দেশে-প্রবাসে গান-কবিতার নকশা

সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ শামসুল হক

শেষ দেখা বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্কেই। সেবার পশ্চিতবঙ্গ থেকে সব্যসাচী লেখক সুনীল গাঙ্গুলিও এসেছিলেন। প্রবাস-থিত কবি শহীদ কাদরীও হয়েছিলেন একত্রিত। মুক্তধারার নিউইয়র্ক বইমেলায় এমন মিলনমেলা। তাতেই ফের আপন করে পেলাম তাঁকে। তিনি সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। দেহ জন্ম ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৫। দেহত্যাগ ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬। অর্থাৎ পরবর্তী প্রিয়দিন-জন্মদিন ছুঁতে আর মাত্র দুমাস। কিন্তু দিনগুলোকে আর টানতে পারলেন না। ৮১ বছরের লেখনীধন্যজীবন গুটিয়ে নিলেন। কর্কট বা ক্যানসারের ক্রন্দন যেন থেমে গেল। বন্দী হলেন অবিনাশী নিয়তির মৃত্যু-খাঁচায়। জন্মেছিলেন বাংলাদেশের উত্তর জনপদে। দারিদ্র্য-ভারাক্রান্ত প্রান্ত-জেলা কুড়িগ্রামে। যার ইতিহাস-ক্লান্ত পল্লি-গৌরব চিলমারী বন্দর। জনগায়ক আব্বাসউদ্দীন গেয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক গান। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তোর চিলমারী বন্দরে’। সেই বন্দর ছোঁয়া কুড়িগ্রামে পৌঁছে গেল লাশের গাড়ি। সাহিত্য-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এক রাজপুত্রের মরদেহ। সমাধি-সৌরভে সমাসীন। বিষাদে বিলীন এক বাঙালি পরাণ।
চিলমারী-উলিপুর-নাগেশ্বরী-ফুলবাড়ি ছোঁয়া নদী জলেশ্বরী। তারই পাশে কবির চিরশয়ন। আর পূর্বকথন হিসেবে কাব্যে সৈয়দ হকের নিজস্ব বয়ান—

কালঘুম ঘুমাইলা লখিন্দরের মত তুমি
চাইয়া দ্যাহ ফকফকা পুন্নিমার চান,
বানের পানির মত আচানক ভাইসা যায়
চর কালুয়া, রেলসড়ক, পাথর বিরান।
তোমার দুঃখে ধলাহাঁস, গাঙচিল আকাশ জুইড়া
উইড়া উইড়া কাইনদা বেড়ায়,
জলেশ্বরী নদী-জল চরের বাতাস ধুলি ফুঁপাইয়া
ফুঁপাইয়া ওঠে নীল বেদনায়।
(জলেশ্বরীর বুকে ঘুম...)

