ করা আলাদা আলাদা চার পাঁচটি ঘর। প্রতিটি ঘরে ছিল একটি করে পরিবারের থাকার ব্যবস্থা। সারা বাড়িতে বিভিন্ন বয়সের ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছিল।
আমরা যারা ছোট, তাঁদের সব সময় শাসনের মাঝে রাখা হতো। খারাপ কাজ করলে কী হতে পারে, তা দেখার জন্য দূর থেকে কিছু দেখার সুযোগ দেওয়া হলো। আট/দশজন বড় বড় মামাতো খালাতো ভাইদের একটি দল প্রত্যেকের ডান হাতটি সামনের দিকে প্রসারিত করে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। সেই দলে আমার বড় দুই ভাইও ছিলেন। আরও ছিল আমার বছর দু-এক বড় হেলাল ভাই। সামনের জন এগিয়ে এলেই মেঝমামা হাতের বেতটি দিয়ে অপরাধীর হাতে মৃদু আঘাত করে জিজ্ঞেস করছিলেন, বল্ আর এ কাজ আর করবি? অপরাধী তাঁর মাথাটি দুই পাশে নাড়িয়ে বলছিল, জি না। মামা বললেন, ঠিক আছে এখন যা। এত অল্প বয়সে দেখা দৃশ্যটি ভীতিকর হলেও মেঝমামার চেহারায় যে স্নেহের আভাষ ছিল কীভাবে যেন সেই স্মৃতিটিই বেশি মনে আছে। তা এই শাস্তিটি কীসের জন্য হয়েছিল? পরে শুনেছিলাম এই দুষ্কৃতকারীর দল রসুই ঘর থেকে টিন ভর্তি মুড়ি, টিন ভর্তি বাতাসা, টিন ভর্তি চিনি, টিন ভর্তি বিস্কুট এবং টিনের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খাবলা খাবলা ঘি তুলে নিয়ে নদীর ধারে বসে বসে ফুর্তি করেছে।
এক সকালে ভেতর বাড়ির উঠানে সমবয়সী মামাতো–খালাতো ভাই–বোনদের সঙ্গে গোল্লাছুট বা লাই খেলা খেলছি। হঠাৎ কেউ খবর দিল, বউ এসেছে। কারও কোলে চেপে বাহির বাড়ির ‘বিশাল মাঠ’ পেরিয়ে পুকুর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। পুকুরে ছই ঢাকা একটি বিশাল নৌকা। কয়েকদিন আগে তেমনি একটি নৌকা করে আমরাও এসেছিলাম। আমাদের নৌকাটি তিতাস নদী ছেড়ে অনেক লম্বা একটি খাল পেরিয়ে এই পুকুরে এসে ভিড়েছিল। কিন্তু খালটি এতই সরু ছিল যে দুপাশের বাঁশঝাড়ের ডাল ও পাতা লাগছিল বলে আম্মা আমাকে ছইয়ের ভেতরে টেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের নৌকাটি লাল নীল কাগজ দিয়ে সাজানো। ছইয়ের খোলা মুখটিও সুন্দর পর্দা দিয়ে ঢাকা। সামনে–পেছনে শুধু মাঝিদের দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমি তো বউ দেখতে এসেছি, বউ কোথায়? এক সময় পর্দা সরিয়ে সাদা আচকন ও পাগড়ি মাথায় কাছা মামা বেরিয়ে এলেন। পর্দাটিও ওঠানোই রইল। আমি যার কোলে ছিলাম সে বলল, ওই দেখ ভেতরে বউ বসে আছে। আমি দেখলাম সারা মুখ ঢাকা মাথা নোয়ানো অবস্থায় কেউ বসে আছে। কিছুক্ষণ পর সেই বউ অন্যদের সাহায্যে নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। ছোটবড় অনেক নারী–পুরুষ পরিবেষ্টিত হয়ে পুরো উঠানটি পেরিয়ে ভেতর বাড়িতে ঢুকে গেলেন।
