আনিসুল হকের লেখা ও কিছু কথা

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক সম্প্রতি (৩০ আগস্ট, ২০১৯) প্রথম আলোয় ‘সংস্কৃতি অঙ্গনে রক্ত শূন্যতা কেন?’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এই প্রবন্ধেই তিনি এর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া যে কারণগুলোর জন্য সংস্কৃতি অঙ্গনে স্থবিরতা বিরাজ করছে, তার দু–একটি কারণ আমি এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এখন যে বন্ধ্যা সময়টা আমরা অতিক্রম করছি, তাতে বেশির ভাগ লোকেরই উদ্দেশ্য হচ্ছে শর্টকাট রাস্তায় অর্থ উপার্জন। কিন্তু সংস্কৃতি অঙ্গনে শর্টকাট রাস্তায় স্বল্প সময়ে অধিক অর্থ বানানোর সুযোগ নেই, তাই এ পথে পথিকও কম।

সারেগামা অর্থাৎ গ্রামার না শিখেই গান করে স্টার বা সেলিব্রিটি হওয়ার খায়েশ। ইউটিউবের বদৌলতে নাটকের রিহার্সালে তিনদিন গিয়ে চতুর্থ দিন নাটকে অভিনয় করে অভিনেতা, অভিনেত্রী। কেউবা পরিচালক, কেউবা নাট্যকার, কেউ প্রযোজক। এখন গ্রামেগঞ্জে নাটকের শুটিং, ইউটিউবে শত শত নাটক। এবং এসব নাটকের ভাষা এত নিম্ন ও অশ্লীল, যা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। অন্যদিকে বাংলা মিউজিক ভিডিওর নামে ইউটিউবে সার্চ দিলে যেসব অশ্লীল নাচ, গান ও অঙ্গভঙ্গি দেখা যায়, তা দেখারও অযোগ্য। এসব লোকের রুচি যে কত নিম্নমানের তা কল্পনাতীত। এসব দেখার যেন কেউ নেই। এখনই এসবের লাগাম টেনে ধরতে হবে নতুবা যুব সমাজের পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না।

দেশে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় রয়েছে, এদের কাজ কী—জানি না। দেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়লেও নাটকের মান বা অনুষ্ঠানের মান বাড়েনি। নাটকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, টিভি নাটকে বাজেট কম থাকায় নাকি নাটকের মান পড়ে যাচ্ছে। আসলে বাজেট নয়, মেধার অভাব। পশ্চিমবঙ্গের টিভি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশে এখন খুবই জনপ্রিয়, কারণ তারা দর্শকের চাহিদা মতো অনুষ্ঠান নির্মাণ করছে, যদিও তাদের নাটক ড্রয়িংরুম কেন্দ্রিক। কিন্তু নাটকের সংলাপ, কাহিনি, অভিনয়, বিষয়বস্তু আমাদের চেয়ে ভালো ও ব্যতিক্রমী এবং তাদের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলো দুই বাংলায় জনপ্রিয়। কারণ এসব নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মেধা সম্পন্ন মানুষেরা।

কলকাতার নাটকে ইতিমধ্যে আমাদের দেশের একাধিক অভিনেতা, অভিনেত্রী অভিনয় করে সুনাম কুড়িয়েছেন। তা ছাড়া একজন অভিনেত্রী (জয়া আহসান) টালিউডে বেশ জাঁকিয়ে বসেছেন এবং তার অভিনীত ছবি ভারতীয় জাতীয় চলচিত্র পুরস্কারও পেয়েছে। তাই যোগ্যতর ও মেধা সম্পন্ন মানুষকে এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। অন্যদিকে হিন্দির আগ্রাসনও আমরা রুখতে পারছি না। বাঙালি কোন বিয়ে বা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে যান, দেখবেন সেখানে হিন্দি গানের সঙ্গে নাচ। একের পর এক হিন্দি গান বাজছে। আজ থেকে ৮/১০ বছর আগেও অবস্থা এমনটি ছিল না। তাহলে কেন এ রকম হচ্ছে? হচ্ছে এ কারণে, আমরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভালো বাংলা গান দর্শক শ্রোতাদের উপহার দিতে পারছি না। সিনেমার অবস্থা তো আরও করুণ।

এবার আসুন সাহিত্যে। বেশির ভাগ দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ঘুরে ফিরে নির্দিষ্ট কিছু লেখকের ফরমায়েশি লেখা ছাপানো হয়। সাহিত্য পাতার সম্পাদকের একটা গ্রুপ আছে, এই গ্রুপের লেখকেরা লেখা দেয়, সেই লেখা ছাপা হয়। নতুন কোন লেখকের লেখা ছাপা হয় না।

এখানে পাঠকের চাহিদার কোনো মূল্য থাকে না। সুতরাং যা হওয়ার, তাই হয়। অর্থাৎ ফরমায়েশি লেখায় ভালো সাহিত্য সৃষ্টি হয় না। অন্যদিকে আগের মতো সাহিত্যের ছোট কাগজও বের হয় না নানা প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক নবীন কবি, সাহিত্যিকেরা তাদের লেখা কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি পোস্ট করছেন। এবং সেগুলো অনায়াসেই পাঠকেরা পড়তে পারছেন। যার মধ্যে অনেক মানসম্পন্ন লেখাও থাকছে।

তা ছাড়া কেউ কেউ নিজেই সাহিত্য পত্রিকার ওয়েবসাইট তৈরি করে নিজে লিখছেন এবং অন্যকে লেখার সুযোগ করে দিচ্ছেন। অন্যদিকে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে সরকারি কোন দিক–নির্দেশনা বা সাহায্য সহযোগিতা নাই বললেই চলে। এক সময় দেশের স্কুল, কলেজগুলোতে সাপ্তাহিক বা মাসিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেখান থেকে যোগ্যরা বেরিয়ে এসে জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে অংশগ্রহণ করত। ইদানীং আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়, রাজনৈতিক স্বার্থে পরিকল্পিতভাবে শিশু–কিশোরদের পাঠ্য বই থেকে প্রগতিশীল লেখকদের লেখা তুলে নিয়ে সাধারণ মানের লেখা দেওয়া হচ্ছে, যার ভয়াবহ পরিণাম আমরা অদূর ভবিষ্যতে দেখতে পাব। শিশু–কিশোরদের বইমুখী করার কোন প্রকল্প বা চিন্তা–ভাবনা কারও আছে বলে মনে হয় না। আগে পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি ছিল। এখন আগের মতো লাইব্রেরি নেই, যে কয়টি আছে তাতে পাঠক নেই। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন লাইব্রেরিগুলোতে দিতে হবে কম্পিউটার। থাকতে হবে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। সংস্কৃতি অঙ্গনের এই অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সৃজনশীল মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।