কুড়িগ্রাম বৃহত্তর রংপুরের একটি সীমান্তবর্তী জেলা। ইতিহাস-আশ্রিত আরেক জেলার নাম নীলফামারী। নীল চাষের রক্ত-স্মৃতি ধারণ করা সবুজাভ এলাকা। ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাটকের পটভূমি-পীঠস্থান। অভিনেতা-রাজনীতিক আসাদুজ্জামান নূর-এর পারিবারিক দিব্যভূমি। নীলফামারীর তেভাগা-আন্দোলন-খ্যাত উপজেলা ডোমার। সংস্কৃতি-শিক্ষায় সোচ্চার অগ্রবর্তী এলাকা। তিরিশের দশকের তুমুল জনপ্রিয় তরুণ গায়ক আব্বাসউদ্দীন স্থায়ীভাবে স্থিত হলেন ডোমারে। বিয়ে করলেন প্রগতিশীলদের গ্রাম চিকনমাটিতে। অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর পাওয়া গিয়েছিল সম্মতি। বোহেমিয়ান গায়ককে জামাই বানিয়েছিল প্রভাবশালী সরকার পরিবার।
সংস্কৃতি আর স্বামী-নিবেদিত ঘরনির নাম লূৎফুন্নেসা আব্বাস। সন্তান লালন আর কবিতায় নিবেদিত ছিলেন। পারিবারিকভাবে তিনি আমার বড় ফুপু। বাবার ‘বুবু-ডাকা’ বড় বোন। সাহিত্যের সঙ্গে-পাশে থাকি বলে খাতির পাই। লক্ষ্য করি বিশেষ টান। আমার ঢাকা জীবন হয়ে ওঠে ‘হিরামন মঞ্জিল’-মুখী। গায়ক আব্বাসউদ্দীনের পুরোনো পল্টনের সংস্কৃতিপ্রধান বাসভূমি। নিউইয়র্কে আব্বাসউদ্দীনও প্রায়শ আসেন স্মৃতির ইথারে ভেসে। আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলন কমিটি তিনবার স্মরণ করেছে। অর্থাৎ তিনটি বিশাল আয়োজনে তাঁর গান-প্রতিভা ছিল প্রধান আলোচ্য। তাঁর সুর–লহরি ছিল প্রবাস বাতাসে মহা-মুখরিত।
আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে আমাদের বন্ধন-তথ্য জানতেন সৈয়দ হক। দেখা হলে জিজ্ঞেস করতেন ফুপুর কুশলাদি। বলতেন, আহারে পঞ্চাশ-ষাটের দশক কী স্মৃতিদীপ্ত। ওই বাড়িটিতে আমরা কত যে সাহিত্য করেছি। নিয়মিত সাহিত্য-সভা বসাতেন স্বয়ং কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন। লেখক-সংস্কৃতিসেবীদের কে আসত না তাতে? আব্বাসউদ্দীনপুত্র মোস্তফা কামাল, মুস্তফা জামান আব্বাসীও লিখতেন। দুজনই বলতে পারত, গাইতও। ছোট বোন ফেরদৌসী বা মীর্ণা। গান আর লেখাপড়ায় ছিল ‘হান্ড্রেড প্লাস হান্ড্রেড’। আর মোস্তফা কামাল (দুলু), পরে প্রধান বিচারক। কিন্তু সেসময়ে সাহিত্য আসরে প্রধান আলোচক। কী তির্যক তার মুক্ত-মন্তব্য। বিশ্লেষণের গভীরতায় লেখকেরা প্রাণিত ও শাণিত হতেন। হায়, আব্বাসউদ্দীন, কী যে মুক্ত ঝরা হস্তাক্ষর ছিল। গান-লেখনী-সংস্কৃতি-মজলিশে আমৃত্যু নিবেদিত। যদি নিজের জীবনটা দীর্ঘকাল ব্যয় করতে পারতেন! কী দ্রুততায় চলে গেলেন...কত সালে যেন...। যোগ করি, ১৯৫৯ সালে, ৩০ ডিসেম্বরে। হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, আমার জন্মদিনের মাত্র দিন তিনেক পরে।
স্মৃতি সতত সুখের। সতত বেদনার। কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীনকে তিনি পেয়েছিলেন স্বল্পকাল। এ জন্য আক্ষেপ ছিল। বলতেন, গ্রাম বাংলার রূপ-লাবণ্যে তিনি বিভোর ছিলেন। ছড়ানো সংস্কৃতির মুক্তো-মানিক তিনি কুড়িয়েছেন। এমন আহরণ জসীমউদদীন-আব্বাসউদ্দীনে থির হয়ে আছে। আমিও বিশাল বাংলার আকর-খোঁজা সৃষ্টি-মানুষ। জনজীবনের ছায়াপথ ধরতে অবিরাম অনুসন্ধান চালাই। মাঝে-মধ্যেই আব্বাসউদ্দীন আমাকে পেয়ে বসেন। অনুপ্রেরণা হয়ে ভাবনাকে জাগিয়ে তোলেন। কি দারুণ দোলা দিয়ে গেছেন! ‘ওরে একবার আসিয়া, যাও মোরে কান্দাইয়া/আমি মনের সুখে একবার কাঁদতে চাই’!
এই গানের কলিতে গুণগুণ করতেন সৈয়দ হক। তবে প্রেরণা সংগীত মনে করতেন আরেক সুর-পংক্তিকে। ‘হাঁকাও গাড়ি তোর চিলমারী বন্দরে’ গানটিকে। বলতেন, ‘হাঁকাও’ একটি আঞ্চলিক শব্দ। এটি জীবন্ত হয়ে আছে জাতীয় জীবনে। এ এক বিশাল সাফল্য। পরবর্তীতে সৈয়দ শামসুল হকও চূড়ান্ত সাফল্য দেখান। রংপুরের আঞ্চলিক ‘বাহে’ শব্দটি দিয়ে। মানুষকে সম্বোধন করতে ব্যাপক-ব্যবহৃত শব্দ ‘বাহে’।
বৃহৎ বঙ্গে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিদ্রোহ-গাঁথা অনেক। কাল-কে জয় করে আছে বেশ কিছু নাম। দেবী চৌধুরানী তাদের অন্যতম। ১৭৫০ পরবর্তী সময়কালে বৃহত্তর রংপুরে গড়ে তোলেন আন্দোলন। এই বিধবা নেত্রীর অন্যতম সহায় ছিলেন বিপ্লবী নূরলদীন। সাধারণ জীবন থেকে ব্রিটিশ-রোষের কান্তিমান পুরুষ। ইটাকুমারীর রাজ-ঐতিহ্যও শেষে গণআন্দোলনে শামিল হয়। যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত হয় প্রাথমিক সাফল্য। রংপুর শহর সংলগ্ন উপজেলা পীরগাছা, পীরগঞ্জ। এখনো স্মৃতি-স্মারকে ধন্য। ওই সময়ের সাহিত্য পদযাত্রায় যুক্ত হয় ‘জাগ-কবিতা।’ তাতে বিবৃত রয়েছে বিদ্রোহীদের পদ্যবিবরণ। জাগরণের বাণী-বদ্ধ পদ্য-পরিবেশনা যেন নীরব ইতিহাস। সেই ইতিহাসের এক অমূল্য চরিত্র নূরলদীন।
সৈয়দ শামসুল হক কাব্যগুণে বিপ্লবী নূরলদীনকে প্রাণবন্ত করেছেন। সারা পৃথিবীর সঙ্গে ঘটিয়েছেন পরিচয়-বন্ধন।