প্রথম প্রেম

নতুন ভাড়াটের আগমন। শুনেছি মা কোনো একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে সেবিকার কাজ করেন। মেয়ে কোনো শপিং সেন্টারে একটা ট্রাভেলস এজেন্সির রিসেপশনিস্ট। বয়স ২০–২২ বছর হবে। তেমন সাজগোজ করে না। চোখে শুধু গভীর কাজল পরে। অভাবী সংসার, তাই অল্প বয়সেই কাজ শুরু করেছে। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক দেয়। মার্জিত রুচি বলা যায়। গাল দু দুটি কেমন ফোলা ফোলা। মসৃণ ত্বক। মায়া জাগানিয়া চেহারা। সবকিছুতে অতি সাধারণ ছাপ, যেন আরও মায়াবী করে তোলে! আসার পর থেকেই নানা বাজে কথা কানে আসছে। শুনছি মেয়েটা ভালো না। ভালো না বলতে যে কে কী বোঝাচ্ছে, কিছু বুঝি না। কিন্তু কানে চলে আসত অনেক কথা।
মেহরাজকে সবাই রাজ বলে ডাকে। পড়াশোনার দৌরাত্ম্য বেশি না হলেও সব বিষয়ে প্রবল জ্ঞান রাখে। যদিও জীবনে জ্ঞান মেধা কাজে লাগাতে পারেনি। মাথাভর্তি ঘন লম্বা চুল। ব্যাক ব্রাশ করা। অমিতাভ বচ্চন, মিঠুনের ভক্ত। পোশাকেও নায়ক নায়ক ভাব। তবে মেয়েদের প্রতি তাঁর কোনো আসক্তি কখনো দেখা যায়নি বা প্রকাশ পায়নি। পরিবারের বড় ছেলে। সব মানুষের জীবনেই প্রেম আসে। মেহরাজের জীবনেও এসেছে। যার টিনএজ জীবন গেছে কোনো মেয়েকে ভালো লেগেছে বলে কেউ শোনেনি। দেখেনি। যার কিছু ভিন্ন নেশা ছিল। মেয়ে, প্রেম এসব ব্যাপার তেমন মাথায় ঘুরত না। বই, সিনেমা, মাছ ধরা এই ছিল তাঁর জীবন। মাসুদ রানা পড়তে পড়তে নিজেকে কখনো মাসুদ রানাও ভাবত। মাসুদ রানার মতো ক্যাসিনোতে জুয়া খেলতে না পারলেও সুযোগ পেলে ছোট ছোট মজলিশে সে বসে যেতো। এ জন্য মায়ের কঠোর শাসনে পড়তে হতো। মাকে সে যমের মতো ভয় পায়!
তাঁদের বাসা আর পাশের বাসার মধ্যে বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা দেয়াল। আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে বাঁশের বেড়া। মাথার ঠিক ওপর পর্যন্ত আড়াল থাকে। কিন্তু একটু লম্বা কেউ উঁকি দিয়ে তাকালে অনেক খানি দেখতে পারবে। সে বাসার বারান্দা বা আঙিনায় কে আছে না আছে? তা ছাড়া ছোট ছোট ছিদ্র তো আছে। কথা হলো এমন অভদ্রতা কেউ কখনো করতে আসে না। শুধু চিনি, চা, পাতা বা রসুন চাওয়ার মতো নহবত আসলে, ঘরের নারী জাতি সে দিকেই একজন আরেকজনকে ডেকে পাঠান। কয়েক মাস হয়, সে বাসার ভাড়া দেওয়ার ছোট রুমে ভাড়াটে এসেছেন। মা মেয়ে দুজন মাত্র সদস্য। ছোট্ট একটা রুম। আগে এক দম্পতি থাকতেন। একটা রান্না ঘর। মাটির ছোট একটা চুলো। পাশে একটা বৈদ্যুতিক রান্নার হিটার। দু চারটি হাঁড়িকুড়ি। আগের ভাড়াটে চলে গেছেন অন্য কোথাও। সে ঘরেই মা মেয়ের ছোট্ট সংসার।
মেয়েটার নাম নীলা। ভালো নাম নীলুফার ইয়াসমিন। সকাল নয়টায় বের হয়ে যায়। সন্ধ্যা পাঁচটা ছয়টার মধ্যে চলে আসে। এসে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসে। সে মাঝে মাঝে ক্যাসেট প্লেয়ারে বেশ জোরে বাংলা গান বাজায়, যেন পাশের বাসা পর্যন্ত শব্দ যায়।
‘কিছু বলা যায় না, কিচ্ছু শোনা হয় না’
