'হাউ ডেয়ার ইউ'

‘হাউ ডেয়ার ইউ?’

গ্রেটা থুনবার্গ। সুইডিশ কিশোরী।

জাতিসংঘে জলবায়ু সম্মেলনে সোমবার তার দেওয়া ভাষণ ভুলতে পারছি না। শত শত খবরের শত শত মুখের মাঝে তার মুখখানিই বারবার ভেসে উঠছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে যথার্থই বর্ণনা করা হয়েছে, ‘গ্রেটার পরিবেশবাদী বক্তব্য চাবুকের মতো আছড়ে পড়ছিল।’

সকালে নাশতার টেবিলে ছেলে আচমকা জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা বলতো, জিনাত আলী কে? বললাম, চিনি না, কে?’

ছেলে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘সত্যি চিনো না? যাক, এবার তোমাকে আটকাতে পেরেছি। যখনই যে ঘটনার কথা বা যে মানুষের কথা বলি, দেখা যায় তুমি চিনো বা জানো। অন্তত একটা পেলাম, তুমি কিছুই জান না।’

মাথা নাড়িয়ে অপারগতা জানালে সে বলল, গুগলে সার্চ করো, পেয়ে যাবে। বললাম, তার দরকার নেই, তুমিই বলে ফেল। সে পীড়াপীড়ি শুরু করল এবং বলল, তোমার চিন্তায়তো এখন একজনই, গ্রেটা গ্রেটা।

এ খবর সে জানল কি করে? মনে পড়ে, গতকাল গ্রেটা মুগ্ধতার কথা তাকে ও তার মাকে বলেছিলাম, ছেলেটি মনে রেখেছে। তার মা বলল, এতই যখন বলছে, একবার সার্চ করোই না।

করলাম। ‘জিনাত’ নয়, ‘জিন্নাত’, জিন্নাত আলী। কক্সবাজারের রামুর আট ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা জিন্নাত আলী বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘকায় মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থ সাহায্য করেছেন। গুগলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছবিটিও শোভা পাচ্ছে।

বলছিলাম গ্রেটার কথা। ‘হাউ ড্যায়ার ইউ’। ভাষণে ক্ষোভ-হতাশার সঙ্গে ঝরছিল আগুন, ক্রোধের আগুন।

এমন এক মৌসুম যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী খবরের কোনো খরা নেই। বাংলাদেশে ক্যাসিনো আর সিন্ধুকে সিন্ধুকে টাকার খনি, আমেরিকায় স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট তদন্তের ঘোষণা, ইরান, ব্রেক্সিট, কাশ্মীর, ইসরায়েল—খবর আর খবর।

এর মধ্যে একটি খবর আমার মনোযোগ কেড়ে নেয়। টয়লেট সাফল্যের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘গ্লোবাল গোলকিপারস গোলস পুরস্কার’ লাভ। এ পুরস্কার দিয়েছে ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’। মোদিকে এই পুরস্কার দেওয়া নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারতের টয়লেট সমস্যা নিয়ে সম্ভবত কোনো বিতর্ক নেই।

এই প্রসঙ্গে দুটি চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়ে। একটি বাংলা, কলকাতার। অপরটি হিন্দি, মুম্বাইয়ের। নাম মনে নেই, পুরোটা দেখাও হয়নি। তবে যে অংশ দেখেছি, বোঝার জন্য যথেষ্ট।

বাংলা ছবিতে আছে, নায়ক (জিৎ) গ্রামে গিয়েছেন, সূর্য ওঠার আগে ডাক পড়ল। শয্যা ছাড়তে হবে। বড়কর্তার আদেশ, বাড়ির এটাই নিয়ম। বিশাল বাড়ি। বড় প্রাঙ্গণে জড়ো হলেন শ খানিক বাসিন্দা। শিশু থেকে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ। প্রার্থনার পর প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া হলো এক কাপ করে নিমের রস মিশ্রিত জল। তা পান করে এখন সবাইকে যেতে হবে জঙ্গলে বা উন্মুক্ত মাঠে প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্য। কোনো বিকল্প নেই, নায়ককেও যেতে হলো। ভোরের সূর্যের লাল আভা ফোটার আগেই প্রাকৃতিক কর্ম সেরে সামনের ছোট্ট নদীতে সবাই নেমে পড়লেন। স্নান শেষে দলে দলে ফিরলেন ঘরে।

