শেখর ভট্টাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা

আমাদের সম্পর্কের রসায়ন

তোমার প্রলম্বিত ছায়া, আমার ছায়ার সাথে মিশে
একাকার হয়ে যায়...
বিচ্ছিন্ন করে দেখতে পারি না কোনো কিছুতেই,
দেখার সুযোগও নেই কোনো কবির কিংবা বিখ্যাত কোনো বিজ্ঞানীর।
আমদের ছায়া কায়া হয়ে
কেমন এক অপরূপ আলো ছড়ায়, যেমন ছড়ায়
সন্ধ্যার কনে দেখা রোদ,
ঘুম-জাগরণের মায়াময় সূর্যের আলোক রশ্মি।
তোমার উষ্ণ নিশ্বাস, আমার নিশ্বাসকে উষ্ণতর করে তোলে,
মনে হয় চৈত্রের তাপদগ্ধ, স্বপ্নালু দুপুরে
দুজন মাতাল বাউল একটি গীতি কবিতার গাঁথুনিতে
হৃদয় হরণ করা স্বর্গীয় সুরের মাধুরীতে একাকার হয়ে যায়।
কেন এমন হয়?
আমাদের সম্পর্কের রসায়ন তো তৈরি হয়নি,
আমরা নির্মাণ করেছি একে অপরকে, যেমন নির্মাণ করে
আত্মনিবেদিত, মধ্যরাতের একাগ্রতায় নিমগ্ন হওয়া কোনো ভাস্কর
তাঁর কালজয়ী ভাস্কর্যকে।
আমরা নিবেদিত হয়েছি আমাদের নিবেদনে, আমরা কোনো কবি কিংবা
স্থপতির সৃষ্টি নই,
নীরা ও সুনীল নই আমরা,
কিংবা বনলতা ও জীবনানন্দ…কোনোভাবেই।
আমরা অমূর্ত অবাস্তবতা অথবা পরাবাস্তব কোনো ভ্রমও নই...
আমরা মূর্তমান, অখণ্ড এক ভালোবাসার শিল্প সৃষ্টি।
নিশ্বাসে, বিশ্বাসে, ধ্যানে, নিবেদনে নির্মিত হওয়া
মায়াময় এক অপরূপ কায়া,
অখণ্ড, অবিচ্ছিন্ন, সৌন্দর্য ও মগ্নতায় নির্মিত,
এক অপার ও অপরূপ বিস্ময় আমরা।
বেহুলার ভেলায় ভেসে মহাকালের গর্ভ থেকে ঢেউয়ের তালে তালে,
এগিয়ে যাচ্ছি অতল, অকুল সাগরে সীমাহীন স্বর্গীয় আলোকধারার পানে
মর্ত্যে, অমর্ত্য, আলো এবং ছায়ার বিভ্রম ও ভাবালুতায়, অমর সৌন্দর্য নির্মাণের
আকুল ও একাগ্র প্রত্যাশায় এগিয়ে চলছি সাবিত্রী, সত্যবানের ভালোবাসার গভীরতা নিয়ে।