এ জন্য এ বাসা থেকে তাঁকে প্রায় ধিক্কার দেওয়া হতো। আজানের সময় কেউ গান শোনো!! আমার দেখে তো তাঁকে বেশ ভালো লাগে। কেমন নিষ্পাপ মায়াকাড়া স্বভাব। নীরব চাল–চলন। নাম নীলা বলে কি না জানি না, সে নীল জামা পরত খুব। নীল একটা মাত্র সিল্কের কামিজ সঙ্গে সাদা ওড়না সাদা কাবুলি পায়জামা। তার গরিবি যেন তাঁর ব্যক্তিত্ব বাড়িয়ে দিত। অতি সাধারণ এ পোশাকের সৌন্দর্য জরির ভেলভেটের চেয়েও যেন বেশি। আমার চোখ সে বয়সেও প্রেমিকের চোখের চেয়েও তীক্ষ্ণ। সে আমি বুঝেছিলাম খুব অল্প বয়সে। কী সব কথা মানুষের! মা নাকি মেয়েকে দিয়ে ব্যবসা করে! ব্যবসাটা যে কী, সেটাও জানি না। তবু শিশু মনের প্রশ্নগুলো পুতুল খেলার মাঝে চাপা পড়ে যেতো। ফুসফাস কথা ছোটদেরও কানে আসে। কিন্তু এরা অনেক সময় এসব বুঝতে পারে না। বড় হলে অনেক কিছুর মানে পরিষ্কার হয়ে যায়। এখন খুব বুঝতে পারি, ঘুণে ধরা সমাজে বেকার পুরুষের মূল্যও কয়েকগুণ বেশি। এরা না থাকলে পরিশ্রমী খেটে খাওয়া রমনীও বেশ্যা হয়ে যায় নিমেষে। সমাজ তাদের তাড়া করে কুকুরের মতো।
মেহরাজের ছিল হিন্দি গান শোনার স্বভাব। কয়েকদিন ধরে সে তাঁর স্বভাববিরোধী কাজ শুরু করল। অফিস থেকে ফিরে এলে যে ছেলেকে ঘরে রাখা যায় না জিঞ্জির দিয়ে বেঁধে। সে ঘর থেকে বের হয় না। প্রায় সময় দেখা যায়, পেছনের জানালা থেকে সে পাশের বাসার ছোট কামরার দিকে চেয়ে আছে। যেন আকাশ দেখছে। কেমন উচাটন! উচ্চ ভলিউমে হিন্দি গান যেন সকাল সন্ধ্যা সঙ্গী হয়ে উঠল।
ভাগ্যে থাকুক আর না থাকুক, প্রকৃতি কখন যে চার চোখ এক করে দিয়েছে তা তারাও জানে না। একদিন রাজ ছোট চিরকুটে জানিয়ে দিল সময়। রাতে যেন বের হয়ে আসে। সে দিনের আলোতে কখন কোথায় যায়? সব খবর তাঁর মায়ের কাছে চলে আসে। তাই ঠিক করল, রাতের আঁধারে সে নীলার সঙ্গে জীবনে একবার হলেও দেখা করবে। রাত ১২টা বাজতেই দুজনে সামনের গেট দিয়ে বের হয়ে এল। কোথায় বসবে, কোনো পরিকল্পনা নেই। রাস্তার পাশে স্ট্রিট লাইটের আলো। অদূরে পানির বড় ট্যাংকের ছায়া যেন অশরীরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে। কলোনি এলাকার সঙ্গে অদূরে লাশ কাটা ঘর।
রাজ কিছুক্ষণ ভাবল! হঠাৎ তাঁর মনে হলো, এর চেয়ে নিরাপদ স্থান আর কোথাও নেই। সেখানে পাশে একটা খালি রুম, যেখানে এক সময় বেওয়ারিশ লাশ ফেলে রাখা হতো। এখন কিছু নেই। সিঁড়িটা অনেকটা দোতলার লেভেলে। কারণ সে ঘরের ভেতরের গর্ত নিচতলার সমান। সেখানে লাশ ফেলে রাখা হতো। এক সময় এসবের পাশ দিয়ে হাঁটলে পচা শরীরের গন্ধ ভেসে আসত। নীলার হাত ধরে মেহরাজ সেদিকেই হাঁটা দিল। এখানে এত রাতে কেউ আসবে না। রাতে লোকজন এদিকে আসতে ভয় পায়। নীলার অবশ্য এসব ব্যাপারে কোনো কিছু জানা নেই। সে প্রেমের সম্মোহনী মন্ত্রে যেন উড়ে চলেছে। তারপর জীবনের প্রথম প্রেমের আলিঙ্গন! অনেক চেনা আবার অচেনা এক মানুষের নিঃশ্বাসে মিশে গেল। মিশে গেল কালের সমুদ্রে।
তাঁরা সিঁড়ির মাঝখানে বসল। দুপাশে উঁচু করা পাটাতনের মতো। বসে দুজনেই যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে কি ভাবল। পূর্ণিমার আলো ছিটকে পড়ছে। বড় বটগাছের ডালগুলো কেমন যেন আলোছায়ায় রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে। দুজনেই বিহ্বল এমন পাগলামিতে।
