বাংলাদেশিদের অগ্রযাত্রা

নাড়িপোতা মাটি বড় প্রিয়। বড় তার টান। এ টান দ্বিমুখী। সন্তানের গৌরব যেমন মায়ের মাথাকে আরও আরও উঁচুতে তোলে, ঠিক তেমনি ভূমিজের যেকোনো অর্জন সরস করে তোলে তার জন্মমাটিকে। এ এক নিভৃত যোগাযোগ, কোনো দূরত্বই যার ছেদ টানতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন, ‘রক্তের নিঃশব্দ সুর/ সদা চলে নাড়িতন্তু বেয়ে।’ রক্তের এ সুর অদৃশ্য নাড়িপথ বেয়ে পৌঁছে যায় ঠিক তার জন্মসীথানে। আর তাই আজকের বাংলাদেশ শুধু বাংলাদেশ নামের ভূখণ্ডটির মধ্যে আর আবদ্ধ নয়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের নিয়ে সে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। বিশ্বের যেখানেই বাংলাদেশিরা থাকুক না কেন, তার পরিচয় ও স্বীকৃতি শেষব্দি আসে জন্মমাটির নামেই। এমনই এক স্বীকৃতি এসেছে সম্প্রতি আমেরিকাপ্রবাসী বাংলাদেশিদের উপলক্ষ করে।

অভিবাসীদের দেশ আমেরিকা। এই দেশে বাংলাদেশিদের আগমন ঘটতে শুরু করেছিল অনেক আগে। অর্ধশত বছর পর এই বাংলাদেশিরাই এখন দারুণভাবে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। কর্মক্ষেত্র থেকে শুরু করে শিক্ষা—সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে এখন বাংলাদেশিরা। অপরাপর অভিবাসী গোষ্ঠীই শুধু নয়, শিক্ষায় এমনকি গড় আমেরিকানদেরও পেছনে ফেলেছেন এ মাটির সন্তানেরা। এ ভীষণ গৌরবের খবরটি জানাচ্ছে খোদ মার্কিন সরকারি-বেসরকারি তথ্যভান্ডারই।

আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের ৩২ শতাংশের গড় বার্ষিক আয় এখন ৯০ হাজার ডলারের বেশি। আর ১৫ শতাংশ বছরে গড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার ডলারের বেশি আয় করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিক্ষায় বাংলাদেশিদের অর্জন। আমেরিকাপ্রবাসী প্রায় ২৮ শতাংশ বাংলাদেশির রয়েছে স্নাতক ডিগ্রি। সাধারণ আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এ হার ২০ শতাংশ। বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশের রয়েছে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ের ডিগ্রি। অন্যান্য আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ১১ শতাংশ। এ অর্জন নিঃসন্দেহে ভীষণ গৌরবের। কিন্তু এও সত্য যে, অনেক বাংলাদেশি এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। নিতে হচ্ছে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সহায়তা। এই বাংলাদেশিরাও কিন্তু রক্তের সেই নিঃশব্দ সুরের পথ ধরে এ মাটির সঙ্গে যুক্ত।

এত অর্জনের পরও একটি খাদ রয়ে গেছে। কারণ, প্রবাসী নারীরা এখনো পুরোপুরি এ অগ্রযাত্রায় শামিল হতে পারেনি। আমেরিকাপ্রবাসী বাংলাদেশি নারীদের মাত্র ৩৯ শতাংশ কাজে নিয়োজিত। অন্য আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এ হার গড়ে ৫৬ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ভাষা দক্ষতা থেকে শুরু করে অনেক বাধার কথা বলা হলেও মূল বাধাটি পরিবারকেন্দ্রিক। পারিবারিক বাধাই নারীদের সামনে এগোতে দিচ্ছে না, যা দূরীভূত হলে আমেরিকায় বাংলাদেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

প্রবাসী বাংলাদেশি মাত্রই বাংলাদেশের সম্পদ। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স হিসেবে পাচ্ছে বাংলাদেশ। এটি অবশ্যই বড় প্রাপ্তি। এর সঙ্গে যদি মেধার সংযোগটি হয়, তবে তা বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় পাওয়া হবে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখনো এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কিন্তু আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা বসে নেই। তাঁরা নানা সংগঠনের মাধ্যমে দেশের শিক্ষা খাতে ও দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখছেন। এর আরও প্রসার প্রয়োজন; দু ক্ষেত্রেই দেশে ও প্রবাসে।

আর এটি করতে হবে সম্মিলিতভাবে। রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক বিভাজন ভুলে প্রবাসে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান রাখার পথ খুলে দিতে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। জন্মমাটির সঙ্গে মানুষের সংযোগ ও এর দ্বিমুখী টানটি তবেই অর্থবহ হয়ে উঠবে।