নীলাঞ্জনা

-মা আমি যাচ্ছি।
-কতবার বলেছি যাচ্ছি না, বলবে আসি।
-ওহ মা ভুল হয়েছে; আসি কেমন?
-আসো।
নীলাঞ্জনা নীলা রিনির একমাত্র মেয়ে। ক্লাস এইটে পড়ে। সরকারি গার্লস স্কুলে। ওদের বাসাটা গির্জার সামনে। ওরা এই শহরের স্থানীয় নয়। রিনির হাসবেন্ড সৌরভ; রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। দুই বছর হলো এই শহরে পোস্টিং। ওরা এই বাসাটিতে ভাড়া থাকে। ওদের একমেয়ে এক ছেলে। ছেলে অম্লান নীলাভ্র। ছেলে সৃজন বিদ্যাপীঠে পড়ে ফোরে। অভ্রর সৃজন বিদ্যাপীঠ পাশেই। দুই বছরে শহরটার মায়ায় পড়ে গেছে। কী যে অদ্ভুত সুন্দর। উত্তরে নীল মেঘালয় পাহাড়ের সারি। শহরের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে সুরমা নদী। দক্ষিণে হাওর। শান্ত নিরিবিলি শহর। আত্মীয়হীন শহরটির পরিবারগুলো পরমাত্মীয় হয়ে উঠেছে অল্প কয়দিনেই। নীলা গান শিখে শিল্পকলা একাডেমিতে।
অভ্র আর নীলাকে নিয়ে যায় স্কুলে রিনি। গত দুই দিন থেকে অভ্রর জ্বর। আজ ভোররাতে রিনিরও জ্বর আসল। নীলা একাই স্কুলে চলে গেল। ওদের বাসা থেকে সোজা রাস্তাটাই গার্লস স্কুলের দিকে চলে গেছে। গায়ে চাদর জড়িয়ে রিনি তবু দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে সাদা ড্রেস কাঁধে পিংক আর ব্লু অ্যাডিডাস ব্যাগ, পনিটেল দুলিয়ে দুলিয়ে নীলা চলে গেল।
দেখতে দেখতে মেয়েটা তেরো হয়ে গেল। ওর জন্ম হয়ে ছিল রংপুরে। ধাপের মোড়ে রংপুর ক্লিনিকে। ডা. আজিজুল হক সীজার করে বলেছিলেন
–এই নেন রাজকন্যা।
একটা অ্যাম্বুলেন্স নীলার সামনে দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে চলে গেল। এই সাত–সকালে কে আবার অসুস্থ হলো? মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। অভ্রর কাছে শুয়ে থাকে নীলা। ছুটা বুয়া রহিমা আসে একটু পরে। চা নাশতা বানিয়ে টেবিলে দেয়। সৌরভ উঠে গোসল করে। নীলার কপালে হাত দিয়ে বলে–
-আমি কী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব তোমাদের? না আজ দেখবে?
-আজ প্যারাসিটামল খেয়ে দেখি। সৌরভ নাশতার টেবিলে বসে। নাশতা করে সৌরভ চলে গেল অফিসে।
চা খেয়ে ডাবল প্যারাসিটামল খেয়ে নেয়। অভ্রর জ্বর কমেছে। মুখে রুচি নেই। খেতে চাচ্ছে না। অভ্রকে একটু সিরিয়াল খাইয়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে পেপার দেখে। পত্রিকার পাতা উল্টেপাল্টে দেখে। বেশির ভাগ হতাশার খবর। ভালো লাগে না। পেপার সরিয়ে রাখে।
-ভাবি কিতা রান্না করতাম?