‘চলো, চলে যাই চলে যাই’—কয়েকবার বলেও নীলা যেন নড়তে পারছিল না। মা ঘুমের ওষুধ খান, তবুও ভয় যদি ঘুম ভেঙে তাকে না পান! নীলা না জানলেও রাজ জানে এ এলাকা। সে বেড়ে উঠেছে জন্ম থেকে। লাশ কাটা ঘরের ভয়! সব যেন পরাজিত প্রেমের কাছে। নীলা ভুল করছে জেনেও রাজের হাত ধরে ওপরে উঠল। দুজন যখন ফিরে আসছে, তখন মধ্য আকাশের চাঁদ একপাশে ঢলে পড়ছে। অন্যপাশে সূর্য ওঠে ওঠে। মানব-মানবীর প্রেম, সৃষ্টির সূত্রের কাছে পরাজিত হয়, না জয়ী হয়? সে শুধু বিধাতা জানেন। এমন ভুল না হলে যেন সৃষ্টির সূত্রই ভুল হয়ে যেতো। মানুষের এত সাধ্য কোথায় তাঁকে উপেক্ষা করে! তাই তো এঁরা সব ভুলে ভালোবাসার মালা গাঁথে ভুল সূত্রে।
কোনো বিষয়ই তাঁর মায়ের নজর এড়ায়নি। এক বছরও হয়নি মেহরাজকে বিয়ে দিয়েছেন। ঘরে বউ, অথচ তার মন ঘরে নেই। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তার বাইরের উচাটন স্বভাব দূর করতেই অল্প বয়সে তাকে বিয়ে দিয়েছেন। তার কারও সঙ্গে সম্পর্ক নেই জেনেই বিয়ে ঠিক করেছিলেন। সে এখন কি করছে? এ মেয়ে আগে তাঁর জীবনে আসলে উনি কিছু মনে করতেন না। কিন্তু এখন এটা মানায় না। মেহেরুন মাটির চুলা থেকে আগুন নিয়ে সিগারেট ধরালেন। ঠোঁটে দিয়ে টানতে টানতে ভাবতে লাগলেন, কি করা যায়? এ প্রেম না ভাঙলে ঘরের বউকে, তার পরিবারকে কি বলবেন? গ্রামের মেয়ে। নিরীহ স্বভাব। মনে মনে কষ্ট পাচ্ছে। তার চোখেও নিশ্চয় পড়েছে। তিনি যে জানেন, কাউকে এটাও বুঝতে দিলেন না।
এভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। কথা না হলেও গানে গানে চলে প্রেমের বন্দনা। মেহেরুন অসীম ধৈর্য নিয়ে বসে থাকলেন। বউমা কখনো কোনো কিছু বলে না। পরদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ শোনা গেল পাশের বাসা থেকে চিৎকার। কেউ একজন তাঁদের পেছনের দরজায় বাড়ি দিচ্ছে আর গালাগাল করছে। অসহায় এক মা কাঁদছেন। যিনি ঘর ভাড়া দিয়েছেন, তিনি বের হয়ে আসলেন। কাকে সামলাবেন। ঘরের পেছন দিক দিয়ে মাতাল ডোম সুরুজ এসেছে। বলছে, ‘এখানে নারী জাতি দিয়ে ব্যবসা চলে। আমার বউ নিজে দেখেছে। আমাদেরও মানসম্মান আছে। কাল রাতেও লোক এসেছে।’
বাড়ির মালিক আশ্বস্ত করলেন, তাঁরা চলে যাবে। বাংলা পানি খেয়ে এ সামান্য অভিনয়ের কাজটার জন্য সে একশত টাকা পেয়েছে। সে বেশ উৎফুল্ল।
মা–মেয়ে চলে গেলেন। কোথায়, কখন গেলেন? এ এলাকার কেউ জানে না। সময়ের অতল গহ্বরে জীবনের প্রথম প্রেম হারিয়ে গেল রাজের। খুব অসময়ে এবং স্বল্প সময়ের জন্য। ‘প্রেম একবার এসেছিল নীরবে’ একবার বলতে যা বোঝায় ঠিক তেমনটি। এটি সত্য, তারপর আর তাঁর জীবনে প্রেম আসেনি। যে প্রেমের কোনো ভিত্তি ছিল না, সে তাকে কিছুটা তছনছ করে দিয়ে গেছে বটে। সম্ভবত সে দুঃখ সইতে না পেরে, জীবনে প্রথম সে একদিন মদ খেয়ে বাড়ি ফিরল। তাঁর সে স্বরূপের সঙ্গে এক বালিকা বধূরও প্রথম পরিচয় হলো। সিনেমা ছাড়া যিনি কখনো মাতাল দেখেননি। তাঁর সামনে তাঁর মাতাল স্বামী পড়ে আছেন। যিনি গুনগুন করছেন-
‘ইয়ে হাম কেয়া জানে
ইয়ে ওহি জানে জিসনে লিখা সব কা নসীব’।