মেয়েটি এখন কী করবে?

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

স্বপ্ন ছিল নার্সিং কলেজে পড়ার। দশম শ্রেণিতে উঠতেই ধর্ষণের শিকার হয়ে সমাজচ্যুত হতে হলো। জায়গা হলো সরকারি একটি আবাসনকেন্দ্রে। তবুও হাল ছাড়েননি মেয়েটি। সেখান থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দিতে শুরু করেন। পরীক্ষা চলাকালেই সন্তান হয়। হাসপাতালে সন্তান রেখে তিনি পরীক্ষা দিতে যান। পরীক্ষায় পাস করেন। এবার কলেজে ভর্তি হলেও ক্লাস করতে পারেন না। সন্তান নিয়ে আবাসনকেন্দ্রেই থাকতে হয়। তবু তিনি হারতে চান না। ক্লাস না করে পরীক্ষা দেন। পাসও করেন। মামলায় ধর্ষকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় কিন্তু তাঁর স্বপ্ন আর পূরণ হয় না। সন্তান হওয়ার কারণে বিবাহিত না হলেও তাঁকে ফেলা হয়েছে বিবাহিত নারীর কাতারে। তিনি নার্সিং কলেজের ফরমই পূরণ করতে পারবেন না। মেয়েটি এখন বাড়িতেই রয়েছেন কিন্তু তাঁর স্বপ্নপূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিয়ে না করেও সন্তানের মা হওয়ার ব্যাপারটি। বিয়ে না করলেও তাঁর সন্তান রয়েছে। তাঁকে এখন বিবাহিত নারী হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। অথবা ফরমে তাঁকে স্বামী পরিত্যক্তা লিখতে হবে। মেয়েটি কোনো দলেই পড়েন না। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে লড়াই করে মেয়েটি এখন দিশেহারা। তাঁর দিনমজুর বাবার পক্ষে এ পর্যায়ে পড়াশোনার খরচের জোগান দেওয়াও সম্ভব নয়। সমাজের মানুষের কটূক্তির জ্বালায় তিনি বাইরেও বের হতে পারছেন না। এখন তাঁর বেঁচে থাকার লড়াই। একটা কর্মসংস্থান হলে তিনি সন্তান নিয়ে বাঁচতে পারেন।

২০১৩ সালের ৬ জুনের ঘটনা। তখন তিনি দশম শ্রেণিতে পড়েন। এ সময় তাঁর জীবনে ঘটে যায় এই ভয়াবহ ঘটনা। তিনি ধর্ষণের শিকার হন। ধর্ষকের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেওয়ার জন্য গ্রামের লোকজন চাপ দিতে থাকেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদে এ নিয়ে সালিসও হয়। কিন্তু সেখানে অভিযুক্ত যুবক সবকিছু অস্বীকার করেন। সালিস ভেঙে যায়। প্রতিপক্ষের হুমকির মুখে মেয়ের পরিবার মামলা করতে পারে না। একপর্যায়ে সন্তানসম্ভবা হলে মেয়েটিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। তখন ওসিসি থেকেই ধর্ষণ মামলা করা হয়। মামলার পর পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ওই যুবক, মেয়ে এবং তাঁর সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় প্রমাণ হয় ওই যুবকই শিশুটির বাবা। আদালতে মামলার বিচার শুরু হয়। আদালত ওই মেয়েটিকে ‘মহিলা সহায়তা কর্মসূচি’র রাজশাহী বিভাগীয় আবাসনকেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেখানে থাকা অবস্থায় মেয়েটির এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। পরীক্ষা চলাকালে ২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেয়েটি একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। তখন মাত্র চারটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছে। সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই দুটি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। এসএসসির বাকি লিখিত এবং ব্যবহারিক পরীক্ষাগুলোতে আবাসনকেন্দ্র থেকেই অংশ নেন।

