নোবেল শান্তি পুরস্কার এবার কোনো নারী পাচ্ছেন কি

আজ ১১ অক্টোবর শুক্রবার নরওয়ের অসলোতে নোবেল কমিটি ঘোষণা করবে এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর নাম। পুরস্কারটি সেই ব্যক্তি বা সংস্থাকে প্রতি বছর প্রদান করা হয়, যারা বিশ্ব শান্তির প্রচারে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। গত বছর, কঙ্গোলোজের ডাক্তার ডেনিস মুকওয়েজ এবং মানবাধিকারকর্মী নাদিয়া মুরাদ যৌথভাবে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে যৌন সহিংসতা বন্ধের প্রচেষ্টার জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
নোবেল ইনস্টিটিউট অনুসারে এই বছর পুরস্কারের জন্য ৩০১ জনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ২২৩ জন ব্যক্তি এবং ৭৮টি সংস্থা রয়েছে। মনোনয়নের আনুষ্ঠানিক তালিকাটি গোপন থাকলেও দৌড়ে কে এগিয়ে রয়েছে, তা নিয়ে জল্পনা থেমে নেই। অবশ্য নোবেল কমিটির বিজয়ী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতার কারণে খুব কমই অনুমানযোগ্য।
শোনা যাচ্ছে, নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য এই বছর মনোনয়ন পেয়েছেন বেশ কয়েকজন নারী। আফ্রিকা থেকে মনোনীত হয়েছেন দুজন তরুণ মুসলিম নারী। সোমালিয়ার ২৯ বছর বয়সী ইলওয়াদ এলমান ও লিবিয়া থেকে ২৬ বছর বয়সী হাজের শরিফ। তাঁরা উভয়ই জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের চূড়ান্তভাবে একত্রীকরণ উদ্যোগের অংশ, যা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ১০ জন তরুণ কর্মীকে একত্রিত করেছিল।
ইলওয়াদ এলমান মূলত সোমালিয়ার মোগাদিসু থেকে আগত। তাঁর মা ফারতুয়াম আদন ও বাবা এলমান আলী আহমেদ উভয়ই মানবিক ও শান্তির কাজে জড়িত ছিলেন। ইলওয়াদ তাঁর মা ও বোনদের সঙ্গে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন। ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে যুব পুনর্বাসন এবং মানবিক শান্তি কার্যক্রমে জড়িত থাকার কারণে তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল। ইলওয়াদ ২০১০ সালে ১৯ বছর বয়সে সোমালিয়ায় ফিরে যান। সেখানে সে বাবার দেখানো পথ ধরে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি তাঁর দেশে শান্তি আনার জন্য সাহস ও শক্তি নিয়ে মানবতাবাদী ও নারী অধিকারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করেন। সোমালিয়ায় এলমানের বহু কাজের মধ্যে একটি অর্জন হলো লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা ও নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের জন্য সোমালিয়ার প্রথম ‘ধর্ষণ সংকট কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা।
২০১১ সালে লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধের ভয়াবহ ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর হাজের শরিফ প্রথমে সক্রিয়ভাবে মানবিক কাজ ও শান্তির উদ্যোগে জড়িত হতে শুরু করেন। এই সময়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে শরিফ ‘টুগেদার উই বিল্ড’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধপরবর্তী লিবিয়ায় শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটানোই ছিল তাঁর সংস্থার লক্ষ্য। নারী ও দেশের যুবসমাজকে শক্তিশালীকরণের দিকে মনোনিবেশ করে শরিফ লিবিয়া ও উত্তর আফ্রিকাজুড়ে অনেকের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে অবিরত কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১৩ সালে ১৩২৫ নেটওয়ার্ক প্রকল্পের সহ-সূচনা করেন। লিবিয়ার ৩০টি শহরে মানবাধিকার সংগঠন ও কর্মীরা এখানে কাজ করছে। শরিফ এমন এক ভবিষ্যৎ গড়তে সহায়তা করছেন, যেখানে লিবিয়ানরা মানবাধিকার ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য একত্রিত হতে পারে। তিনি বর্তমানে একজন আইনের ছাত্র।
এই বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ের জন্য গ্রেটা থানবার্গ স্পষ্টত ভালো নির্বাচন বলে মনে করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদকন্যা গ্রেটা জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল নিয়ে তার ব্যাপক প্রচারণা, বক্তৃতা ও প্রতিবাদের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে। পনেরো বছর বয়সে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে সুইডিশ পার্লামেন্টের বাইরে গ্রেটা তার স্কুল ধর্মঘট শুরু করে। তার এক বছরেরও কিছু পরে, ২০ সেপ্টেম্বর তার ডাকা বিশ্বব্যাপী ধর্মঘটে প্রায় ৪০ লাখ কিশোর-কিশোরী যোগ দিয়েছিল। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই স্কুল পডুয়া। থাইল্যান্ড থেকে আফগানিস্তান ও হাইতি পর্যন্ত এই বিক্ষোভ বিস্তার লাভ করে। কিছুদিন পর গ্রেটা থানবার্গ ২৩ সেপ্টেম্বর জলবায়ু অ্যাকশন শীর্ষ সম্মেলনে একটি আবেগাপ্লুত ভাষণ দেয়। তার বক্তব্যে সে বড় বড় বিশ্বনেতাদের অভিযুক্ত করে। বক্তব্যে গ্রেটা বিশ্বনেতাদের জলবায়ু পরিবর্তন বন্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য তীব্র নিন্দা করে।
বিগত এক বছরে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আহডার্ন নিউজিল্যান্ডে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক এক ঘটনার মুখে সহানুভূতি, প্রজ্ঞা ও শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে জঙ্গি হামলায়, কয়েক ডজন আহত ও ৫১ জন মারা গিয়েছিল, যা সারা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল। জেসিন্ডা সেই জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেন। হামলার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের সংসদ বেশির ভাগ স্বয়ংক্রিয় ও আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের পাশাপাশি বিদ্যমান অস্ত্র আইন সংশোধনে পদক্ষেপ নেয়। নিউজিল্যান্ড পার্লামেন্ট বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করার জন্য ১১৯ ভোট দিয়েছিল। ৩৮ বছর বয়সী জেসিন্ডা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী নেতা, যিনি বন্দুকধারীকে তাঁর সাদা আধিপত্যবাদী মতামতকে উজ্জীবিত করার কোনো প্ল্যাটফর্ম দিতে অস্বীকার করেছিলেন। বরং কঠোরভাবে তাঁর বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন, ‘আপনি কখনই আমাকে তাঁর নাম বলতে শুনবেন না।’ জেসিন্ডার নেওয়া এই কঠোর পদক্ষেপগুলো নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তাঁকে একজন শক্তিশালী প্রতিযোগী করে তুলেছে। যদি তিনি জেতেন, তবে তিনিই হবেন নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত নিউজিল্যান্ডের প্রথম ব্যক্তি।