হিন্দি সিনেমার নায়ক অক্ষয় কুমার। শহুরে নববধূকে নিয়ে বসবাসের জন্য গেলেন গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতে নেই কোনো টয়লেট। খোলা মাঠে সবাই মলমূত্র ত্যাগ করেন। নববধূর এতে আপত্তি। কোনো অবস্থাতেই রাজি নন। বেচারা নায়ক! নববধূকে মোটর সাইকেলে করে নিয়ে গেলেন দূরবর্তী এক রেল স্টেশনে। ওখানে ট্রেনে প্রাকৃতিক কর্ম সারার পর ফিরে এলেন বাড়িতে। সে থেকে এটাই হয়ে গেল প্রতিদিনের রুটিন। একদিন প্রাকৃতিক কর্ম সারতে গিয়ে নববধূকে নিয়ে ট্রেনটি চলে গেল, নিচে নায়কের হায় হায় চিৎকার। এরপর ছবিতে আছে মজার মজার ঘটনা।

ভারতে ৫০ কোটির বেশি মানুষ উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করতেন। বিল গেটস ফাউন্ডেশনের মতে, নরেন্দ্র মোদির ‘ক্লিন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির ফলে এ সংখ্যা কমে আসছে। তবে সমালোচকেরা থেমে নেই। তাদের মতে, এ কৃতিত্ব মোদির একা হবে কেন? আর শুধু টয়লেট নির্মাণ করে দিলেই কি সব? পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। এতে পরিবেশ আবারও দূষিত হচ্ছে। আরও বড় সমস্যা, টয়লেট নির্মাণ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে না যথাযথ। অর্থাৎ, টয়লেট ব্যবহারের অভ্যাস কম! সমস্যা নিঃসন্দেহে গুরুতর।
আবারও ফিরে আসি গ্রেটার কথায়।

বিবিসি দেখছিলাম। মুহূর্তের ফুটেজ। জাতিসংঘের সম্মেলন হল। দাঁড়িয়ে আছে কিশোরী গ্রেটা। হাসিমাখা মুখ। এ সময় সদলবলে সেখানে প্রবেশ করলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ট্রাম্পকে দেখামাত্র গ্রেটার মুখখানি পরিবর্তন হয়ে গেল ষোলো আনা। হাসি-খুশি মুখখানি হয়ে গেল কঠোর, সেখান থেকে যেন ঠিকরে বের হচ্ছে ক্রোধ ও আগুন। তার যত ক্ষোভ সব যেন ট্রাম্পকে ঘিরেই। অথচ তার গোটা বক্তৃতায় একবারও ট্রাম্পের নাম নেয়নি।

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকার নাম প্রত্যাহার করে নেন। বিবিসির ওই মুহূর্তের ফুটেজ অন্যান্য ক্যামেরায়ও বন্দী হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে।

‘হাউ ড্যায়ার ইউ’
এরপর সাহসী গ্রেটা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে বলল, আপনারা আমাদের স্বপ্ন ও শৈশবকে হরণ করেছেন...।

গ্রেটা বলল, ‘বাস্তব সত্য হলো, আপনারা আমাদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। আমরা এখন আপনাদের বেইমানি বোঝা শুরু করেছি...। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চোখ এখন আপনাদের ওপর। আপনারা আমাদের রক্ষায় ব্যর্থ হলে মনে রাখবেন, আপনাদের আমরা কখনো ক্ষমা করব না।’

জাতিসংঘে গ্রেটার বক্তব্যের পর ডানপন্থী গণমাধ্যম তার ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করেছে। যারা জলবায়ু সংকট বিজ্ঞান সম্মত নয়, বরং রাজনৈতিক বলে বিশ্বাস করেন তারা একহাত নিতে ছাড়ছেন না। এর মধ্যে ফক্স নিউজের এক অতিথি গ্রেটাকে ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ ঘোষণা দিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। অবশ্য এজন্য সংশ্লিষ্ট উপস্থাপক ক্ষমা চেয়েছেন।

রক্ষণশীল ‘ন্যাশনাল রিভিউ’ গ্রেটার কথা না শোনার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, এই শিশুকে সামনে রেখে পেছনে স্বার্থান্বেষীরা খেলছে। পরে তারা সামনে আসবে।

মজার বিষয় হলো, এবার জাতিসংঘে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আক্ষেপ করে বলেছেন, ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরের বছরই নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। অথচ এখনো তিনি তা পাননি।

এদিকে খবর হচ্ছে, গ্রেটা থুনবার্গকে বিকল্প নোবেল ‘রাইট লাই্ভলিহুড’–এর জন্য মনোনীত করা হয়েছে। নাম গেছে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যও। ভবিষ্যতে যদি তা পেয়ে যান, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক।