বাসচালক হতে চেয়েছিলেন তিনি

অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। আর সে চেয়েছিল বাসচালক হতে!

কুমিল্লায় সত্তর দশকে আখতার হামিদ নামে একজন বনেদি মানুষ ছিলেন। তাঁর মেয়েরা গাড়ি চালাতেন। ছোট্ট আলেয়া চৌধুরীর ইচ্ছা হলো, সেও ওদের মতো গাড়ি চালাবে। একদিন সে বাস চালক হবে। এ জন্য ড্রাইভিং শিখে ফেলে সে। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তখন সামাজিক প্রেক্ষাপট এমন ছিল না যে, মেয়েরা রাস্তায় বাস নিয়ে বের হবে! ছোটখাটো সেই মেয়েটির ছিল আকাশ ছোঁয়া সাহস। সে সোজা গিয়ে ধরল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধু খুব স্নেহ করতেন ওই কিশোরীকে। পত্রিকার হকারের কাজ করে বলে খুব আনন্দিত হয়ে বলেছিল, তুই কি আমার বাসায় পত্রিকা দিতে পারবি? মেয়েটি বলল, ‘পারব। কিন্তু আমি তো আপনার বাসা কোথায় জানি না।’ তখন বঙ্গবন্ধু একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলেন-‘৩২ নম্বর’।

বাংলাদেশের প্রথম বাস চালক হয়ে ইতিহাস গড়া হয়নি সেদিনের সেই কিশোরীর। অনেক কিছুই করা হয়নি। নিয়তি তাকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে। জীবনভর অমানুষিক পরিশ্রমের পরে যখন ভেবেছিলেন, থিতু হবেন জীবনে, তখন কঠিন অসুখে আক্রান্ত হলেন। নিয়তি তাঁকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে প্রমিথিউসের মতো। তবু তিনি বারবার এসে দাঁড়ান আমাদের মাঝে। আমাদের আলোকিত করেন। আমাদের অনুপ্রাণিত করেন তাঁর কথামালায়। ২২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার অনুষ্ঠানে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা শোনার সুযোগ ছিল একটি মূল্যবান অভিজ্ঞতা। আমরা দাঁড়িয়ে সম্মান জানাই তাঁকে।

আলেয়া চৌধুরী বাঙালিদের মধ্যে একজনই। তাঁর মতো উত্থানপতনে ভরা সংগ্রামময় জীবন সারা পৃথিবীতেই বিরল। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়তো নন তিনি। নিয়তি অস্বীকার করে কে পারে এভাবে শূন্য হাতে একের পর এক বাজি ধরতে! কেউ পারে না। এতটা মনের জোর কারও থাকে না। আলেয়া চৌধুরী একজন বিশ্বাসী মানুষ। বিশ্বাস তাঁর সৃষ্টিকর্তার প্রতি। অক্ষরজ্ঞান হওয়ার পরে বয়স যখন আট কি নয় বছর, তখন আল্লাহর কাছে খোলা চিঠি লিখে বসেন তিনি। আর নিজের ওপর বিশ্বাস তাঁর এতটাই যে, গ্রাম্য সালিসে ফতোয়াবাজদের মুখে জ্বলন্ত পাটকাঠি ছুড়ে দিতে একটুও ভয় পান না। ভয় পান না তার পরিণাম নিয়ে। সেই যে মাত্র নয় বছর বয়সে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলিত হয়েছে মস্তিষ্কে, জীবন ভর তা আর নেভেনি। অসুখ নামক নিয়তির বিরুদ্ধে লড়াই সত্ত্বেও নিজের অস্তিত্বকে জানিয়ে চলেছেন আলেয়া চৌধুরী।

অনেক দিন ধরে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা অফিসে বৃহস্পতিবারের আড্ডায় আসতে চাচ্ছিলেন আলেয়া চৌধুরী। কিন্তু নানা কারণে সেটা হয়ে উঠছিল না। জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হকের নিউইয়র্ক সফর উপলক্ষে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী যখন একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চাইলেন, তখন আমি এই অনুষ্ঠানে আলেয়া আপাকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব দিলাম। ইব্রাহীম চৌধুরী তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানালেন। আমরা প্রথম আলো পরিবার যেন সম্মানিত হলাম আলেয়া আপার আগমনে। আপ স্টেট থেকে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে এলেন তিনি। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে হাতে গোনা যে কজন মেয়ে গাড়ি চালনা শিখেছিলেন, তিনি তাদের একজন। কুমিল্লার উত্তর চর্থার একটি সাধারণ মেয়ে এখন আমেরিকায় গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়। যদিও তাঁর বাসচালক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি।

তবে মেয়েটির সাহস ছিল। ফতোয়াবাজের মুখে পাটকাঠি ছুড়ে দেওয়ার পরে বাড়ির পেছনে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল কিশোরী আলেয়া চৌধুরীকে। তখন তার মা জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কোথাও যেতে চাস?’ মায়ের দেওয়া আড়াই টাকা নিয়ে বৃষ্টির রাতে বাড়ি ছেড়েছিল মাত্র নয় বছরের মেয়েটি। ছুটতে ছুটতে এসেছিল রেলস্টেশনে। একটা ট্রেনে চড়ে বসল সে। কিন্তু ট্রেনটি কোথায় যাবে জানে না ও। ট্রেন সকালবেলা কমলাপুরে এল। মেয়েটির টিকিট ছিল না। তবে কেউ কিছু বলল না। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে স্টেশনের বারান্দায় থাকতে শুরু করল সে। খিদে পেলে দোকানে কিছু খেতে চাইলে দোকানদার খাবারের বিনিময়ে হাঁড়ি পাতিল ধুয়ে দিতে বলল। সেটাই করল মেয়েটি।

এক বাস চালকের দয়া হলো ছোট্ট মেয়েটির ওপর। ওই বাস চালকেরও যে ছোট্ট আলেয়ার মতো একটি মা-মরা মেয়ে ছিল। রেলস্টেশন থেকে আলেয়া চৌধুরীর পরে ঠাঁই হলো শাহজাহানপুর বস্তিতে। সেখানে ভালোই ছিল সে। কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎ করে মরে গেল বাসচালক সেই উপকারী মানুষটি। তখন তাঁর নিজের মেয়ে ও পালিত মেয়ের জায়গা হলো সলিমুল্লাহ এতিমখানায়। কিন্তু এতিমখানা আলেয়া চৌধুরীর ভালো লাগবে কেন? সে তো জানে, তাঁর বাবা-মা আছে। ওই এতিমখানার পাশে ছিল দৈনিক আজাদ পত্রিকার অফিস। সেখানে ছিলেন কবি হাবিবুর রহমান। তিনি সেখানে লিখতে বললেন। ওখান থেকে পরিচয় হলো ইত্তেফাকের তৎকালীন ম্যানেজার খোন্দকার শাহাদাত হোসেনের সঙ্গে। তিনি আলেয়াকে প্রতিদিন সকালে দশটা পত্রিকা দিতেন বিক্রির জন্য। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে সেই পত্রিকা বিক্রি করত ছোট্ট মেয়েটি। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয় আলেয়া চৌধুরীর।

বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখায় একজন সুপুরুষ মনে হয়েছিল ছোট্ট কিশোরীর। বিশেষ করে তাঁর চওড়া পায়জামা মাটিতে স্পর্শ করত, সেটা মনে আছে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয়ের কিছুদিন পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। আলেয়া চৌধুরী গ্রামে ফিরে গেলেও কেউ তাকে জায়গা দিল না। পরে সেখান থেকে চাঁদপুরে গিয়ে স্ট্রিমারে করে ঢাকা সদরঘাটে এলেন। পরিচয় হলো কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান জয়ের জন্ম হয় তখন। সুফিয়া কামালের সঙ্গে নবজাতকসহ শেখ হাসিনাকে দেখতে গিয়েছিলেন আলেয়া চৌধুরী।

গাড়ি চালনা শিখতে হলে ৩০০ টাকা লাগবে! কিন্তু কে দেবে এত টাকা? তখন বাম রাজনীতিবিদ সিরাজুল আলম খানকে গিয়ে ধরলেন আলেয়া চৌধুরী। তিনি টাকাটা দিলেন। সেটা নিয়ে নটর ডেম কলেজের কাছে ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হলেন। ছোট্ট একটি মেয়ে গাড়ি চালাচ্ছে দেখে দৈনিক বাংলার হেদায়েত হোসেন মোরশেদ একটা ফিচার করলেন। বঙ্গবন্ধু মেয়েদের বাস চালানোর অনুমতি না দিলেও ছোট্ট মেয়েটিকে চলার জন্য সেলাই মেশিন দিলেন। কিন্তু ছোট্ট আলেয়া সেটা নিল না। তাঁর স্বপ্ন সে গাড়ি চালকই হবে। বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছে সে। এমনকি বিদেশে ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেছে।

আমেরিকার ভিসা হয়নি বলে ট্রলারে করে ১২ জন পুরুষের সঙ্গে মাছ ধরা নৌকায় করে এখান এল। ১২ জন পুরুষকে এখানে আসার পরে গ্রেপ্তার করা হলেও নারী বলে তাকে মুক্তি দিয়ে দিল। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের একজনের দেওয়া ঠিকানা নিয়ে ডাউনটাউন ম্যানহাটনের এলেন আলেয়া। প্রথমে তারা তাকে থাকতে দেয়নি। সারা রাত বাইরে বসিয়ে রাখে। অবশেষে তাদের দয়া হলো। আশ্রয় ও খাবার জুটল। এভাবে একা একটি মেয়েকে অনেক লড়াই আর সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হলো এই শহরে। বেশির ভাগ লড়াইয়ে জিতেছে সে। শুধু বাসচালক হওয়ার স্বপ্নই তাঁর পূরণ হয়নি।