রকমারি আড্ডা

রকমারি আড্ডার বাহারি অংশের সঙ্গে মিতালি অনেক দিনের। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আড্ডার রূপ পাল্টায়। সোনালি কৈশোরের আড্ডা ছিল বৈচিত্র্যময়। সুরমা নদীর পাড়ে বৈকালিক আসরে সিগারেট ফুকার দলে আমি ছিলাম ক্যাপ্টেন। কেননা ক্যাপস্টেন ব্রান্ডের সিগারেট প্যাকেট তো আমার পকেটে। শহরের ডান পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে ভারতের মেঘালয় পাহাড় থেকে নেমে আসা নানা সাইজের বোল্ডার পাথরে বসে যে আড্ডা হতো, তার বিষয় ও সময় দুটোই ছিল ব্যতিক্রমী। কখনো স্বল্পসময়। কখনো আবার বিকেল গড়িয়ে লাগোয়া বসত বাড়িতে সান্ধ্য বাতি জ্বলে ওঠা অবধি। কলেজ পাড়ায় আড্ডার ধরন ছিল ভিন্ন। চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে পড়তাম। থাকা পাশের হোস্টেলে। কলেজপাড়ায় থাকি বলে স্থানীয় লোকজন সমীহ করত, তবে ভালোবাসত। তখন ফাউ খাওয়াকে ছোটলোকদের কাজ বা চুরি–চামারির সমান বলে ধরা হতো।

চট্টগ্রাম শহরে আগ্রাবাদ এলাকার শেখ মুজিব রোডে জ্যাকস নামে একটি দামি ক্যাফে ছিল। এক মগ কফির দাম ছিল পাঁচ টাকা। আশপাশে বিশ্বের নামকরা বহুজাতিক কোম্পানির উঁচু পদের কর্মকর্তারা কাজের ফাঁকে জ্যাকসে বসে কফি পান করে নিজেদের চাঙা করতেন। সেই কফির দাম ছিল আমাদের জন্য বেশ চড়া। সে সময় হোস্টেলের সারা মাসের খাওয়া খরচ ছিল ১৬ টাকা। তাও তিন বেলা। সেখানে ৫ টাকা খরচ করা কারও কারও জন্য বিলাসিতা বটে। মা আদর করতেন বাড়াবাড়ি রকমের। তখন চট করে কাঙ্ক্ষিত নম্বর টিপে ফোন করা যেতো না। ট্রাঙ্ক কলে মাকে বলতাম খাওয়া–দাওয়ায় কষ্ট পাচ্ছি। হোস্টেলের খাওয়া খেতে পারি না। বলা মাত্র পরদিন টেলিগ্রাম মানিওর্ডারে টাকা চলে আসত সুনামগঞ্জ থেকে। ভ্যাসপা চড়ে আগ্রাবাদ এলাকার টেলিগ্রাম অফিস থেকে একজন কর্মকর্তা আসতেন। কখনো ৩০০ বা ৪০০ টাকা (সময়কাল ১৯৭৫/৭৬) হাতে তুলে দিয়ে বিস্ময়ের চোখে তাকাতেন। রুমমেটদের মধ্যে একজনের নাম স্বপন সাহা। চাঁদপুরের ছেলে। পরিবার শহরের অনেক পুরোনো হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী। সেও অবাক হয়ে যেত। অন্যজন ছাগলনাইয়ার শাহ আলম। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকত। অ্যাকাউন্টিং ভালো বুঝত।

মাসের যেকোনো সময় ধারকর্জের জন্য উপযুক্ত জায়গা। যেন বর্তমান যুগের এ টি এম মেশিন। তবে সঠিক পাসওয়ার্ড চাপ দিতে হবে। নম্বর বদল হলে সার্ভিস চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। মানে কর্জের টাকা ফেরত দিতে হবে ঠিক সময়। পকেটের টাকা আর কর্জ করে জোগাড় করে আনা টাকা বেশির ভাগ খরচ হতো বন্ধুদের নিয়ে খাবার–দাবারে। হোস্টেলের তৃতীয় তলায় পাশাপাশি দুই রুমে থাকতাম ছয়জন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার দুজন—ধনী বাপের ছেলে মুশতাক, অন্যজন সদ্য পেনশনে যাওয়া শিক্ষকের সন্তান ওসমান। ময়মনসিংহ শহরের এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, আর সিলেটের জুড়ি এলাকার মুনিম ভাই। পাঁচ নম্বর সিরিয়াল আমার। দুহাতে খরচ পাতি দেখে কলেজ সহপাঠীসহ হোস্টেলমেটরা ভাবত, আমি বোধ হয় ৪/৫টি চা বাগানের মালিকের সন্তান।

