শিক্ষায় চাকরিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশিরা

ইমিগ্রেশন বা অভিবাসনের দেশ আমেরিকায় পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশিরা তাদের অবস্থান দৃঢ় করছেন। আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের এক-তৃতীয়াংশের গড় বার্ষিক আয় ৯০ হাজার ডলারের বেশি। ১৫ শতাংশ বছরে গড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার ডলারের বেশি আয় করেন। একটি অগ্রসর অভিবাসী গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত আমেরিকায় বাংলাদেশিদের মধ্যে ২৫ শতাংশের বেশির রয়েছে স্নাতক ডিগ্রি, যা গড় আমেরিকানদের চেয়ে বেশি। আমেরিকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্য থেকে এসব জানা গেছে।
সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় আগে থেকেই বাঙালিদের মধ্যে বিদেশে

পাড়ি জমানোর ঝোঁক ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে উনিশ শতকের শুরু থেকেই বাঙালিরা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। তেমনি ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অভিবাসী হিসেবে বাংলাদেশিদের আমেরিকায় পাড়ি জমানোর হার বাড়তে থাকে। অনেকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজে করে এ দেশের বিভিন্ন বন্দরে আসে। সত্তর-আশির দশক থেকেই বাংলাদেশিদের মধ্যে অভিবাসী হিসেবে এ দেশে আসার হার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ওপি-ওয়ান, ডিভি লটারি, পোড়াশোনাসহ নানা প্রোগ্রাম এবং পারিবারিক ভিসার মাধ্যমে ১৯৭০ সাল থেকে হাজার হাজার বাংলাদেশি বৈধভাবে আমেরিকায় আসতে থাকে।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমেরিকায় বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ১৯৭৩ সালে ১৫৪ জন, ১৯৭৪ সালে ১৪৭ জন, ১৯৭৫ সালে ৪০৪ জন, ১৯৭৬ সালে ৫৯০ জন বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে আমেরিকায় আসে। এসব অভিবাসীর বেশির ভাগই ছিল তরুণ, যুবক যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে দেশ ছাড়তে থাকে। ১৯৮০ সালের দিকে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ বাংলাদেশি আমেরিকায় আসে। ইতিমধ্যেই ২০০ বাংলাদেশি আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করে। তারা আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ক্যালিফোর্নিয়াতে আধিক্য ছিল।

১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৮ হাজার ৮৫০ জন বাংলাদেশি আমেরিকায় আসে। তবে ২০০০ সালের পর থেকে এই সংখ্যা হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে। এ সময়ে প্রায় ৪৮ শতাংশ বাংলাদেশি অভিবাসী আমেরিকায় প্রবেশ করে। বর্তমানে কয়েক লাখ বাংলাদেশি আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসবাস করে। এদের মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশ বাংলাদেশি আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেছে। এ সংখ্যা প্রমাণ করে, ২০০০ সালের পর আমেরিকায় প্রবেশ করে নাগরিকত্বের জন্য উপযুক্ত হওয়ার পরই বেশির ভাগ মানুষ আবেদন করেছিলেন।

বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এসব বাংলাদেশি অভিবাসী। পারিবারিক সূত্র, চাকরি, শিক্ষা, জীবনমানের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শহরে থিতু হয়েছেন সবাই। পিউ রিসার্চ সেন্টারের হিসাবমতো, নিউইয়র্ক শহরে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশির বসবাস, যা লাখেরও বেশি। এরপরে যথাক্রমে রয়েছে ওয়াশিংটন ডিসি, ক্যালিফোর্নিয়া, ডেট্রয়েট, ডালাস, ফিলাডেলফিয়া, বাফেলোর মতো শহর। এসব শহর ছাড়াও আরও বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশিদের পদচিহ্ন রয়েছে।

সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় আমেরিকায় এসেই বাংলাদেশিরা থেমে থাকেনি। নিজেদের অবস্থান শক্ত করার জন্য শিক্ষাদীক্ষায় নিজেদের এগিয়ে নিয়েছে। বহির্বিশ্বের মানুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশি অভিবাসীরা শিক্ষায় অন্যান্য সাধারণ আমেরিকান জনগণ থেকে এগিয়ে আছে। প্রায় ২৮ শতাংশ বাংলাদেশির স্নাতক ডিগ্রি আছে, যেখানে সাধারণ আমেরিকান জনগণের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২০ শতাংশ। প্রায় ২৫ শতাংশ বাংলাদেশির মাস্টার্স, পিএইচডি বা তারও বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে। অন্যদিকে অন্যান্য আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা মাত্র ১১ শতাংশ।

বার্ষিক আয়ের দিক থেকেও বাংলাদেশিরা পিছিয়ে নেই। প্রায় ৩২ শতাংশ বাংলাদেশির বার্ষিক আয় প্রায় ৯০ হাজার ডলারের ওপরে এবং ১৫ শতাংশের ক্ষেত্রে আয় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজারের ওপরে। আবার এটিও সত্য, অনেক বাংলাদেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। অনেকে পরিবার, সন্তানাদি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তবে এখানে কেউই থেমে নেই। প্রতিদিন লড়াই করে টিকে আছে।

কর্মক্ষেত্রেও বাংলাদেশিরা পিছিয়ে নেই। কেউই এখানে বসে থাকতে পছন্দ করে না। ১৬ বছর থেকেই বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি মেলে। তাই সবাই জীবিকার তাগিদে, নিজের পকেট খরচ চালানো, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কাজে নেমে পড়ে। প্রায় ৬১ শতাংশ বাংলাদেশি বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে জড়িত, যাদের বেশির ভাগই রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি শপে কাজ করে। এদিক থেকে বাংলাদেশি নারীরা একটু পিছিয়েই আছেন বলা যায়। মাত্র ৩৯ শতাংশ নারী কাজের সঙ্গে জড়িত, যেখানে অন্যান্য আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এই হার ৫৮ শতাংশ। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে ভাষাগত দুর্বলতা, যাতায়াতে সমস্যা, পারিবারিক বাধা ও কাজ করতে অপারগতা। আশা করা যায় ভবিষ্যতে এর উন্নতি হবে।

প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে রেমিট্যান্সও। বিশ্বব্যাংকের ২০১৫ সালের এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশ রেমিট্যান্সের দিক দিয়ে বৃহত্তম প্রাপক দেশগুলোর একটি, যেখানে প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠানো হয়। এক জরিপ বলছে, বাংলাদেশি আমেরিকানরা দেশে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতো, বাংলাদেশি আমেরিকানরা ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে ১৯৯৭ মিলিয়ন, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ১৮৪২ মিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

নানা প্রতিকূলতার পরও আমেরিকায় আসার পর বাংলাদেশিরা শুরুর দিকের ধাক্কা ভালোভাবেই সামাল দিয়ে উঠছে। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক সংগঠন হচ্ছে, যেগুলা একে অন্যের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসছে। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বাংলাদেশিদের সম্পৃক্ততা বাড়ছে। ব্যবসা, চাকরি ও কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করছে। আমেরিকার যেসব শহরে একসময় জনবসতির অভাব ছিল, এ রকম শহরেও বাংলাদেশিরা এখন বসতি স্থাপন করতে শুরু করছে। বললে অত্যুক্তি হবে না, আমেরিকার বুকে বাংলাদেশিরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছে।