এক বহ্নিশিখার কথা

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদা
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদা

নাটকের স্থান ‘এক লাশকাটা ঘর’। সময় ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাত। টেবিলের ওপরে শোয়ানো লাশ ঘিরে চিকিৎসক-পুলিশ আধিকারিকেরা সব হতবাক। স্তব্ধতা ভেঙে চিৎকার করে ওঠে এক জমাদার, একি! এ যে মেয়েদের স্কুলের বড় দিদিমণি! ইনি তো পুরুষ না।’

হ্যাঁ, ওই মৃতদেহ কোনো পুরুষের না, পুরুষের পোশাকে এক সশস্ত্র বিপ্লবী, বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ওপরের অংশটির কোনো নাট্যকার রচিত নাটকের অধ্যায় নয়, এক বিপ্লবীর রক্তে লেখা জীবন নাটকের শেষাঙ্ক।

ব্যক্তি জীবনের শেষ অঙ্ক, কিন্তু বিপ্লবীর কি মৃত্যু হয়? সে জীবন দেশের জন্য উৎসর্গ করা, যে জীবন জড়ত্ব লাশ করে জাতিকে জাগিয়ে দেয়, তার তো অন্ত নেই, সে তো এক অনন্ত জীবন। প্রতিটি বিপ্লবীসত্ত্বার মধ্যে সে বেঁচে থাকে। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরের পরে প্রীতিলতাও সেভাবেই বেঁচে আছেন প্রতিটি বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে।

চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রধান করণিক জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার ও প্রতিভাময়ীর ছয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় প্রীতিলতার জন্ম ১৯১১ সালের ৫ মে। মায়ের আদরের রানি চট্টগ্রামের ধলঘাটে প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন। একদিকে জালালাবাদ ও কালারপোলের গিরি মালার দৃঢ়তা আর অন্যদিকে অপার নীল সমুদ্রের বিশালতা, মাথার ওপরে উন্মুক্ত আকাশের উদারতা আর গায়ের কাছে আম-জাম-নারকেল গাছের সুনিবিড় ছায়া নেমে তৈরি হলো কুসুমকোমল আর বজ্রকঠিন সিংহহৃদয় এক মেয়ে।

ব্রাজিলের শিশুরা নাকি ফুটবল পায়ে জন্মায়, বিশ শতকের গোড়ার সেই অগ্নিযুগে বিপ্লবভূমি চট্টগ্রামে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা কৈশোর আর তারুণ্যকে তেমনি উদ্বেল করে তুলেছিল। সে ঢেউ লেগেছে কিশোরী প্রীতির মনেও। সেই ঢেউ আরও অশান্ত হয়ে উঠত প্রীতির মামাতো দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের যোগাযোগে। যিনি ছিলেন চট্টগ্রাম শহরে মাস্টার দা সূর্যসেনের দলের প্রধান। বিপ্লবী দলের মন্ত্রগুপ্ত রক্ষা করেও পূর্ণেন্দু নানাভাবে বিপ্লববাদে আগ্রহী করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন, বিশেষ করে দেশ-বিদেশের বিপ্লব ও বিপ্লবীদের কথার বইপত্র প্রীতিকে দিয়ে। মেধাবী ছাত্রী প্রীতি মেট্রিকে প্রথম বিভাগে বৃত্তি নিয়ে পাশ করে ঢাকার ইডেন স্কুল থেকে ইন্টারমিডিয়েটে উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন।

মেধাবী অত্যন্ত মনোযোগী, বুদ্ধিদীপ্ত প্রীতিলতা কিন্তু বিএতে অনার্স নিয়ে আর পাশ করলেন না, কারণ তত দিনে তিনি পুরোপুরিই বিপ্লব স্পন্দিত। তাঁর মনে হতো, যার বোমা সারা দেশকে বিদারিত করছে, সেই খুদিরামের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর কতটুকু। পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য বাবা ‘আঙ্কলটমস কেবিন’ উপহার দিলেও তো বিপ্লবীদের কথা জানতে দেননি বা পড়তে দেননি। সেই কাজ করলেন দাদা পূর্ণেন্দু। বেঙ্গল অর্ডিনান্সে বহু বিপ্লবী ধরা পড়ে যান। পূর্ণেন্দু বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার হওয়া বা বই বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা না বলে গোপন ও নিষিদ্ধ বইগুলো প্রীতিলতাকে রাখতে দেন। প্রীতিলতা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা পরিচালিত হয়ে সেই বই মায়ের পুরোনো বাক্সের তলায় রেখে দেন এবং গভীর রাতে ‘বাঘা যতীন’, ‘খুদিরাম’, ‘কানাইলাল পড়ে’, ‘সিআর দাসের জীবন’ পড়ে দেশের জন্য আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হতে থাকেন।