অনুভূতির স্বরলিপি

অনুভূতির স্বরলিপিগুলো, কেমন জানি ছন্দহীন, ভাবহীন, এলোমেলো এবড়োখেবড়ো হয়ে পড়েছে।
বিস্ময়ে হতবাক কিংবা বিমূঢ় হই না আজকাল, অনুভব, অনুভূতির এমন আচরণ
সে কি কবির বলা সেই বিপন্ন বিস্ময়?
হিমালয় যদি ভেঙে পড়ে, তার পরেও শান্ত, প্রত্যয়ী কণ্ঠে বলি
জানতাম সময় হয়েছিল ভাঙনের।
জোছনার আলোমাখা রূপালি চাঁদের মুখখানা, বিষাক্ত সাপের ছোবলে, ছোবলে
নীল হতে হতে ভয়ংকর অমাবস্যায় মিলিয়ে যেতে দেখেও
পূর্ণিমার চাঁদ দেখার সুখানুভূতি নিয়ে ঘুমাতে যাই।
পিশাচের কদর্য হাতগুলো, নিষ্পাপ শিশুদের স্বর্গীয় দেহে ভয়ংকর বিষমাখা তীর
ছুড়ে দেয়, তা দেখে দেখে, সকালের প্রাতরাশ সারি,
অতঃপর বিদেশি কোনো দূতাবাসে দাতাদের সাথে চিকেন ফ্রাই চিবোতে চিবোতে,
আলোচনা করি, মূল্যবোধ কিংবা শিশু অধিকার নিয়ে,
শিশু অধিকারের সনদের, ধারা, উপধারার রেফারেন্স দিয়ে দিয়ে সারা দিন
বিমুগ্ধ করে দিই দাতাদের।
একটি মুহূর্তের জন্যও মনে পড়ে না দেবদূতদের কোমল এবং স্বর্গীয়
মুখের রোদন করা নির্মল মুখচ্ছবি
সহকর্মী, পড়শি, পরিচিতজনেরাও কেমন জানি কাঠের চেয়ার কিংবা সোফার হাতলের মতো আচরণ করেন,
বদলে যাওয়া সময়ে এগুলো মানতে হবে, মনেও নিতে হবে, কোরাসে উচ্চারিত হয়, সুবিধাভোগী রোবটিক মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে।
তারপরও নির্জন, নিঃশব্দ গভীর রাতে, করুন সানাইয়ের সুর ভেসে আসে
ক্রন্দন, দ্রোহ, ক্ষোভ এবং মানবিকতার বাণী নিয়ে,
আলো-আঁধারের দ্বান্দ্বিক যুদ্ধ, মানব, দানবের ক্রমাগত লড়াই শেষে,
ভোরের প্রত্যাশিত সূর্যের ক্ষীণ আলোকরেখা যেন বলে ওঠে,
জেগে ওঠো অমৃত সন্তান, ‘পরাজিত হবে না কখনো, হয়তো ক্ষণিক ধোঁয়াশায় বিভ্রান্ত হবে।’

সিজোফ্রেনিক ভাবনা ও ভাবালুতা

হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ছাদে ছাদে,
ফুটপাথ, ওভারব্রিজ, ফ্লাইওভার, শহরের মোড়ে মোড়ে,
যেদিকে তাকাই,
অবাক বিস্ময়ে দেখি, অজস্র সুবিশাল আয়না।
পরম যত্ন করে, কারা জানি সাজিয়ে রেখেছে,
যেমন করপোরেট বুদ্ধি মেখে, বিলবোর্ডগুলো দৃশ্যমান করে বিজ্ঞাপন কোম্পানিগুলো।
আমি যে আয়নাগুলো দেখি, শুধু কি আমিই দেখি?
ট্রাফিক জ্যামে নিথর শহর, ময়লার গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন,
ঝলমলে ইমার্জেন্সি লাইট জ্বালিয়ে উল্টো রাস্তা দিয়ে ভিআইপি গাড়ির আনাগোনা,
সবকিছু, যথারীতি, শহরের নিয়ম মেনেই চলছে।
আমার কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? নাকি হঠাৎ করে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়লাম?
আয়নাগুলোতে বীভৎস, কদাকার এবং কিছুটা অশ্লীল প্রাণীর অবয়ব দেখতে পাচ্ছি,
কী কুৎসিত অট্টহাসি, পৈশাচিক নাচের মুদ্রা, মানুষগুলো যেন, মুখোশ ছাড়া আদি ও অকৃত্রিম
দানবের রূপে রূপান্তরিত।
আমি কি রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত, নাকি আয়নায় দেখা কুৎসিত প্রাণীগুলোর ঘটছে রূপান্তর ?