লোকে বলে রাগ নাকি...

শিরোনামটা একটা জনপ্রিয় গানের কলি। পরের লাইন—‘অনুরাগে রয় না’। কিন্তু আমি অনেক বই পড়ে, ধাক্কা খেয়ে বুঝলাম, পরের লাইন হওয়া উচিত ‘কমাতে হয় না’। কেন? সেই কথাতে আসছি।

সেদিন একটা ‘অ্যাংগার ম্যানেজমেন্ট’-এর বই পড়লাম। সেখানকার বেশ কিছু তথ্য আমার কাছে খুব কাজের মনে হয়েছে। বেশ নতুনও বটে। আমার ধারণা, বাংলায় এমন বই নেই। রাগ উপশমের উপায় সেভাবে আলোচিতও নয়। কাজেই অন্যদের জানানো দরকার।

জানানোর প্রথম অংশ হিসেবে আশপাশের বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতরা যখন আড্ডায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন, যেমন একটি মনোজ্ঞ সংগীতানুষ্ঠান হতে যাচ্ছে, সেখানে কোন কোন স্থানীয় বা অতিথি (তাঁদের কদর আবার বেশি) শিল্পী থাকবেন—এই নিয়ে কথা চলছে। আর আমি সে আলোচনার মাঝে বিরতি বুঝে রাগ নিয়ন্ত্রণের বইটির প্রসঙ্গ তুললাম। তাতে তেমন কেউ উৎসাহিত হলেন না। একজন দায়সারাভাবে জিজ্ঞেস করলেন সে বইতে কি বুদ্ধি-পরামর্শ আছে? বাকিরা হয়তো সাময়িক কথা বলার সুযোগও দিলেন।

বইয়ে কী লেখা ছিল, তা বলা শুরু করতেই আরেকজন বলে ফেললেন, রাগের কারণ হচ্ছে যে, আমরা পৃথিবীটা নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। সেখান থেকেই রাগ আসে। আরেকজন মন্তব্য করলেন, ‘রাগ চাপা দিয়ে রাখতে হয়। প্রকাশ করে হাউকাউ করাটা ভুল।’

পরেরজন ওই বইয়ে রাগ দূর করার কী উপায় আছে জানতে চেয়ে পরক্ষণে নিজেই বললেন, ‘রাগ হলে গ্লাস ভাঙতে হয়, তাতে রাগ গ্লাসের মতো চুরমার হয়ে শেষ হয়ে যায়।’

দু তিনবার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বলার চেষ্টা করে বুঝলাম, সবাই এ সম্পর্কে কিছু না কিছু জানেন। তখন আমার বোধোদয় হলো। দৈনন্দিন জীবনে রাগ যে খুবই খারাপ, সেটা ওই বইতে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা নেই। বলার প্রয়োজনও পড়েনি। কারণ, বইটি যে অঞ্চলের মানুষকে মাথায় রেখে লেখা হয়েছে তাঁরা রাগকে একটা দোষ, এমনকি ব্যাধি হিসেবে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত ব্যাপার বলে ধরে নিয়েছেন।

আমাদের কাছে রাগ এখনো বনেদি একটা ব্যাপার। ‘স্যার খুব রাগী’, তারপর ‘রাগ না থাকলে পুরুষ মানুষ না কি?’, রেগে যাওয়ার জন্য ‘পিয়ার প্রেসার’ আছে; না হলে ‘ধুর, সাত চড়ে রা করে না’, বলে তো কথাই আছে!

ভেবেছিলাম রাগ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রচারে লেগে যাব। কিন্তু এমন দু-তিনটি আলোচনার পর দেখলাম, ‘অ্যাঙ্গার’ যে খারাপ, সেটাই আগে বিশ্লেষণ করাটা জরুরি। এতে সফলতার সম্ভাবনা খুব বেশি দেখছি না। কেন, তা-ই বলছি এখন।

প্রচারের দ্বিতীয় অংশ হিসেবে ভাবলাম, অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টের ওপর একটা ফেসবুক লাইভ করি। সেখানে দুজন অতিথি যোগ দিলেন। শুরুতেই বাধল বিপত্তি। একজন বললেন, ‘দেশে দেখা যায় যেসব অফিসের বসরা রাগী, তাদের কথা সবাই শোনে। যারা রাগী না, তাদের কথা কেউ শোনে না, কাজ হয় না।’ আমি বিস্মিত। কোথায় রাগ কীভাবে কমান যায়, বেশি রাগ করলে নিজের ও অন্যের কী কী ক্ষতি, এসব নিয়ে কথা হবে! তার কথা তো উল্টো দিকে যাচ্ছে! অনেক মানুষ আবার এই লাইভ দেখছিলেন। এখন মনে হচ্ছে রাগ কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে!