ছুটির দিনে পাঁচজনে মিলে খাবারের আয়োজন হতো। সংক্ষিপ্ত মেনু, পাঁচজনের জন্য চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ বহদ্দারহাট হাট থেকে আনা ৫ কেজি গরুর গোশত (দাম ছিল ৮ টাকা করে কেজি) ভুনা, বড় আকারের এক বাউল সাদা পোলাও সঙ্গে এক বাউল সালাদ। হোস্টেলের বাবুর্চি নুরু মিয়াকে বাজার সম্‌ঝে দিলে তিনি নির্দিষ্ট সময়ে রান্না শেষ করে রুমে পৌঁছে দিতেন। আমার অন্য আরেক বন্ধু ছিল সিলেটের পারবান। যিনি অকালে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। সেও কখনো জম্পেশ আড্ডাসহ রাজকীয় ভোজনে শরিক হতো।

শহরের একজন বুজুর্গ আউলিয়ার মাজার যে পরিবার দেখাশোনা করত, সে পরিবারের এক সদস্য আমার সহপাঠী ছিল। চট্টগ্রামের নানা অঞ্চল থেকে আসা ভক্তরা মাজারের দান বাক্সে মুক্ত হস্তে দান করতেন। সেই দান বাক্স হতে কৌশল (অনুমান করছি) করে আনা বিভিন্ন মূল্যমানের নোটে তার পকেট ভর্তি থাকত। লক্ষ্য করলাম, স্থানীয় সবাই ওকে অতিরিক্ত সমীহসহ ভয় করে। আমি একদিন তার পকেটে হানা দিলাম। জোর করে পকেট থেকে বের করে আনা টাকাগুলো কলেজের পাশের বিল্ডিং মোজাইক করা সিঁড়িতে বিছিয়ে মিল করার পাশাপাশি গুনে নেওয়া হলো। বন্ধুকে ফেরত দেওয়া হলো বিকেলে বাসায় ফেরত যাওয়ার বেবি ট্যাক্সি ভাড়াসহ সামান্য পকেট মানি। সংগ্রহ করা টাকার মোট পরিমাণ এক শ–এর কাছাকাছি ছিল। বাকি অংশ দিয়ে আড্ডার বিল পরিশোধ করা হলো সর্বসম্মতিতে। বন্ধুরা বলত, তোর সাহস তো কম না। পীর বংশের একজনের পকেট থেকে টাকা জোর করে বের করে আনলি। উত্তরে আমার জবাব, সে যেমন একজন পীর বংশের লোক, আমিও একজন বড় দরবেশ ফকিরের অনুসারী। তবে বংশভিত্তিক নয়, সিলেট জেলার কামিলে মুজাদ্দিদ হজরত শাহজালালের জন্মস্থান সিলেট জেলার অধিবাসী বলে। অধিকন্তু আমাদের পীর হুজুর তার পীরের চাইতে অনেক সিনিয়র। আমার দাবি কি যথার্থ নয়? সবার একযোগে উত্তর, অবশ্যই অবশ্যই। পীর বংশের বন্ধুটি মাসখানেক রাগ করে আমার সঙ্গে কথা বলেনি।

সময়কাল বয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে জল জোছনার শহর সুনামগঞ্জে থিতু হলাম। পারিবারিক ব্যবসার ভার আমার কাঁধে ন্যস্ত হলো। সারা দিন কাজের শেষে অফিসে চলত ম্যারাথন আড্ডা মধ্য রাত অবধি। জেলা শহরের ছোট–বড় নেতাসহ অনেক সরকারি কর্মকর্তারা যোগ দিতেন। চলতো অনেক রাত অবধি।

শবে বরাতের পবিত্র রাতে সারা রাত ইবাদতের লক্ষ্যে সন্ধ্যায় গোসল সেরে সবাই একসঙ্গে হাজির আমার অফিসে। মাগরিবের নামাজ শেষে বাকি সময় ওয়াজ নসিহত দোকানেই চলত। সঙ্গে বাসা হতে পাঠানো চালের রুটি ও নারকেল দিয়ে ঘন দুধের ফিরনির সদ্ব্যবহার।

শেষমেশ কড়া লিকারের এক কাপ চা। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্রবার দিনভর তাসের আড্ডা বসতো রুকেশদের বাসার দোতলায়। বিরামহীন আড্ডা। কতক্ষণ পর পর চাচির (রুকেশের আম্মা) পাঠানো চা ও নাশতা চলে আসত দোতলায়। চায়ের সঙ্গে টোস্ট নয়তো গ্লুকোজ বিস্কুট। পরে আসত ঘরে বানানো শিঙারা। দুপুরের রকমারি খাবারের আয়োজন করে ওপরে দোতলায় পাঠিয়ে দিতেন।

জেলা ক্রীড়া সংস্থার ১১ বছর কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনকালে ক্রীড়া ভবনে জেলার সর্বোচ্চ কর্মকর্তাসহ প্রবীণ ক্রীড়াবিদদের নিয়মিত আড্ডা বসত। প্রবীণ শিক্ষাবিদ, ক্রিকেট ও টেনিস খেলোয়াড় প্রয়াত মোহাম্মদ আলী স্যার। জেলার নামকরা ফুটবল প্লেয়ার ও শিক্ষক মরহুম আসদ্দর আলী স্যার। ক্রীড়া ভবন নবীন আর প্রবীণ ক্রীড়াবিদদের উপস্থিতিতে সকাল সন্ধ্যা গম গম করত। প্রতি মাসে নানা উপলক্ষে চাঁদা তুলে মাসিক ডিনারের আয়োজন হতো। শহরের নামীদামি ব্যক্তিত্ব ছাড়াও জ্যেষ্ঠ ক্রীড়াবিদসহ আরও অনেকে অংশ নিতেন ডিনার পার্টিতে।

