বার্ধক্যে শৈশবের বন্ধুত্ব

নিউইয়র্কের লাগার্ডিয়া বিমান বন্দরে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের আনাগোনা। কেউ আছেন ব্যক্তিগত ভ্রমণে পরিবার-পরিজন নিয়ে। কেউবা ব্যবসার কাজে। কেউ অফিসের কাজে। কেউ শিক্ষা সফরে। কেউবা চলে যান জীবনের প্রয়োজনে। কেউ আনন্দ ভ্রমণে বন্ধুদের নিয়ে। সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে সতেরো আঠারো বছর থেকে শুরু করে ত্রিশোর্ধ্ব পর্যন্ত অনেক দলই দেখা যায়। বৃদ্ধরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারে সঙ্গে থাকেন। কেউ কেউ থাকেন একাকি। চলতে পারেন না, তবু হুইল চেয়ারে ভর করে হলেও আসেন ছেলেমেয়েদের বাড়ি। নাতি-নাতনিদের কাছে, এটি প্রতিদিনের চিত্র। কিন্তু খুব সমবয়সী ষাট বছরের বেশি একদল ছেলেমেয়ের বন্ধুত্ব যেন চমকে দেওয়ার মতো! এটা ব্যতিক্রম বটে। কোনো সংস্থা বা চ্যারিটি সংগঠনের সহকর্মী হলেও কথা ছিল। কিন্তু না তাঁরা বন্ধু।

আমার লাঞ্চ ব্রেকের সময় ৪৫ মিনিট। ফুড কার্টে বসে খাবার সময় আমি সাধারণত মোবাইল ব্যবহার করি না। আবার কথাও বলি না। এটা আমার একটা অভ্যাস। ফোন কখনো চলে আসলে বলি, পরে কথা বলছি। কিন্তু ফুড কার্টে মানুষজনের কথাবার্তা চাল-চলন অনেক সময় চোখে পড়ে যায়। কানেও চলে আসে। ব্যতিক্রম হলে হয়তো নিজের অজান্তেই মনোযোগ চলে যায়। আমি তাঁদের লক্ষ্য না করলেও এড়ানোর উপায় নেই। কারণ আমি পেছনের টেবিলে ছিলাম। তাঁদের কথাবার্তা বাচ্চাদের মতো। বন্ধুত্ব দেখে ভালো লাগছিল। মনের মধ্যে, শরীরে ইতিবাচক শক্তি আপনাআপনিই সঞ্চিত হয়। আমি যেটি বেশি লক্ষ্য করলাম তা হলো, তাঁরা ছয়জনই প্রায় একই বয়সের। সুতরাং তাঁরা বন্ধু নিঃসন্দেহে।

তিন ভদ্রলোক নিজেদের মধ্যে পুরুষালি কথা বিনিময় করছেন। মানে রাজনৈতিক ব্যবসায়িক এমনতর কোনো অতি জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করছেন। তাঁদের বডি ল্যাংগুয়েজ অনেকটা সে রকম। আমার সামনের যে ভদ্র মহিলা বল প্রিন্টের শার্ট পরা, তিনি অন্য কারও অসুখ বিসুখের কথা বলছিলেন পাশের জনকে এবং পেছনের জনও মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। কারও গলায় একটা টিউমার হয়েছে—এ রকম। তারপর বিষয় বদলে নিউইয়র্কে তোলা ছবিগুলো নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হলেন। মোবাইলের গ্যালারি দেখতে দেখতে তাঁদের সেলফি, ছবি নিয়ে কথা বলছেন। হাসতে হাসতে বালিকার মতো গড়িয়ে পড়েছেন। এ বয়সেও আনন্দ করা যায়। বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায়। এটি কোনো বিষয় না। আধ্যাত্মবাদ বলে মানুষের আত্মা সব সময় একই। দেহ এক কস্টিউম মাত্র। সে দেহকে সতেজ রাখার জন্য প্রয়োজন মনোবল।

মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি থাকেন মানসিক কষ্টে। কত অভিযোগ-অনুযোগ। এককালে সবাই সুখী ছিলেন। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’—সেই দিন কোথায় গেল? এখন কেউ সুখী নয়। ছেলে দেখে না, মেয়ে দেখে না। আত্মীয়স্বজনও দেখে না। কেউ ফিরেও জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছি? এমনতর ছোট ছোট অভিযোগ সব পরিবারেই কম বেশি শোনা যায়। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা মানুষকে প্রতি সেকেন্ড মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে। শুধু বয়স্কদের নয়, এমনতর অনুযোগ সবার ঘরে ঘরে। অথচ যার প্রতি এই অভিযোগ সেও যে কাল বাঁচবে, তার নিশ্চয়তা কি? জীবনটাকে অনুযোগে না ভরে আনন্দ দিলেই জীবন গোলাপ হয়ে যায়। হয়ে যায় ভোরের আলোর মতো স্বচ্ছ।

