বিলেতে আদর স্নেহ ভালোবাসায়

আজকের লেখাটি শুরু করছি ভ্রমণ নিয়ে বিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক মার্ক টোয়েনের উক্তি দিয়ে। তিনি বলেছেন, ‘আজ থেকে বিশ বছর পর আপনি এই ভেবে হতাশ হবেন, আপনার পক্ষে যা যা করা সম্ভব ছিল, তা আপনি করতে পারেননি। তাই নিরাপদ আবাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ুন। আবিষ্কারের জন্য যাত্রা করুন, স্বপ্ন দেখুন আর শেষমেশ আবিষ্কার করুন।’

সময়ক্ষেপণ না করে তাই এ বছর ইউরোপ ভ্রমণে বের হলাম। ৩০ জুলাই যাত্রা করে ৩১ তারিখে নেদারল্যান্ডস পৌঁছাই। ছয়দিন নেদারল্যান্ডস থেকে ৬ আগস্ট স্কিফোল এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইবি এয়ারলাইনসের ছোট বিমানে করে লন্ডনের সিটি এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছালাম।

ওয়াইফাই কানেক্ট করে জানলাম, ছোট বোন নার্গিস আর খাইরুন বাইরে অপেক্ষা করছে। আমাদের নিতে এসেছে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই, মানুষের ভালোবাসা জড়িয়ে রাখে মিহি শালের মতো। সিটি এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পার হয়ে লাগেজ বেল্টে এসে দেখি লাগেজ এসে গেছে। বাইরে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাইরুন আর নার্গিসের উষ্ণ ভালোবাসার আলিঙ্গন। ফুলের শুভেচ্ছা।

আমার ভেতরে তখন নানারকম অনুভূতি। সেই শিশু বেলা থেকে বিলেত মানে লন্ডন শুনে শুনে বড় হয়েছি। বৃহত্তর সিলেটের অধিকাংশ পরিবারের কেউ না কেউ বিলেতে থাকতেন। বিলেত দেশটা কেমন, তা দেখার তাই আগ্রহ ছিল। লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্ট সম্পর্কে আগেই অনেক কাহিনি শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাই সিটি এয়ারপোর্টকে বেছে নিয়েছি। ছোট এই এয়ারপোর্টে একদম ঝক্কি ঝামেলা নেই। এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যেতে যেতে দেখলাম, নিউইয়র্কের সঙ্গে বেশ মিল এই শহরের। কিন্তু সবচেয়ে উত্তেজিত আমি যখন দেখলাম, টেমস নদীর ওপর দিয়ে ক্যাবল কার।

সেদিনই রাতে শাহেদা আপা, সৈয়দা, ইয়াকুত আর বড় আপা আসলেন। আপাদের সঙ্গে অনেক বছর পর দেখা হলো। সৈয়দা ও সারা আমার ছোটবেলার বন্ধু। সারাও আসল। গলা জড়িয়ে ধরে আমরা সেই ছেলেবেলাকে খুব খুব করে ফিরে পেলাম। নার্গিস বলল, সাত দিনের প্রায় প্রতিদিন দাওয়াত আছে। আমরাও জানালাম, আমরা সারা দিন ঘুরে বেড়াব আর রাতে ডিনার করে আড্ডা দিয়ে ঘরে ফিরব।

পরদিন দুপুরের পর পরই হুসনা আসল। আমরা সবাই দল বেঁধে রানির প্রাসাদ দেখতে বাকিংহাম প্যালেসের উদ্দেশ্যে বের হলাম। দোতলা বাসে করে গেলাম আন্ডারগ্রাউন্ডে, ট্রেন দিয়ে ট্রাফালগার স্কয়ারের পাশ দিয়ে আমরা বাকিংহাম প্যালেসে গেলাম। লেডি ডায়ানার বিয়ের শকট টানা ঘোড়ার গাড়ির চলার সেই পথ, সেই গেট, সেই প্রাসাদ। আমি ১৯৮১ সালে দেখা সেই স্মৃতির সামনে এখন। লন্ডনে দোতলা বাসে সফর করতে গিয়ে পুরো ছোটবেলা ফিরে এল। আশির দশকে যারা ঢাকায় দোতলা বাসে চড়ে শহর ঘুরে দেখেছে, তারাই এর মাধুর্য বুঝতে পারবে। যদিও এদের ব্যবহার্য দোতলা বাস বেশ চাকচিক্যময় আর ঢাকার বাস রংচটা, পুরোনো। তবুও ওপর তলায় সামনের আসনে বসে ঘুরতে ঘুরতে আমরা দেখে ফেললাম, বিগ বেন, হাইড পার্ক, ওয়েস্ট মিনিস্টার অ্যাবে, ট্রাফালগার স্কয়ার। বাকিংহাম প্যালেসে পৌঁছে লেডি ডায়ানার সেই রাজকীয় বিয়ের কথা মনে পড়ছিল। সৌভাগ্য বলতে হবে, প্রাসাদের তিনটি গেটের একটি সেদিন খোলা ছিল। অস্ত্রসহ ব্রিটিশ দোররক্ষীর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুলতে পারলাম।