বহ্নিশিখা আরও তেজে জ্বলে উঠল একটি বিশেষ ঘটনায়। ১৯১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর পাহাড়তলির রেলওয়ে কারখানার সশস্ত্র বিপ্লবীরা ১৭ হাজার টাকা ডাকাতি করল। প্রীতি বন্ধু রেনুকার বাড়িতে বসে দেখলেন ২০-২৫ জন সিপাহি গরুর গাড়িতে করে অত্যন্ত নিরীহ-শান্ত দুই ভদ্রলোককে নিয়ে যাচ্ছে, যারা হাবিলদারদের লাথি, ঘুষি ও অকথ্য গালাগাল মুখ বুজে সহ্য করছে। চট্টগ্রাম আদালতে সূর্যসেন ও অম্বিকা চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে মামলা চলল। প্রীতি উদ্গ্রীব হয়ে পূর্ণেন্দু দাদার কাছ থেকে রোজকার মামলার বিবরণ শুনতেন। অ্যাডভোকেট যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের প্রশ্নবানে জর্জরিত আদালত ওই দুই স্বদেশি ডাকাতকে বেকসুর খালাস দিতে বাধ্য হয়। ১২ বছরের প্রীতিলতাও তাদের মুক্তিতে প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারলেন। আর এ ঘটনা একদিকে বিপ্লবীদের প্রতি তার মধ্যে শ্রদ্ধা জাগিয়েছিল, আর যেন ছিল এক পথনির্দেশ।

প্রীতিলতার অশান্ত মন ক্রমশ উত্তাল হতে থাকে। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের কাছে কেবলই আবদার করে বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার। পূর্ণেন্দু দস্তিদার মাস্টার দাকে প্রীতিলতার চেতনা-চরিত্র আবেদনের সব কথা জানালেও মাস্টার দা মেয়েদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে সম্মত হন না এই বিবেচনায়, স্বভাব কোমল মেয়েরা এই কঠিন পথে চলার উপযুক্ত নয়। বরং পুরুষ বিপ্লবীদের পিছুটান হয়ে দাঁড়াবে। মেয়েরা বিপ্লবী দলের সহযোগী শক্তি হয়ে থাক। তাই বেথুন কলেজের ছাত্রী প্রীতিলতা আলীপুর জেলে বন্দী, ফাঁসির আসামি বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দলের হয়ে অন্তত চল্লিশবার দেখা করেছেন তার বোনের পরিচয়ে। প্রীতির জীবনে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের অধ্যায় বিপ্লবের আরও কঠিন স্তরে তার উত্তরণ ঘটায়। ছড়িয়ে দেয় বিপ্লবের গাঢ় রং তাঁর জীবনে।

হাসি-গান-তত্ত্বকথা হালকা কথার দিন প্রীতিলতার শেষ হলো রামকৃষ্ণের ফাঁসির সঙ্গে। সশস্ত্র বিপ্লবের পথে তিনি এবার সংকল্পবদ্ধ। সবার অনুরোধে বিএ পরীক্ষা দিয়ে প্রীতিলতা চলে এলেন চট্টগ্রামে। সংসারের সহায় হয়ে দাঁড়াল অপর্ণাচরণ উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হয়ে। কিন্তু প্রীতি এখন মরিয়া সূর্যসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের বদৌলতে শেষ পর্যন্ত মাস্টার দার সম্মতিতে প্রীতিলতার জীবনে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, যেদিন ধলঘাটের গোপন আশ্রয়ে মাস্টারদার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হলো। সাত দিনের ছুটিতে প্রীতিলতা পিস্তল চালনা (দীপালি সংঘ থেকে শেখা) অন্যান্য শরীরচর্চা এবং বিপ্লবী জীবনের কঠিন অভ্যাসগুলো অনুশীলন করেন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। তার একাগ্রতা ও দৃঢ়তা অথচ হৃদয়ের কোমল স্পর্শি মাস্টার দা থেকে শুরু করে নির্মল সেন প্রমুখ সবাই মেয়েদের যোগ্যতা সম্পর্কে নিঃসংশয় হয়েছেন। কিন্তু ধলঘাট অধ্যায়ও শেষ হলো রক্তস্রোতে। এক রাতে পুলিশ তাদের গোপন বাসস্থান ঘিরে ফেলল। পুলিশ দোতলায় উঠে গুলি চালিয়ে নির্মল সেনকে হত্যা ফেলল। গোলাগুলির মধ্যে মাস্টার দা, প্রীতিলতা আর ভোলা অন্য আশ্রয়ের জন্য অন্ধকারে চলতে শুরু করলে ভোলাকে প্রাণ দিতে হলো। শুরু হলো প্রীতিলতার আত্মগোপনের পালা। পুলিশ তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। জীবিত বা মৃত প্রীতিলতার জন্য ৫০ হাজার টাকার ইনামও ঘোষণা করেছে পুলিশ। আর সমাজে বিপ্লবী মেয়েদের সম্পর্কে ঘৃণা সৃষ্টির জন্য পুলিশ মেয়েদের চরিত্র হনন থেকে শারীরিক রূপ নিয়েও তখন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে ছাড়ত না।

