মৃত্যুপুরীর পথ ধরে স্বপ্নের আমেরিকায়

আমেরিকান ড্রিম। কিছু তরুণের চোখে লাল-নীল স্বপ্ন—যেকোনো উপায়ে পৌঁছাতে হবে আমেরিকায়। জীবনের ঝুঁকি আছে, তবুও একবারের জন্যও পেছনে ফিরে তাকানো নয়। হয় প্রাণ, নয় আমেরিকা! এ যেন মরীচিকার পথে যাত্রা। আমেরিকা পৌঁছাতে পারলেই যেন জীবনের সব সার্থকতা। বাংলাদেশের বহু তরুণ আমেরিকার স্বপ্নে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম পথে পা বাড়িয়েছেন। পথে মৃত্যুর মিছিল,

মানুষখেকো গাছের ভয় নিয়ে আমাজন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটা, টানা পাঁচ দিন উঁচু পাহাড় বেয়ে চলা কিংবা ডিঙি নৌকায় করে উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়া। এমন অনেক কঠিন পথ পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় স্বপ্নের আমেরিকায়। কেউ পৌঁছায়, কেউ আবার যাত্রাপথেই হয় সলিল সমাধি। এমনই বাস্তবতার সাক্ষী সম্প্রতি আমেরিকার কারাগার থেকে ফেরত আসা এক বাংলাদেশির। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে একান্ত আলাপকালে বর্ণনা করেছেন তিনি ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতার কথা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই বাংলাদেশি বলেন, সক্রিয় দালাল চক্রের সহযোগিতায় প্রথমে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো হয়ে ব্রাজিল পৌঁছানো হয়। ব্রাজিল পৌঁছানো তুলনামূলক সহজ। ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে তাঁদের সেখানে পৌঁছানো হয়। সেখান থেকেই মূলত শুরু হয় দুর্গম পথের সেই যাত্রা; মৃত্যুপুরীর পথ যেন।

ব্রাজিল থেকে প্রথম গন্তব্য হয় পেরু। ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ রুট দিয়েই পেরু সীমান্তে পৌঁছে দেয় দালাল চক্র। সেখান থেকে সীমান্ত পার করে ইকুয়েডর পৌঁছানো হয়। সেখানে কিছু অর্থের বিনিময়ে পুলিশের সহায়তায় সীমান্ত পেরোতে হয়। এরপর গন্তব্য কলম্বিয়া। ইকুয়েডর থেকে কলম্বিয়া যেতে সুউচ্চ পাহাড় পাড়ি দিতে হয়। সেই পাহাড় পেরোনোর সময়ই পাওয়া যায় মৃত্যুপুরীর স্বাদ। কারণ, ওই পাহাড়ি পথে দেখা মেলে অনেক পচা লাশের। সেখান থেকে মূল সীমান্তে পৌঁছাতে হয় স্পিডবোটে করে, তারপর কলম্বিয়া।

কলম্বিয়া থেকে গন্তব্য এবার আমাজন জঙ্গল! টানা পাঁচ দিন আমাজনের গভীর জঙ্গলে পায়ে হাঁটা রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। সেই জঙ্গলের পথ এতই দুর্গম যে বর্ণনা করার সময় সাক্ষাৎকারদাতার গা যেন শিউরে উঠছিল। সে পথে রয়েছে ‘মানুষ খেকো গাছ’, ঘুটঘুটে অন্ধকারে মাঝেমধ্যে পানির খানাখন্দ, কখনো একবুক উঁচু পানির পথ পাড়ি দিতে হয়, যেখানে দেখা মিলতে পারে ভয়ংকর সাপের। এ পথ পাড়ি দিতে পারলেই যেন দেখা দেবে আবার জীবন। ‘এই পথে জেনে-বুঝে কেউ যেন কখনো না আসে’, চলতে গিয়ে এমনই মনে হচ্ছিল তাঁর।

আমাজনের পথ পাড়ি দিয়ে দালাল চক্রের মাধ্যমে এবার স্পিডবোট যাত্রা। তিন ঘণ্টা ৩০ মিনিটের সেই যাত্রা। এরপর আছে পাহাড়ি দুর্গম পথ বেয়ে ওপরে ওঠার রাস্তা। পথে পথে মানুষের পচা লাশ পড়ে থাকতে দেখে অনেকেই বমি করে। এই লাশগুলো পাহাড় বাইতে গিয়ে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া শরণার্থীদের। পাহাড় পাড়ি দিলেই পানামা ক্যাম্প। সেখানে নাম নিবন্ধ করতে হয়। থাকার জন্য প্রতি রাতে দিতে হয় এক ডলার করে। রাত পেরোলে সেখান থেকে জনপ্রতি ২০ ডলার পরিশোধ করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ক্যাম্প-থ্রি-এ নিয়ে যাওয়া হয়।
এই ক্যাম্প থ্রিতেই প্রথমবারের মতো খাবারের দেখা পান শরণার্থীরা। পরের রাত ক্যাম্প ফোরে কাটে। এটি জাতিসংঘের ক্যাম্প। এরপর ক্যাম্প ফাইভ। সর্বশেষ ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে সবাইকে বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে দালালেরা কিছু কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে।

