প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয়

ফাওজুল কবির খান
ফাওজুল কবির খান

অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, দেশে খুব দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সেটি কত দিন

টিকবে, তা নিয়ে সংশয়ে আমি। ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা আছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যাপক হারে দুর্নীতি। ১৯৯১ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের হাত ধরে অর্থনীতিতে যে বড় সংস্কার হয়েছে, সেটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। এরপর কিন্তু আর বাংলাদেশের আর্থিক খাতে কোনো সংস্কার হয়নি। আমার ভয় সেখানে।

নিউইয়র্কে বেড়াতে আসা ফাওজুল কবির খান ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের উন্নয়ন, অর্থনীতি ও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৭৯ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন ফাওজুল কবির খান। শুরুটা চট্টগ্রাম শুল্ক ভবন থেকে। শেষ করেছেন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে। আমেরিকার বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি শেষে দেশে ফিরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে দীর্ঘদিন কাজ করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে পরের কয়েক বছর বিভিন্ন সরকারের অর্থমন্ত্রীদের বাজেট বক্তৃতার খসড়া তৈরি করার সুবাদে দেশের অর্থনীতিকে খুব নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ পান তিনি। দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে গঠিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইডকলের নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। দেশে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থার যে ব্যাপক প্রসার, সেটির মূলেও অবদান এই অর্থনীতিবিদের।

দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ফাওজুল কবির বলেন, আমাদের অর্থনীতিতে সংস্কারটা অনেক আগে থেকে প্রয়োজনীয় হয়ে গিয়েছিল। বেশ কয়েক বছর ধরে সেটি করা হয়নি। ব্যাংকিং খাত, রাজস্ব খাতসহ পুরো অর্থনীতির সংস্কার জরুরি। তা না হলে, অর্থনীতি যেকোনো সময় হঠাৎ করে থমকে যেতে পারে।

ভারতের সবশেষ অর্থনৈতিক স্থবিরতার কথা উল্লেখ করে ফাওজুল কবির বলেন, তাদের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। গেল ৭ বছরে এটি সর্বনিম্ন। উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতির কারণ হচ্ছে, তারা সংস্কারকে গুরুত্ব দেয়নি। মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী থাকাকালে যে সংস্কার করেছিলেন, সেটার সুফল এত দিন ভোগ করেছে ভারত। কিন্তু, সঠিক সময়ে আবার সংস্কার না করার মাশুল দিতে শুরু করেছে তারা। ইতিমধ্যে, ভারতের গাড়ি শিল্পে ধস নেমেছে। হাজার হাজার কর্মী বেকার হচ্ছে। আরও নানা জটিলতার মুখোমুখি ভারত। আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আগেই সংস্কারে উদ্যোগী হতে হবে।

বাংলাদেশে দুর্নীতিকে বড় একটা সমস্যা হিসেবে দেখছেন ফাওজুল কবির খান। বললেন, আগে একসময় সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন কম বলে দুর্নীতি হয় বলা হতো। বারবার পে কমিশন হওয়ার কারণে, এখন সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন, সুযোগ–সুবিধাদি কম নয়। তারপরও দুর্নীতিও বাড়ছে। এর কারণ হচ্ছে, সরকারের নীতিমালা। যারা দুর্নীতি করে না, তাদের উৎসাহ দিতে হবে। শুধু আর্থিক সুবিধা যে দিতে হবে, তা নয়। ভালো পদায়ন করতে হবে। প্রণোদনা দিতে হবে। আর, যারা দুর্নীতি করে তাদের শাস্তি দিতে হবে। সেটাতো হচ্ছে না। দুর্নীতির দায়ে কোনো সচিবের শাস্তির নজিরতো নেই। কোনো মন্ত্রীর শাস্তি হয়নি। কেরানির দুর্নীতি, চুনোপুঁটির দুর্নীতি ধরে তো দুর্নীতি নির্মূল হবে না। যে মন্ত্রী কিংবা সচিবের মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুর্নীতি হয়, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশের সবাই জানেন, বড় দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক কে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিবাজ সচিব কে। তাদের ধরা হচ্ছে না। যত দিন তাদের ধরা হবে না, তত দিন দুর্নীতি নির্মূলের সব আয়োজন আইওয়াশ মনে হবে।

দেশের সাধারণ মানুষ ন্যায়নিষ্ঠ উল্লেখ করে ফাওজুল কবির খান বলেন, এরাই দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। দেশের জন্য তাদের অবদান অনেক। অথচ বিনিময়ে তাদের চাহিদা অনেক কম। অল্পতে তুষ্ট তারা। একজন কৃষক সারা দিন কাজ করেন। তার খাবার কী দেখুন। পান্তাভাত আর কাঁচা মরিচ। পরেন লুঙ্গি, গেঞ্জি। খুব অল্প খরচ। এরাই আমাদের ভদ্রলোক বানিয়ে রেখেছে। জিডিপিতে তাদের যে অবদান, তারা যদি সেটার হিস্যা চাইতো, তাহলে এই ভদ্রলোকদের অবস্থা করুন হয়ে যেতো। এরা দুর্নীতি করে না। অথচ, দুর্নীতির খেসারত দিচ্ছে। যে দুর্নীতিটা করছে ওপরতলার মানুষেরা।

দুর্নীতি বন্ধের জন্য নতুন কোনো আইনের দরকার নেই বলে মনে করেন অবসরে যাওয়া এই সরকারি আমলা। তাঁর যুক্তি, যে আইন আছে সেটির প্রয়োগ হওয়া দরকার। সদিচ্ছা দরকার। ছোটখাটো বাধাগুলো দূর করার ইচ্ছে সরকারের থাকতে হবে। পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিচারে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার বিধান বাদ দেওয়া দরকার। একজন সাধারণ মানুষের দুর্নীতির বিচার যে আইনে হয়, সরকারি কর্মকর্তারাও সে আইনে বিচারের মুখোমুখি হবেন।

সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন সাবেক এই সচিব। বললেন, ‘এটা ভোটের রাজনীতি। সচিব, ডিসি, ইউএনও, এসপি, ওসিদের ভোট নিতে লাগে। তাদের ব্যবহার করা হয়। এগুলো আসলে ব্যাড কম্প্রোমাইজ। এ ধরনের কম্প্রোমাইজ রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর।’