এখনো যত্ন করে রাখা রয়েছে আগেকার লাল টেলিফোন বুথ। এ ছাড়া রয়েছে লাল রঙের খুব সুন্দর পোস্ট বক্স। এতই সুন্দর যে, সবাই মিলে ছবি তোলার লোভ সামলানো দায়।

কাচের ভবন শার্ড। ৯৫ তলা কাচের ভবন দ্য শার্ড। লন্ডন ব্রিজের কাছে এটি অবস্থিত। এর ডিজাইন করেছেন ইতালিয়ান স্থপতি রেনজো পিয়ানো। কোকাকোলা লন্ডন আই। এটি কিন্তু বেশ সুন্দর ব্যবস্থা। এখানে একটি অতি উচ্চ নাগরদোলা রাখা আছে। নাগরদোলায় বসার জায়গাগুলো পুরোপুরি বদ্ধ ও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। চারদিক আটকানো, কাজেই এই নাগরদোলাতে একেবারেই পড়ার ভয় নেই। ভেতরে খুব ভালো বসার জায়গা আছে। খুবই মন্দ-মন্থর গতিতে ঘোরে, কাজেই মাথা ঘোরা বা আনুষঙ্গিক অসুস্থতার সম্ভাবনা প্রায় নির্মূল।

ব্রিটিশ মিউজিয়াম, এতে আছে পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সব ইতিহাস, শিল্প ও সংস্কৃতির ভান্ডার। এতে রয়েছে মিসরের মমি থেকে শুরু করে রোসেট্ট স্টোন, মেসোপটেমিয়ান ভাস্কর্য, ইস্টার আইল্যান্ডের শিল্পকর্মসহ অনেক কিছু।

লন্ডনকে দেখে নিউইয়র্কের কথা না মনে পড়ে উপায় নেই। কেমন যেন ভীষণ আপন, আপন ভাব। রাস্তাঘাটে ভিড়, ফুটপাতেও বেশ অনেক লোক, কাজের দিনেও দুপুর বেলায় বহু লোক রাস্তায় ঘুরছে। হাইড পার্কেও বেশ লোক সমাগম, সব মিলিয়ে ‘সরগরম কিংবা বাইরে রাস্তা পানের দোকান’। অবশ্য রেডিওতে হঠাৎ কোন পুরোনো গান বাজছে কিনা জানি না, শোনা হয়নি।

টাওয়ার ব্রিজ, বিশাল ব্রিজ এটি। ১৮৮৬ সালে এই ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হয়। কাজ চলে আট বছর। টেমস নদীর দুপাশের মানুষকে এক করেছে এই ব্রিজ। এই ব্রিজে দুটি বিশাল গম্বুজসদৃশ স্থাপনা রয়েছে। সেই গম্বুজের মধ্যে অনেকটা লাইব্রেরির মতো। অনেক মানুষ এই ব্রিজে হাঁটেন। আমরা দুবার হেঁটেই পার হয়েছি। একবার দিনের বেলায় আর একবার সন্ধ্যার পর। দিন আর রাতের সৌন্দর্য পুরাই ভিন্ন। ব্রিজে মজার একটি বিষয় আছে। বড় জাহাজ যাতায়াত করলে ব্রিজটি মাঝ থেকে দুপাশের ডালা খুলে ফেলে। সে সময় দুপাশের গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে। সেই দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য অবশ্য আমাদের হয়নি। ব্রিজটি লম্বায় ১০৮ ফুট। এর উচ্চতা ২১৩ ফুট। বিশাল টাওয়ারের মতো আকৃতি। সে জন্যই নাম রাখা হয়েছে টাওয়ার ব্রিজ। ১৮৯৪ সালের ৩০ জুন উদ্বোধন হয়। 

আমার বন্ধু মুকুল আহমেদ বিশিষ্ট নাট্য পরিচালক। সে একদিন ঘুরে বেড়াল দিনমান আমাদের নিয়ে ডিএলআর বা ডকল্যান্ড লাইট রেলওয়েতে। আর আমাদের জানাল, লন্ডন টাওয়ার ব্রিজের পাশেই রানির আরেকটি প্রাসাদের কথা। রানি যখন যে প্রাসাদে থাকেন, তখন পতাকা তোলা থাকে। আর রানি না থাকলে পতাকা নামানো থাকে। সেদিন পতাকা উড়ছিল হাওয়ায়, তার মানে রানি এই প্রাসাদেই ছিলেন। টেমস নদীর যে ঘাট থেকে রানি নৌভ্রমণে যান সেখানেও গেলাম, ছবি তুললাম।

আর প্রতি রাতে দাওয়াত। এত আন্তরিকতা, এত মায়া–মমতা মনে হয় যেন মা বা বড়বোনের বাড়ি বেড়াতে এসেছি। খাওয়াদাওয়ার পর গিফট আর নগদ পাউন্ড নিয়ে ফিরে আসা। এখানে সবাই খুব মায়া মমতায় জড়াজড়ি করে আছেন। আমাদেরও সিক্ত করেছেন তাঁদের আদরে স্নেহে ভালোবাসায়।