উঠে চলে যাচ্ছিলাম। তাঁদের কথাবার্তায় কেমন জীবন আছে। মনে হলো জনগণকে জানানো উচিত। হঠাৎ থমকে আমি নিজেই তাঁদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। প্রথমেই বললাম, আপনাদের এই দলটা আমার খুব ভালো লেগেছে! তাঁরা মুগ্ধ! আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে, একেবারে স্কুল-কলেজের বন্ধুর মতো! আপনারা কি সবাই বন্ধু? তাঁরা সমস্বরে বললেন, হ্যাঁ বন্ধু। তাঁরাও নড়চড়ে বসলেন। এই বন্ধু জিনিসটাই পারে আমাদের বয়স নিমেষে কমিয়ে দিতে। এর চেয়ে বড় অ্যান্টি এইজিং ডোজ আর কিছু হয় না। এ জন্য দেখবেন, যখন আমরা স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে মিশি, তখন বয়স কেমন কমে যায়। হুঁশই থাকে না।

আমার সমর্থন পেয়ে তাঁরা তো খুব খুশি। পরিচয় দিলেন, তাঁরা ছোট বেলার বন্ধু। তবে পরে আত্মীয়তা বন্ধুত্বকে দৃঢ় করেছে। কালো মতো টি-শার্ট পরা দুজন ভদ্রলোক আপন ভাই। টি-শার্ট পরা দুজন নারীও বোন এবং তাঁরা সবাই সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। স্বামীরা নিজ নিজ স্ত্রীর একজন আরেকজনের বিপরীতে বসেছেন। তাঁরা শিকাগোতে থাকেন। নিউইয়র্কে বেড়াতে এসেছেন। তাঁদের হোটেলের ব্যবসা। ছেলেমেয়ে, নাতি সবাই আছেন। তাঁরা প্রায়ই বছরে এমন আনন্দ ভ্রমণে বের হন। ছবি চাইলে তাঁরা খুশি মনে পোজ দিলেন। তাঁদের মোবাইল বাড়িয়ে দিলেন। আমি অনেক ছবি তুলেও দিলাম। এক সময় বিদায় নিয়ে কাজে গেলাম। ইতিবাচক মানুষ দেখার মাঝেও আনন্দ আছে।

চিন্তা করে দেখলাম, আলো কেউ কাউকে দেয় না, চাঁদও না। আসলে আলো তৈরি করতে হয় বা খুঁজতে হয়। আকাশের দিকে ঘাড় না তুলে তাকালে পূর্ণিমার চাঁদও চোখে পড়ে না। ঘরের জানালা বন্ধ করে যদি ভাবি চাঁদের আলো আসবে, তবে তো সমস্যা! এ জন্য সব দরজা-জানালা উদার হস্তে খুলে দিতেই হয়। দেখব যে আলোয় ভরে গেছে ঘর। তেমনি নিজের মনের দরজা খুলে রাখলে অন্য সব কিছু সহজ মনে হয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মেঘও সরে যায়। আকাশের চাঁদ দেখা যায়। আর জীবন তো একটা সরল রেখা মাত্র। সোজাভাবে দেখলে সোজা, নতুবা আজন্ম বাঁকানোই থাকে। অন্যকে দোষারোপ না করে নিজেকে ঠিক করলেই জীবন সুন্দর হয়ে যায়।

একবার ভারতের এক সাধু বললেন, জীবন গোলাপের মতো যদি তুমি তা সেভাবে দেখতে পারো। অন্য দেশের এক পোপ বললেন, না জীবন হলো কাঁটার মতো। উনি বললেন, ‘সেই কাঁটা আস্তে করে সরিয়ে ফেললেই হয়’। জীবনের কাঁটাগুলো সরিয়ে গোলাপের সুবাস নিতেই হয়। কেউ সরিয়ে দেবে ভাবলে সে সুবাস পাওয়া খুব কঠিন। অনবরত কাঁটার আঘাত লাগবে। রক্তাক্ত আপনি নিজেই হবেন। কারও কাছে নয়, আপনার জীবন আপনার নিজের মাঝেই। ছোট্ট এ জীবনটাকে আনন্দে ভরিয়ে রাখুন।