পরের বক্তাকে কিছু বলতে বললে তিনি বললেন, ‘একজন অঙ্কে খারাপ করল, বাবা-মা বকা দিল। তাতে সে রাগ হয়ে অনেক পড়াশোনা করে পরের বছর অঙ্কে ভালো ফল করে দেখিয়ে দিল।’ আমি ভাবলাম, যাহ। এর পরের বাক্যে তিনি বলবেন, ‘রাগের কারণে অনেক ভালো কাজ হয়, কাজেই রাগের দরকার আছে।’ কপাল! কিছুতেই রাগ কমানোর বিষয়ে আর আসতে পারছি না। অথচ ব্যাপারটা আমিই শুরু করেছি! শেষে আমারই দেখি রাগ এসে যাচ্ছে (বই পড়ার পরও)! দুজনের কথার উত্তর অবশ্য মাথায় এল, তবে একটু দেরিতে। অঙ্কে ভালো করাটা রাগের বশে নয়, এটাকে বলা যায় প্রতিজ্ঞা। রাগের কিছু ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু সেটাকে প্রতিজ্ঞায় নিয়ে গিয়ে ভালো ফল করাটাই তো অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট!

অফিসের বস রাগী হলে কাজ ভালো হয়, সেটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের কোথাও রাগের মাধ্যমে জনসম্পদ দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার উল্লেখ নেই। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বার্ষিক রিভিউ হয়। ট্রেনিং আছে, বোনাস ও অন্যান্য উৎসাহব্যঞ্জক সনদের ব্যবস্থা আছে। যেখানে একজন তার বেতনভোগী কর্মচারীকে কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি থেকে শুরু করে চাকরিচ্যুত পর্যন্ত করতে পারে, সেখানে তার গলা উঁচু করে অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহারের কোনো দরকারই পড়ে না। এসব যারা করেন, তারা করেন বদ অভ্যাসের বশে। বেড়ে ওঠার সময় চারদিকে যা দেখেছেন, সেটাই মগজে প্রোথিত হয়ে গেছে।

বেনেভোলেন্ট লিডার বলে একটা কথা আছে, সেখানে ‘অমায়িক নেতা’। অমায়িক হওয়াটাই গুণের, তাতে আরও বেশি কাজ হয়। রেগে না গেলে মানুষ সুযোগ নেবে বলে উন্নয়নশীল দেশের একটা খুবই ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এত কিছু বলতে পারলাম না।

এর মধ্যে আরেক ঘটনা ঘটল। একজন আলোচকের স্ত্রী ফোন হাতে নিয়ে আমাদের লাইভ করছিলেন। তিনি এই আলোচনা শুনে একপর্যায়ে বললেন, ‘আমিও কিছু বলতে চাই।’ তাতে স্বামীটি মনে হয় প্রমাদ গুনলেন। কারণ, তাঁরই কোনো একটা বেফাঁস কথায় স্ত্রীর মুখ থমথমে হয়ে গেছে। তাঁকে না এনে উপায় রইল না। দর্শকেরা তাঁকে দেখতে না পেলেও, তাঁর কথা শুনে ফেলেছেন। তিনি অবশ্য এসেই বেশ ভালো কিছু কথা বললেন, যেমন রাগ হলে তিনি নাকি ছবি আঁকেন।

আমরা ভাবলাম ক্যারিকেচার জাতীয় ছবি। তিনি ছবিগুলো আমাদের দেখালেনও। তাঁর বাসাতেই লাইভ হচ্ছিল। একেবারে রাগ পড়ে যাওয়ার মতো, প্রকৃতির সুন্দর ছবি এঁকেছেন তিনি। কিন্তু একটু বাদেই তাঁদের দুজনের মধ্যে মতের অমিল হতে থাকল এবং আলোচনায় ‘উষ্ণতা’ বাড়ার আলামত পাওয়া গেল। শিগগিরই চাপা ‘রাগ’ নিয়ে আমার সেই লাইভ শেষ করতে হলো।

অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট প্রসঙ্গটি উঠলেই মানুষের নানা প্রশ্ন সামনে আসে। ভুল বললাম, সামনে আসে মানুষের নানা উত্তর, যার ঠেলায় আমার নতুন জ্ঞান প্রকাশের কোনো অবকাশ পাই না। ভাবলাম, এক বইতে কাজ হলো না, আরও দু-একটা পড়ি। তারপর মোক্ষম সব যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করা যাবে। চাই কি বাংলায় নিজেই একটা বই লিখে ফেলতে পারি। এর আগে দশটার মতো বই এবং বিস্তর আর্টিকেল পড়ে, ছয় মাসে নিজেই একটা মৌলিক বাংলা বই লিখেছিলাম, ‘ব্লকচেইন’ প্রযুক্তির ওপর। ভাবলাম এবারেও তাই করি। এমন একটি বই যে বাংলায় কেন নেই, সেটা অবশ্য ইতিমধ্যেই কিছুটা আঁচ করে ফেলেছি।

পরের বইটা পড়তে গিয়ে খুবই মুশকিলে হলো। পড়ার তেমন অবকাশ পাচ্ছি না। সবখানে বইটা নিয়ে যাই, ফাঁক পেলে পড়ব। কিন্তু ফাঁক পাই না। সেদিন ফ্লাইটে আটলান্টা যাব। হ্যান্ডব্যাগে অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টের বই। কীভাবে যেন আমার ব্যাগটাই বিশেষ চেকিংয়ে চলে গেল। হাতে গ্লাভস পরে টিএসএ এজেন্ট আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘রুটিন চেক আর কি।’

বই বের করে আরেকবার হাসল, বন্ধুত্ব স্থাপনের ভঙ্গিতে বলল, ‘প্লেনে পড়ার জন্য আমিও সাথে বই নিই।’ কিন্তু বইয়ের নাম দেখে তার হাসি দ্রুত কমতে থাকল। অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট? মানে ‘অ্যাংরি প্যাসেঞ্জার!’ তাহলে কী ঘটতে পারে তো বোঝাই যাচ্ছে! পরের বইটা সে বের করল। সেটাও অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টের বই। লোকটি বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি প্রমাদ গুনলাম। যথাসম্ভব মুখে হাসি ধরে রাখলাম। কিন্তু সেই হাসি ফ্যাকাশে হাসি। যে এখনই ভয়ানক রেগে যাবে ভেবে সবাই শঙ্কিত, সে যখন হাসে, তখন তা ভয়াবহ দেখায়। আমাকেও নিশ্চয়ই তেমনটা দেখা যাচ্ছিল। টিএসএ অফিসার বই দুটো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে কয়েকবার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।

তারপরে তিনি সত্যিই জেরা শুরু করলেন। ‘বাহ্ ভালো বই তো! তা এগুলো পড়ে কী তোমার অ্যাঙ্গার কিছু কমেছে? সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাচ্ছ? যাও না?’ এই দেশে মাত্রাতিরিক্ত রাগ একটা সাংঘাতিক ব্যাপার। কোনোমতে বললাম, ‘আমি নিজেই একটা বই লিখব, বাংলায়, তাই এগুলো পড়ছি।’ এজেন্ট লোকটি এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। একজনের অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট বই পড়ার, অন্য আরও যুক্তিসংগত কারণ তাহলে আছে! আরেকটু জেরা করে তিনি আমাকে ছেড়ে দিলেন।

প্লেনে ভুলেও ব্যাগ থেকে বই দুটো বের করলাম না। বই লেখার পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলায় ‘রাগ বাড়িয়ে প্রতিপত্তি লাভ করুন’, অথবা ‘লোকে বলে রাগ নাকি কমাতে হয় না’ নামের বইটি অনেক চলবে। আর অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্টের বই উইপোকায় খাবে।

আরেকটা কথা। আটলান্টা থেকে ফিরে এসে একটা কাজ করলাম। ছোটবেলায় মাসুদ রানা পড়া বারণ ছিল। তাই মাসুদ রানার ওপরে অন্য বইয়ের মলাট লাগিয়ে পড়তে হতো। সেই কথা মনে পড়তেই ‘অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট’ বইয়ের ওপরে ‘জেনেটিকস’-এর একটা কঠিন বইয়ের মলাট লাগিয়ে নিলাম। আর কোনো ঝুঁকিই নেওয়া যায় না। কে যে কখন কী ভেবে বসে, কাউকেই বিশ্বাস নেই!