নানিজানের বড় ঘরটিতে বউকে তোলা হলো। পালঙ্কের ওপর বিশাল বিছানার মাঝখানে ঘোমটা ও নিচু মাথায় বউ বসে আছে। পাশে বসে আছেন সেঝমামী। চারদিকে বাড়ির সবাই জড়ো হয়েছে। নানির সম্মতিতে সেঝমামী বউয়ের ঘোমটাটি মাথার ওপর তুললেন। থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটিকে ওপরের দিকে তুলে ধরলেন। আমি দেখলাম, কপালে টিকলি পরা সাজানো একটি কিন্তু অতি বিষণ্ন চেহারার নিচের দিকে মুখ করে আছে। চোখ দুটো বোজা। চারিদিক থেকে সবাই বউকে চোখ খুলতে বলছে, কিন্তু বউ কিছুতেই চোখ খুলছে না। চেহারায় বিষণ্ন ভাবটি এতই স্পষ্ট ছিল যে, সঙ্গে সঙ্গেই আমি আম্মাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলাম, নতুন বউ কাঁদছে কেন? আমাকে বলা হয়েছিল, কাঁদছে না, ওর মন খারাপ হয়ে আছে। কেন তাঁর মন খারাপ কেন? কারণ সে ওর মা বাবাকে ছেড়ে এসেছে তো, তাই ওর মন খারাপ। সঙ্গে সঙ্গেই আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। না আমি আম্মাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাব না। আর আমি বিয়েও করব না, কারণ মা–বাবাকে ছেড়ে আসতে বউয়ের মনে কষ্ট হবে।
ওই সময়ে কেউ গান ধরেছিল ‘বউ কথা কয় পাখি ডাকে বউ তো ফিরে চায় না। মন কাঁদে হায় হায় রে...’। আমার বড় আপার বয়সী খালাতো বোন খুকি আপার গাওয়া ‘ঝিলিমিলি ঝিলিমিলি নদীর জলে...’ সেই গানটি সম্ভবত ঠিক তখন থেকেই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
মামা–মামির বিয়ের ঘটনার এসব স্মৃতির সত্যতা যাচাই করার জন্য আজ (১১ সেপ্টেম্বর, ২০১১) মামিকে ফোন করেছিলাম। তাঁদের বিয়ে হয়েছিল ১৯৫৬ সালের ২১ জুন। তিনি আমাকে কিছু কিছু সমর্থন করলেও আমার কোনো স্মৃতিকেই মনগড়া বলে মনে করলেন না। সেদিনের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় আমার বড় আপা, খুকি আপা, জুগনু আপা ও অন্যান্য মেয়ের সমবেত গানের সঙ্গে তাঁকেও নাচতে হয়েছিল সবার অনুরোধে। মামির নাচের ব্যাপারটি আমার স্মৃতিতে একেবারের নেই, হয়তো ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। (কয়েক বছর আগে ঢাকায় গেলে অটো একটি পুরোনো ছবি সংগ্রহ করে এনেছে, সেটি মামির সেদিনের নাচের ছবি)।
কাছা মামার বিয়ের সেই অনুষ্ঠানটি আমার মামা-খালার দিকের সব আত্মীয়স্বজনের কাছে অত্যন্ত আনন্দদায়ক ছিল বলে সবার স্মৃতিতেই আজ ৫৫ বছর পরও তা জ্বলজ্বল করে। অটোর বিয়েতে পুরোনো আত্মীয়স্বজন সবাই আবার স্মৃতিচারণ করল। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত মামা–মামির ৫০তম বিবাহবার্ষিকী উদ্‌যাপনে আমি আমার সে সব স্মৃতিচারণ করে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। এখনো আমাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে উপস্থিত হলেই কাছা মামার বিয়ের স্মৃতিচারণ হয় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে। বড়দের হাত পেতে বেত খাওয়ার দৃশ্য, নৌকায় মামা-মামির চেহারা, ঘোমটার নিচে মামির বেজার মুখ, খুকি আপার গাওয়া ‘...বউ তো ফিরে চায় না’ গান এবং নিজের চুলকে দাঁড়ি বানিয়ে নাচতে থাকার দৃশ্যগুলো এতই জীবন্ত যে, এগুলোকে ‘মিথ্যা স্মৃতি’ ভাবতে কষ্ট হয়। তার ওপর আমার বয়স তখন মনোবিজ্ঞানীদের বেঁধে দেওয়া ‘চাইল্ডহুড এমনেসিয়া’র দুই থেকে চার বছরের অনেক অনেক বেশি, পাঁচ-ছয় বছর ছিল। কাজেই আমার এই স্মৃতিগুলোকে একান্তই নিজস্ব ও মৌলিক স্মৃতি বললে বেশি বলা হবে না।