আত্মগোপন অবস্থাতেই প্রীতিলতা বিপ্লবীদের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব অভিযানে অবিসংবাদী নেত্রী মনোনীত হলেন। ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনের ফলকে লেখা ছিল ‘ডগস অ্যান্ড ইন্ডিয়ানস নট অ্যালাউড’—ইংরেজের এই বিদ্বেষ বিপ্লবীদের রক্তে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিল। এই অভিযান দুবার ব্যর্থ হয়েছিল। তৃতীয়বারের অভিযানে প্রীতিলতার নেতৃত্বে সচেতন বিপ্লবী যারা অনেকেই ছিলেন জালালাবাদ যুদ্ধের যোদ্ধা, নিপুণ পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ব্রিটিশদের প্রমোদ ভবন উড়িয়ে দিতে তিন দিক থেকে আক্রমণ চালান। কথামতো বাবুর্চির বেশে যোগেশ মজুমদার সংকেত দিলে অধিনায়িকা প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আগ্রাসনের নির্দেশ দেন। মুহূর্তে প্রমোদ ভবন শ্মশানে পরিণত করে বিপ্লবীরা যেন হিজলী জেল ও জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেন। প্রত্যক্ষদর্শী বীরেশ্বর রায়ের তথ্য অনুযায়ী, ১২ জন ইউরোপীয় নিহত এবং ১১ জন আহত হন। যদিও মান বাঁচাতে পুলিশ একজন ইউরোপীয় মহিলার মৃত্যু দেখিয়ে অভিযানের প্রতিক্রিয়া লঘু করে রিপোর্ট দিয়েছে।

প্রীতিলতার নেতৃত্বে মাস্টার দার ছক কষা অভিযান সফল হলো অবশেষে। বীর সেনানীর মতো সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন শান্ত-সাহসী-দৃঢ়প্রতিজ্ঞ প্রীতিলতা। পুরুষের মতো মালকোঁচা মারা ধুতি, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি আর ব্যাজ লাগানো লাল শার্ট প্রীতিলতাকে মাস্টার দা নিজেই সাজিয়ে দিয়েছিলেন। আর, প্রীতিলতা যে দেশের জন্য উৎসর্গ উন্মুখ, সে মাস্টার দার কাছ থেকে যেন অনুমতি নিয়ে নেন, আত্মদানের। হুইসেল বাজিয়ে প্রত্যেক সহযোদ্ধাকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে আদেশ দিয়ে অনিবার্য গ্রেপ্তারি এড়াতে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে নেন। নিজের শরীরে রেখে যান আগ্নেয়গিরির উত্তাপ ভরা বিপ্লবী অসাধারণ এক জবানবন্দি। ভারতবর্ষের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম নারী শহীদ ২১ বছরের প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের দেশের জন্য প্রাণ দানের ইতিহাসে প্রীতিলতাই একমাত্র নারী নন।

প্রীতিলতার বিপ্লবী হওয়ার প্রধান উদ্দেশ্যই নারী শক্তির সঠিক মূল্যায়ন প্রতিষ্ঠা করা, যা তিনি প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন। ২৪ সেপ্টেম্বরের অভিযানের প্রাক মুহূর্তে মাস্টার দাকে প্রীতিলতা বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু ফিরে আসব না। কাউকে তো জীবন দিয়ে শুরু করতে হয় দাদা।...দেশের লোকের ধারণা মেয়েরা দুর্বল, ঘরেই তাদের ভালো মানায়। কিন্তু এই সংস্কার ছিন্ন করার সময় এসেছে। আজ দেশের সামনে প্রমাণ করতে হবে আত্মোৎসর্গের ক্ষেত্রেও আমরা ভাইদের থেকে পিছিয়ে নেই, প্রীতিলতা ও কল্পনাকে দেখে সে কথা সর্বাগ্রে স্বীকার করেছেন চট্টগ্রাম বিদ্রোহের প্রাণপুরুষ মাস্টার দা সূর্যসেন। তিনিই বললেন, ‘বাংলার বীর যুবকদের আজ অভাব নেই।...ইংরেজ জানুক, বিশ্ব জগৎ জানুক, এ দেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে, স্বাধীনতাযুদ্ধে পিছিয়ে নেই।’