পানামা ক্যাম্প থেকে পরের গন্তব্য কোস্টারিকা সীমান্ত। সেখানে দালালেরা অপেক্ষমাণ থাকে। এরপর তিন ঘণ্টা হেঁটে জঙ্গল পাড়ি দিতে হয়। নিকারাগুয়ার ভয়ংকর রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয়। কোস্টারিকার সীমান্ত পেরিয়ে হন্ডুরাস যেতে পুলিশ চেকপোস্টে আটকানো হয় শরণার্থীদের। তবে রয়েছে ঘুষের ব্যবস্থা। জনপ্রতি ৩০ ডলার করে ঘুষ দিলে ছেড়ে দেয় পুলিশ। গুয়াতেমালা থেকে হন্ডুরাস সীমান্তের দিকে অন্ধকারে দু ঘণ্টা হাঁটতে হয়। এই সীমান্তেও পুলিশকে কিছু ডলার দিলে ছেড়ে দেয়।

মেক্সিকো সীমান্তে একটি খাল পাড়ি দিতে হয়। পাড়ে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ক্ষেত্র বিশেষে পাঁচ থেকে সাত দিন জেলে থাকতে হয় শরণার্থীদের। সেখান থেকে বের হওয়ার সময় তারা এক মাসের থাকার অনুমতি দেয়।

আমেরিকার কাছাকাছি রেনেসাঁ সীমান্তে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে দালাল চক্র শরণার্থীদের সব কাপড় খুলে নেয়। একই সঙ্গে শরণার্থীদের সঙ্গে থাকা সবকিছু কেড়ে নেয়, কপালে জোটে মারধরও। সেখান থেকে গ্যাস স্টোভের একটি গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। মার্কিন সীমান্তে পৌঁছানোর আগে পানিতে নেমে একটি নদী পেরোতে হয়, যেখানে রয়েছে কুমিরের ভয়। এই রিও গ্র্যান্ডে নদীতে মরদেহ ভেসে থাকতে দেখা যায় অনেক সময়। নদী পেরিয়ে এক ঘণ্টা জঙ্গল পাড়ি দিলেই মার্কিন সীমান্ত। সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছার পর হাত উঁচু করে হাঁটতে হয়। কারণ, হাত পকেটে থাকলে বা অন্য কোনোভাবে রাখলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে হাঁটতে হয়। এরপরই ‘স্বপ্নের আমেরিকা’র সীমান্তে প্রবেশ। এভাবে দীর্ঘ বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে মার্কিন সীমান্তে দেহটি প্রবেশ করলেও আমেরিকান ড্রিমকে বন্দী হতে হয় কারাগারে।

মার্কিন সীমান্তে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁদের ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হিমাগারে নিয়ে ৪৮ ঘণ্টা উলঙ্গ রাখা হয় জীবাণু ধ্বংসের লক্ষ্যে। দু দিন পর হিমাগার থেকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য ক্যাম্পে, সেখানে পরার জন্য সবাইকে পোশাক দেওয়া হয়। চিকিৎসা সেবাও দেওয়া হয় সেখানে। এ ক্যাম্পে থাকার ব্যবস্থাও ভালো। আটককেন্দ্রে আসার সাত দিনের মধ্যে এফবিআই এজেন্টরা আসেন সাক্ষাৎকার নিতে। প্রাথমিক পরিচয় জেনে ২৬ দিন পর আরেক দফা সাক্ষাৎকারের সময় নির্ধারণ করা হয়। এফবিআই সাক্ষাৎকার নেওয়ার এক সপ্তাহ পরই পজিটিভ বা নেগেটিভ রেজাল্ট জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর কোর্টে হাজির হতে হয়। সেখানে আইনজীবীর মাধ্যমে বন্ড চাইতে হয়। বন্ড নির্ধারণ করা হয় ১০ থেকে ৫০ হাজার ডলার। বন্ড গৃহীত না হলে আশ্রয়ের আবেদন জানাতে হয়। মাস কয়েকের মধ্যে সেটিরও ফলাফল জানিয়ে দেওয়া হয়। নেতিবাচক ফল এলে আপিল করার সুযোগ থাকে।

বিআইএতে চাইলে রিভিউ করা যায়। আপিল রিভিউ শেষে যদি নেতিবাচক ফল আসে, তাহলে শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের ডাকা হয় কেস সম্পর্কে ধারণা প্রদান ও পাসপোর্ট কিংবা ট্রাভেল পাস ইস্যুর জন্য অনুরোধ করতে। সেই প্রক্রিয়া শেষে দুর্ভাগা অনেক অভিবাসীদের লোমহর্ষক সাটার ফ্লাইটে হাত-পা শিকল বেঁধে তোলা হয়! এ অবস্থায়ই ফ্লাইটে করে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক আশ্রয়, বন্ড হলে হয়তো স্বপ্নের আমেরিকায় পা রাখা যায়। কারও কারও এ সুযোগ হয় না।