-মুরগি ঝোল করো। লাল শাক আর ডাল। লাউ দিয়ে চিংড়ি।
ভাত বসিয়েছে বুয়া। এই ভাতের চালটা খুব ভালো। বলক উঠলে সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে। নীলার স্কুল ছুটি হবে এখন। আর দশ মিনিটের মধ্যে মেয়েটা আসবে। নীলা এসেই ওকে জড়িয়ে ধরবে। মা অনেক খিদে পেয়েছে। আজ কী রান্না হয়েছে? কখনো রিনি মেখে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়।
–কলিংবেল বাজল।
-বুয়া খুলে দেন। নীলা আসল মনে হয়।
-ভাবি চিঠি আইছে। নীলাফা আইছইন না।
ঘড়িতে চোখ যেতেই বিরক্তিতে কপালে ভাঁজ পড়ল। সাড়ে বারোটা! নাহ এই মেয়েটা আড্ডাবাজ হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে বাসায় এসে কাপড় পাল্টে খেতে বসার কথা। এখনো নাই। আসুক আজ। আচ্ছা করে বকে দেবে।
আবার কলিংবেল বাজল। রাজনন্দিনী আসছেন এবার। এবার নিজেই দরজা খুলল। এবার আসছে মুরগীওয়ালা। গতকাল মুরগি দিয়ে গেছে। আজ টাকা নিতে আসছে। টাকা দিয়ে বিদায় দিল। টিঅ্যান্ডটি ফোন বাজছে।
-হ্যালো
-শরীর কেমন?
-ভালো। জ্বর কমে গেছে।
-নীলা ফিরল স্কুল থেকে?
-না। এখনো আসেনি।
-কী বলো?
-দুইটা বাজে প্রায়!
-আমি স্কুলে কল দেব?
-না আমি দিচ্ছি।
রিনি নীলার বান্ধবী ফাইজার আম্মুকে কল করে।
-ভাবি, আস্‌সালামুআলাইকুম। কেমন আছেন? ফাইজা স্কুল থেকে চলে এসেছে ভাবি?
-ওয়ালাইকুম সালাম। জি, আপনি ভালো? ফাইজা অনেকক্ষণ আগেই আসছে। ১২টা পাঁচে।
-ভাবি ফাইজাকে একটু দেনতো।
-হ্যালো আন্টি আস্‌সালামুআলাইকুম।
-ওয়ালাইকুম সালাম। মামনি নীলাকে দেখেছ ছুটির সময়?
-না আন্টি। নীলাতো আজকে স্কুলে আসেনি।
-হ্যালো আস্‌সালামুআলাইকুম। আসি সৌরভ চৌধুরী বলছি। রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের অফিস থেকে।
-জি বলেন। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মিস্ট্রেস।
-আপা আমার মেয়ে নীলাঞ্জনা নীলা এইটের রোল দুই। সকালে স্কুলে গেছে। কিন্তু এখনো বাসায় ফেরেনি। একটু দেখবেন প্লিজ।
-এখন তো দিবা শাখার ক্লাস চলছে। মর্নিংয়ের সবাই চলে গেছে। আচ্ছা আপনি হোল্ড করুন। আয়াকে ডেকে মর্নিং শিফটের এইটের রেজিস্ট্রার আনালেন।
আজকের রোল কল রেকর্ড দেখে বললেন
-না আপনার মেয়ে নীলাঞ্জনা নীলা আজ স্কুলে আসেনি।
-আপা কী বলছেন?
-হ্যাঁ অনুপস্থিত মার্ক করা আছে।
-ধন্যবাদ আপা।
সৌরভের মাথা ঘুরে উঠল। সকালবেলা মেয়ে বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হলো। স্কুলে গেল না, বাসায় ফিরল না। মেয়ে কই?
ঝনঝন করে ফোন বাজছে। ধরার শক্তি পাচ্ছে না।
-হ্যালো। রিনির গলা।
-হ্যাঁ রিনি বলো।
-জান নীলা নাকি আজ ক্লাসে যায়নি।
-তোমাকে কে বলল?
-ফাইজা বলল। ওই যে সৃজনের কণা ম্যাডাম ওনার ভাইয়ের মেয়ে। ওদের বাসায় ফোন করেছিলাম। সাত ঘণ্টা হয়ে গেছে। আমার মেয়ে কই? সৌরভ? শুনতে পাচ্ছ?
