কিছু কালজয়ী বাংলা গানের নেপথ্য কাহিনি

সাহিত্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে গান। প্রার্থনা-বন্দনা, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহ, প্রকৃতি-কল্পনা, আন্দোলন-সংগ্রাম হচ্ছে গানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। গান আমাদের মনের খোরাক। তাই আমরা মনের তৃষ্ণা মেটাতে গান শুনি ও গান গাই। সবার মধ্যেই একটি গায়কি সত্তা থাকে। এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি গান পছন্দ করেন না। মানুষ তাঁর আবেগ ও অনুভূতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কখনো গলা ছেড়ে, আবার কখনো গুনগুনিয়ে গান গায়। প্রতিদিন গান শোনা কিছু মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। অলস দুপুর, পড়ন্ত বিকেল কিংবা রাতের তিন প্রহরে গান শোনা তাদের চাই-ই চাই। ভ্রমণে বের হলে গাড়িতে বসে কিংবা কোনো কাজের মধ্যেও গান শোনা চাই। আমাদের মনের খোরাক পূরণ করে কিছু কিছু গান এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, তা যুগের পর যুগ মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। এমন গানগুলোকেই বলা হয় কালজয়ী গান। প্রতিটি গান রচনার পেছনেই রয়েছে কোনো না কোনো প্রেক্ষাপট, যা আমাদের কাছে অজানাই থেকে যায়। সেই অজানা ঘটনাগুলো জানার কৌতূহল সংগীতপ্রেমী সবার মনেই আছে। তেমনি কিছু কালজয়ী বাংলা গানের নেপথ্য কাহিনি বলতেই এ উপক্রমণিকা।

কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
সুনামগঞ্জের উজানধলের ভাটি বাংলার বাউল কবি শাহ আব্দুল করিমের বেশ কিছু কালজয়ী গানের মধ্যে অন্যতম ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু’। অনেকেই গানটিকে আধ্যাত্মিক বা দেহতত্ত্বের গান হিসেবে ধরে নেয়। এই ধারণাটা প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ভুল। শাহ আব্দুল করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী আফতাবুননেসা, যাকে তিনি ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন ‘সরলা’। করিমের দারিদ্র্যের সংসারের ঘানি টানতে টানতে সরলা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। অভাবের সংসারে প্রায় বিনা চিকিৎসায় বাউলের চোখের সামনেই রোগ-যন্ত্রণা নিয়ে সরলা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হতে থাকেন। করিম বিভিন্ন জায়গায় গানের বায়না করেও চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারেননি। একবার এক গ্রামে গান গাওয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়ে করিম গান গাইছেন, এমন সময় সরলার মৃত্যুর খবর আসে। করিম বাড়িতে ফিরলে তাঁর ঘরের পাশেই সরলার কবর দেওয়া হয়। সরলার মৃত্যুর জন্য বাউল কবি নিজেই নিজেকে দায়ী করতেন। এই বাউলের বাড়ির পাশেই বয়ে যাচ্ছে কালনী নদী। এই নদীর তীরে বসে সরলার মৃত্যু শোকে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে করিম গাইতে থাকেন, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু/ ছেড়ে যাইবা যদি/ কেমনে রাখিবো তোর মন/ আমার আপন ঘরে বাধিরে বন্ধু/ ছেড়ে যাইবা যদি/ পাড়াপড়শি বাদী আমার/ বাদী কালনী নদী/ মরম জ্বালা সইতে নারি/ দিবা নিশি কাঁদিরে বন্ধু/ছেড়ে যাইবা যদি।’

শুয়া চান পাখি
বাংলা লোক গানের কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী প্রয়াত বারী সিদ্দিকীর কণ্ঠে জনপ্রিয়তা অর্জন করা কালজয়ী একটি গান হচ্ছে ‘শুয়া চান পাখি’। শুয়া মানে শুয়ে থাকা, চান মানে চাঁদ, আর পাখির মানেটা সবারই জানা। বারী সিদ্দিকী ছিলেন নেত্রকোনার প্রখ্যাত বাউল সাধক উকিল মুনশির একজন শিষ্য। এই গানটির মূল রচয়িতা উকিল মুনশি। গানটি রচনার নেপথ্যে রয়েছে একটি করুণ কাহিনি। একবার উকিল মুনশি বেশ দূরের একটা গ্রামে গান গাইতে বায়না নিয়েছিলেন। গান গাইতে দলবল নিয়ে যে দিন বাড়ি থেকে বের হবেন, তখন ঘরে তাঁর স্ত্রী ছিলেন অসুস্থ। যেহেতু বায়না করা হয়ে গেছে, তাই তিনি না গিয়ে কোনো উপায় নেই। তিনি সেই গ্রামে গান গাইছেন; এমন সময় খবর এল তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। তখন যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল না, তাই পায়ে হেঁটে পথ চলতে হতো। বাড়ি ফিরতে তাই উকিল মুনশির তিন দিন সময় চলে যায়। এসে দেখেন স্ত্রীকে বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া হয়েছে। তিনি স্ত্রীর কবরের পাশে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আর তখন তিনি বিলাপ করে গেয়ে উঠলেন, ‘শুয়া চান পাখি আমার/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি/ তুমি-আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি/ আইজ কেন হইলে নীরব/ মেল দুটি আঁখি রে পাখি।’