সাবেক ক্রীড়াবিদের সঙ্গে স্থানীয় ক্রীড়া পৃষ্ঠপোষকদের অংশগ্রহণে মধ্যরাত অবধি খাওয়া–দাওয়াসহ জম্পেশ আড্ডা চলত।

অর্ধ ডুবন্ত আড্ডার গল্প বলি। ভরা বর্ষার মৌসুমে জেলা আনসার অফিসে আড্ডার আয়োজন। কাঠের পাটাতনে পানির অনুভব পেলেন আড্ডার এক সাথি। খাবার পানি অসাবধানতা বশত মেঝেতে পড়েছে মনে করে বিষয়টি আমলে নিলেন না। আড্ডার সাথিদের আজ কেউ কেউ অবসরে কেউবা এখনো আইন পেশায় অনেকে ইহজগতে আর নেই।

মেঝেতে পানি বেড়ে গেল আচমকা। চেয়ার ছেড়ে দুটো টেবিল একত্র করে সবাই বসে পড়লেন টেবিলে। আড্ডা শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নাই। আড্ডা চলছে তো চলছেই। উপায়ন্তর না দেখে অফিসের পিয়ন এসে বলল, সাহেবরা আড্ডা শেষ করে নিজ নিজ বাড়ি যান। শহর বন্যার পানিতে প্রায় ডুবু ডুবু। আপনারাও প্রায় ডুবে আছেন। ১৯৯২ সালে জেলা প্রশাসন ও জেলা পাবলিক লাইব্রেরির যৌথ উদ্যোগে শহরের পাবলিক লাইব্রেরি প্রাঙ্গণে শুরু হলো মাসব্যাপী বই মেলা। আমার পরিচালনায় খোলা হলো হালকা মজাদার খাবারের দোকান। বন্ধু জাহানুরের প্রস্তাবে দোকানের নাম দেওয়া হলো আড্ডা। অনেক পর একজন সুহৃদের কাছ থেকে জানলাম, আড্ডা নামটি বন্ধুর স্মৃতির পত্রে লেখা কয়েক ছত্র রঙিন গদ্য, যা অনেকবার পঠিত হয়েছে বিখ্যাত মতিহার ক্যাম্পাসে (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)। সেরা খাবারের দোকানের পুরস্কার মিলেছিল সেবার।

মহৎ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আড্ডার গল্প বলা শেষ করতে চাই। ১৯৯৩ সালে প্রয়াত কবি মউজদীন ভাইয়ের উদ্যোগে হাসন উৎসবে এলেন সাহিত্যিক ও লেখক প্রয়াত হুমায়ুন আহমদ। সঙ্গে আরও ছিলেন কবি শামসুর রহমান ও বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক লেখক আশরাফ সিদ্দিকী। ভোরবেলা অতিথিদের নিয়ে আসা মাইক্রোবাস থামল সার্কিট হাউসের গাড়ি বারান্দায়।

অতিথিদের খাবারের বিষয় আমাকে দেখতে হয়েছিল। রাতের খাবার শেষে অন্য অতিথিরা যখন শয্যায়, লেখক হুমায়ুন আহমদের মাথায় চাপল হাসন রাজার মাজারে যাবেন। গল্প হবে, গান হবে, রাতভর চলবে আড্ডা। স্যারকে নিয়ে সদলবলে মাজারে গিয়ে দেখা গেল, মাজার প্রাঙ্গণ গঞ্জিকা সেবীদের দখলে। এদিক-ওদিক কতক্ষণ হেঁটে প্রাঙ্গণকে সরেজমিনে দেখে মনে হলো প্রাঙ্গণটি আড্ডার জন্য সুবিধাজনক নয়।

রাতের শেষ প্রহরে সুনামগঞ্জের ঐতিহাসিক আড্ডার সেরা স্থান সুরমা নদীর পাড়ে লঞ্চ ঘাটে জড়ো হলাম সবাই। হুমায়ুন আহমদ স্যার তো আছেন আড্ডার মধ্যমণি হয়ে, সঙ্গে আরও ছিলেন প্রয়াত ইকবাল ভাই।

অন্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কণ্ঠশিল্পী সেলিম চৌধুরী ও অভিনেতা তুহিন। আরও ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক পীর হাবীব। লঞ্চ ঘাটে মোল্লার দোকানের ঘন দুধের ঘন লিকারের মজাদার চায়ের সঙ্গে গরম-গরম ডালপুরি। আড্ডা জমতে আর কি চাই? বিশেষ করে হুমায়ূন স্যারের নানা মেজাজের গল্পের স্মৃতির রেলগাড়ির ঝিক ঝিক আওয়াজ নিয়ে আজও ফিরে যাই শৈশবের আমার ছোট্ট শহর সুনামগঞ্জে।