–আমাদের তো এই শহরে কোনো আত্মীয়স্বজন নাই। শুধু গানের স্কুল, নাচের স্কুল আর ছবি আঁকার স্কুল। আমার মেয়ে আমাকে না বলে কোথাও যায় না।
-তুমি বাসায় থাকো। আমি আসছি এক্ষুনি।
একদিন নাচের প্রোগ্রামের শেষে কলেজের এক ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে সৌরভ বলেছিল
-ও কে?
-সিনিয়র ভাই, পারভেজ নাম, কলেজে পড়ে।
-অচেনা ছেলেদের সঙ্গে কখনো কথা বলবে না।
-অচেনা না বাবা। চিনি তাঁকে।
ওই ছেলের সঙ্গে কী...! আর ভাবতে পারে না। রিনিকে নিয়ে থানায় গেল সৌরভ। জিডি করল। ছোট শহরে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল। মাইকিং হচ্ছে...
আজ সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় নীলাঞ্জনা নীলা নামে তেরো বছরের একটি মেয়ে নিখোঁজ হয়। কোনো সহৃদয় ব্যক্তি তার খোঁজ পেলে থানায় অথবা এই ফোন নম্বরে জানাতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
বন্ধুরা সবাই একে অন্যকে ফোন করল। সৌরভ রিনির হাত ধরে বসে আছে। রিনির হু হু করে জ্বর বাড়ছে। রিনি ঠকঠক করে কাঁপছে।
-সৌরভ আমার নীলা।
-রিনি তুমি শক্ত হও। আচ্ছা ওর গানের টিচার আর নাচের টিচারের কাছে একটু ফোন দিতে হবে।
-ওই ডায়েরিতে সবার নম্বর আছে। মল্লিকা চৌধুরী আর সুরঞ্জন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলল সৌরভ। নাহ। তাদের ওখানেও যায়নি। কণা ম্যাডামকে কল করল। ম্যাডাম বললেন–
-আজ বিকেলে ছবি আঁকা আর আবৃত্তির ক্লাসে আসার কথা ছিল। ও তো আসেনি।
খবর শুনে কণা ছুটে চলে গেলেন নীলার বাসায়। ম্যাডামের মেয়ে কথা আর ফাইজার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে নীলা। রিনি বারবার মূর্ছা যাচ্ছে। কী ভয়াবহ অবস্থা।
আবছা অন্ধকার, একটা গুদাম ঘর। চোখ মেলে বোঝার চেষ্টা করছে নীলা। তখন মনে পড়ল। মা বাসার গেটে দাঁড়ানো। ও দ্রুত স্কুলের দিকে যাচ্ছে। একটা অ্যাম্বুলেন্স উল্টোদিক থেকে আসছিল। একজন বোরকা পরা মহিলা ওকে একটা কাগজ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন–
-এই বাসাটা কোথায়?
একটা কেমন মিষ্টি ঘ্রাণ। তারপর আর কিছুই মনে নাই। শুধু সাইরেন বাজছিল অ্যাম্বুলেন্সের। আর একবার দুলুনিতে চোখ মেলে মনে হলো গাড়িতে করে যাচ্ছে। রিস্টওয়াচে দেখল সন্ধ্যা ছয়টা। কেমন ভ্যাপসা গন্ধ। ঘরটা ভালোভাবে খেয়াল করল। একটাই দরজা। জানালার কাছে গিয়ে বুঝল এটা একতলা। বাইরে ঢাকাইয়া ভাষায় কেউ কথা বলল। ও তাড়াতাড়ি আবার জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। একজন তালা খুলে ভেতরে আসল। ওর চোখে টর্চ মেরে দেখল।
-অহনো জ্ঞান ফিইরা আহে নাই ওস্তাদ।
-তুই বইস্যা থাক। এর ডোজ বেশি হইসে। কাইল সবরে জ্ঞান ফিরব।
-আচ্ছা ওস্তাদ।
নীলা চোখ পিটপিট করে দেখে, লোকটি একটা বস্তা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে। দরজার ভেতরে তালা দিয়ে চাবি রাখল একটা হুকে।
অল্পক্ষণের মধ্যে নাকডাকার শব্দ শুনল। আস্তে উঠল। কোনো শব্দ না করে পা টিপে টিপে চাবির কাছে পৌঁছে গেল। চাবি নিয়ে আস্তে আস্তে দরজার কাছে গেল। একটা মশা বসল মনে হয়। লোকটা ঠাস করে মারল। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। নিশ্বাসও বন্ধ। ভালো করে দেখে নিয়ে চাবি ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই তালা খুলে গেল। দরজা খুলে বের হয়েই দৌড় দিল নীলা। দৌড় দৌড় দৌড়। একবারও আর পেছনে তাকাল না।
রাস্তায় পৌঁছে একটু দাঁড়িয়ে সাইনবোর্ড দেখে বুঝল এটি পুরান ঢাকা। একটা দোকানের পাশ দিয়ে এক বাসায় ঢুকল। ঘরটাতে বেশ কিছু মানুষ। নানা বয়সী। সবাই টেলিভিশন দেখছিল। নীলা বলল
-আমি পানি খাব।
একজন বয়স্ক লোক বললেন
-খোকা পানি দে, এক গ্লাস। তুমি কী চাও? এখানে কীভাবে আসলে?