‘বাংলাদেশ’ এবং ‘আলাল ও দুলাল’
পপসম্রাট খ্যাত বীর মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের দুটি কালজয়ী গান হচ্ছে ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘আলাল ও দুলাল’। আজম খান নিজেই এ গান দুটির গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। ‘আলাল ও দুলাল’ গানটি মূলত আজম খানের বন্ধুদের সম্মিলিত প্রয়াস। এই গানটি ঘিরে আছে একটি মজার ঘটনা। কবি জসীম উদ্দীনের বাড়ির বাগানের দেবদারু গাছতলায় প্রতিদিনই তাঁরা বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিতেন। গিটার নিয়ে টুংটাং করতেন। তাঁর দুই বন্ধু শাহজাহান ও জাহাঙ্গীর আপন দু ভাই। তাঁরা তাঁদের বাবার খুব আদরের সন্তান। তাই তাঁদের ‘আলাল-দুলাল’ বলে ক্ষেপাতেন আজম খানের আরেক বন্ধু আলমগীর। শাহজাহান হলো আলাল, আর জাহাঙ্গীর হলো দুলাল। তাঁদের ক্ষেপাতেই ‘আলাল-দুলাল’ গানের সৃষ্টি। পপসম্রাট এ গান গাইলে লজ্জায় শাহজাহান ও জাহাঙ্গীর মাথা নিচু করে থাকতেন। প্রথম প্রথম গাইতেন, ‘আলাল ও দুলাল/ তাদের বাবা হাজি চান/ প্যাডেল মেরে ওই পুলে পৌঁছে বাড়ি’।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে তখন একটা পুল ছিল। তাঁদের আড্ডা থেকে পুলটা দেখা যেত। তাঁর মেজ ভাই সংগীত পরিচালক আলম খান গানটি শুনে বললেন, ‘পুলের জায়গায় চানখাঁর পুল শব্দ দুইটা দে, শুনতে ভালো লাগবে।’ তাই করলেন তিনি। একদিন ভাবলেন, গান যখন গাইছেনই, এটা নয় কেন? বিটিভিতে ১৯৭৫-৭৬ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের জন্য গানটা রেকর্ড করলেন কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে। তারপর গানটি রাতারাতি হিট।
‘বাংলাদেশ’ গানটি তখন দেশের এক করুণ পরিস্থিতি দেখে তিনি রচনা করেছিলেন। সেটা ১৯৭৪ সালের কথা। তখন দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চলছে। দরিদ্র মানুষের পেটে ভাত নেই, ক্ষুধার রাজ্যে সাধারণ মানুষের হাহাকার। তখন কমলাপুর থেকে নটর ডেম কলেজের ফুটপাত মানুষে ভরপুর। এখানে-ওখানে অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে। মা তার দুধের সন্তানকে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালায় কেউ কেউ নিজের বাচ্চাকে বিক্রিও করে দিচ্ছে। তখন নতুন নতুন গান করতেন আজম খান। রেললাইনের পাশের ফুটপাতের বাচ্চাগুলো তাকে দেখলে ‘মামা মামা’ বলে ডাকত। তিনি প্রায় সময় সেখানে যেতেন এবং বিভিন্ন করুণ দৃশ্যের মুখোমুখি হতেন। তাদের সাথে গল্পে আড্ডায় বস্তির মানুষের হাহাকারের কথা শুনে তাঁর হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যেত। তখন তিনি ওই সময়ের হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে লিখে ফেলেন ‘বাংলাদেশ’ গানটি। এই গান নিয়ে ১৯৭৫ সালে ভীষণ একটা হইচই পড়ে যায়। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পান আজম খান। তাঁর গানের ভাষার সঙ্গে একাত্ম হয় সাধারণ মানুষ। আজও মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়, ‘রেল লাইনের ওই বস্তিতে/ জন্মেছিল একটি ছেলে/ মা তার কাঁদে/ ছেলেটি মরে গেছে/ হায়রে হায় বাংলাদেশ বাংলাদেশ।’