সন্তান প্রসবের পর গ্রামের লোকজন তাঁদের পরিবারকে গ্রামছাড়া করতে চেয়েছিল। তাঁর মা তখন গ্রামের লোকেদের হাত-পায়ে ধরেন। গ্রামের লোকজন এতে নরম হয় কিন্তু তারা শর্ত দেয় যে পরিবারটিকে গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে, কিন্তু মেয়েটি তাঁর সন্তান নিয়ে গ্রামে ফিরতে পারবেন না। এ নিয়ে তারা একটি কাগজে তাঁর বাবা-মায়ের স্বাক্ষরও নেয়। ফলে মেয়েটি আর সন্তান নিয়ে গ্রামে ফিরতে পারেন না। আবাসনকেন্দ্রে থাকতেই এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৪.১৯ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। সেখান থেকেই একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। কিন্তু সরকারি হেফাজতে থাকায় কলেজে যেতে পারতেন না। এ জন্য বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে তাঁকে মানবিক বিভাগে ভর্তি হতে হয়। আবাসনকেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা তাঁকে বই-খাতা কিনে দেন। সেখানে সন্তান প্রতিপালনের পাশাপাশি মেয়েটি পড়াশোনা চালিয়ে যান। ২০১৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। তবে কোনো শিক্ষকের সহায়তা না পাওয়ার কারণে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ের প্রস্তুতি ভালো ছিল না। ওই বিষয়ে অকৃতকার্য হন। কিন্তু হাল ছাড়েন না। পরের বছর আবার পরীক্ষা দেন। এই পরীক্ষার আগের দিন ৯ এপ্রিল আদালতের অনুমতি নিয়ে আবাসনকেন্দ্র থেকে এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে ওঠেন। সেখান থেকেই পরীক্ষা দেন। পরীক্ষার পর তাঁর আর আবাসনকেন্দ্রের বন্দী জীবনে ফিরতে ভালো লাগে না। আরেক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে আশ্রয় নেন।

তিনি সমাজপতিদের ভয়ে নিজ গ্রামে ফিরতে সাহস পাচ্ছিলেন না। এভাবে প্রায় দেড় মাস কেটে যায়। অবশেষে ওসিসির আইনজীবী আশুরা খাতুন এবং জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী দিল সেতারা তাঁকে সাহায্য করেন। তাঁরা মেয়েটিকে বাড়িতে রেখে আসেন। এরই মধ্যে পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এবার জিপিএ-৩.১৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। এদিকে গত ৩০ মে আদালতের রায়ে ধর্ষকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আদালতের রায়ে সন্তানের দায়ভার বাবাকে নিতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বাবার ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়কারী দিল সেতারা এই মামলার আদ্যোপান্ত জানেন। তিনি বলেন, আসামির ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই জরিমানার টাকা আদায়ের জন্য সার্টিফিকেট মামলা করতে হয়। সেই মামলা করা হয়েছে। কিন্তু তার লম্বা তারিখ পড়েছে। জরিমানার টাকা কবে আদায় হবে তা বলা যাচ্ছে না। টাকা পেলে তা থেকে রাষ্ট্র ২৫ হাজার টাকা কেটে নেবে। বাকি ৭৫ হাজার টাকা মেয়েটির পাওয়ার কথা।

রাজশাহী সরকারি নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ মনিজ্জা খাতুন মেয়েটির অবস্থার কথা শুনে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি পরীক্ষার ফরম পূরণ করার সময় অবশ্যই অবিবাহিত লিখতে হবে। অথবা স্বামী পরিত্যক্তা লিখতে হবে। তা ছাড়া সন্তান হওয়ার বিষয়টি পরীক্ষায় ধরা পড়বে। এই ক্ষেত্রে মেয়েটিকে স্বামী পরিত্যক্তা লিখতে হবে।

 মেয়েটি এখন তাঁর বাবার বাড়িতেই রয়েছেন। গতকাল সোমবার তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, নার্সিং কলেজে ভর্তির স্বপ্ন নিয়েই তিনি পড়াশোনা শুরু করেছিলেন। এখন এই যুদ্ধ করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। সমাজের মানুষের কটূক্তির ভয়ে বাড়ি থেকে বাইরে বের হতে পারেন না। আর নার্সিং কলেজে ভর্তির নিয়মকানুন শুনেই তাঁর সব বিদ্যা ভুল হয়ে যাচ্ছে। তিনি পড়াশোনাই করতে পারছেন না। আদালত ছেলের খোরপোশ দেওয়ার কথা বললেও তিনি পাচ্ছেন না। জরিমানার টাকা কবে পাবেন তার ঠিক নেই। এদিকে তাঁর দিনমজুর বাবার পক্ষে এই বাচ্চা প্রতিপালনসহ তাঁকে নার্সিং কলেজে পড়ানোর খরচ জোগানোর সামর্থ্য নেই। তিনি এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। জীবনের লড়াইয়ে তিনি হেরে যাচ্ছেন। এখন ভাবছেন কোনোভাবে তাঁর যদি একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। তাহলে নিজেও বেঁচে থাকতে পারতেন। সন্তানটাকেও মানুষ করতে পারতেন।