পানি খেয়ে বলল
-আমি একটা ফোন করব। এটা কোন জায়গা?
-কয়েৎটুলী।
সৌরভের মোবাইল বাজছে। অপরিচিত নম্বর। নিশ্চয়ই এখন বলবে
-তোমার মেয়ে আমাদের কাছে। এত লক্ষটাকা মুক্তি পণ। না না। ভাবতে পারে না সৌরভ।
-হ্যালো
-হ্যালো বাবা
-হ্যালো নীলা মা? তুমি...তুমি কোথায়?
ঠিক আছ? তুমি কোথায়?
-বাবা আমি ঢাকার কয়েৎটুলীতে। বাবা এটা হার্ডওয়্যারের দোকান। তুমি আংকেলের সঙ্গে কথা বলো। দোকানের নাম ‘রহমান হার্ডওয়্যার’। নীলা বলে।
-আমি এই আংকেলদের বাসায় এখন। আমি খুব জোরে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি। ওরা পিছু নিয়েছিল। কিন্তু আমি মেইন রাস্তায় লোকজনের ভিড়ে চলে আসায় ওরা আর পিছু করেনি।
-আংকেল আপনি কাছের থানায় একটা খবর দেন। আর আমার বাবার সঙ্গে কথা বলেন।
-ভাই আমার নাম আবদুর রহমান। আমি একসময় সুনামগঞ্জের ফেন্সি স্টোরে চাকরি করতাম। আল্লার কাছে শুকরিয়া। আমার বাড়িতে আপনার মেয়েটা আছে এখন।
-আমি এখনই রওনা দিচ্ছি। এখন রাত দশটা। ভোর পাঁচটা বা ছয়টায় পৌঁছে যাব। সৌরভ বলে।
নীলা প্রায় এক লিটার পানি খেয়ে ফেলল। নিকটস্থ থানার অফিসার আসলেন।
নীলা অফিসারকে বলল
-কোন বাড়িতে আমাকে এনে রেখেছিল, আমি দেখাতে পারব।
পুলিশ অফিসার বললেন
-আমার ফোর্স নিয়ে সকালে যাব। ভোরবেলায় নীলার বাবা সৌরভ চৌধুরী এসে পৌঁছালেন। নীলা বাবার গলা ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সৌরভও কাঁদলেন।
নীলার বাবার অফিসের জিপে নীলা ফিরে যাচ্ছে সুনামগঞ্জ। সঙ্গে সুনামগঞ্জের আরও অনেকে। তিনটি গাড়ি। বাবার কাঁধে ওর মাথা। সৌরভ নীলার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। গাড়ির জানালার গ্লাস নামানো। বাতাসে উড়ছে নীলার চুল। সৌরভ আঁকড়ে ধরে রাখেন নীলাকে।
আদরের মেয়েকে। যেন কেউ কোনোভাবেই কেড়ে নিতে না পারে।