দিলওয়ার শুধু সিলেটের নন

দিলওয়ার, সুরমা পারের কবি। আটলান্টিকের এপারে বসে তাঁকে নিয়ে লিখছি। কাব্যের রূপ-রস-ছন্দ-মাত্রা অথবা ব্যাকরণ-গাঁথুনি, তত্ত্ব-তথ্য বিশ্লেষণ, এর কোনোটাই আমি করছি না। এর যোগ্যতাও আমার নেই। লেখাটা স্রেফ স্মৃতিচারণা।
‘সুরমা পারের কবি’ হলেও দিলওয়ার শুধু সিলেটের কবি নন। বাংলা ভাষাভাষীর কবি। এক সময় ভাবা হতো, ঢাকায় যারা বসবাস করেন তারা ‘জাতীয়’ কবি বা লেখক, মফস্বলের কবি-লেখকেরা ‘আঞ্চলিক’। এর মধ্যেও শুনতাম, দিলওয়ার (সিলেট) ও ওমর আলী (বগুড়া) মফস্বলে থাকলেও তাঁরা শক্তিমান জাতীয় কবি।
দিলু ভাই (কবি দিলওয়ার) ‘আঞ্চলিক’ কবি ছিলেন না। ‘সুরমা পারের কবি’ বলেছি অন্য এক কারণে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রথম আলোয় ‘কবি দিলওয়ারের মাটির টান’ শিরোনামে প্রকাশিত লেখায় আমি বলার চেষ্টা করেছি, ঢাকা-নিউইয়র্কের আকর্ষণ কখনো দিলু ভাইকে বেঁধে রাখতে পারেনি, বারবার ফিরে গেছেন তাঁর পিতৃভিটায়, সুরমা পারের ভার্থখলায়। সিলেট শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে নদী সুরমা। পুরোনো কিনব্রিজের এ প্রান্তে ভার্থখলা, ওপ্রান্তে সার্কিট হাউস-সারদা হল। দিলু ভাইয়ের জীবনের শুরুতে লেখা ‘কিনব্রিজে সূর্যোদয়’ কেন জানি আমার প্রিয় এক কবিতা। জন্মভূমির টানে অন্য কোথাও তাঁর হয়নি ঠাঁই। আসলে তিনি নিজেই চাননি।
দিলওয়ারের পরিচিতি গণমানুষের কবি হিসেবে। অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। যুদ্ধে-সংগ্রামে ছিলেন অগ্রভাগে, মানুষের পাশে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে তাঁকে দেখেছি মাঠে সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের আগে সিলেটের কবি, লেখক, শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক—সবাই জড়ো হয়েছিলেন এক ছাতার নিচে, ‘সমস্বর’ নামের ব্যানারে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কবি দিলওয়ার। ‘সমস্বর’ সে সময় সিলেটের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। দিলওয়ার ছিলেন সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এক অসাম্প্রদায়িক মানুষ। আমার মতে, তাঁর নামের পাশে যে বিশেষণটি সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয়, তা হলো, তিনি ছিলেন মানবতার কবি।
সিলেটের সারদা হলে (সম্ভবত আশির দশকে) সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে কবি দিলওয়ারকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। এই সংবর্ধনায় প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর আবদুল মান্নান। তিনিও দিলওয়ারের কাব্যে মানবতার যে জয়গান তার প্রতিধ্বনি করেন। কবি দিলওয়ারের মানবিক গুণাবলি ছিল অতুলনীয়। খুব সহজেই যে কাউকে আপন করে নিতেন। অমায়িক ব্যবহার ছিল তাঁর সহজাত গুণ। ব্যক্তিগত আক্রমণ, পরনিন্দা, কারও সম্পর্কে মন্দ কিছু বলতে কখনো শুনিনি। কনিষ্ঠদের স্নেহ-ভালোবাসায় আপ্লুত করতেন। হৃদয়টা ছিল বিশাল। অতিথি আপ্যায়নে তাঁর জুড়ি ছিল না।
আমার গ্রামের বাড়ি শহরতলির মোগলাবাজারে। ট্রেনে যাওয়া-আসা করতাম। রেলস্টেশন দিলু ভাইয়ের বাড়ির কাছেই। আসা-যাওয়ার পথে মাঝেমধ্যে বাড়িতে ঢুঁ মারতাম, সেই ষাটের দশক থেকে। কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও না খাইয়ে ছাড়তেন না দিলুভাই। কখনো দেখা যেত, এক গ্লাস দুধ নিয়ে পেছন পেছন আসছেন, দাঁড়া এটুকু খেয়ে যা। কী অসাধারণ মুহূর্ত!
এ মানবিক গুণ ছিল তাঁর স্ত্রী পরলোকগত আনিসা দিলওয়ারেরও।
সত্তর দশক। আমি তখন প্রাচীনতম সাপ্তাহিক যুগভেরীতে। দিলু ভাইয়ের জনপ্রিয় ছড়ার সিরিজ ‘সেই দেশ কোন দেশ?’ ধারাবাহিকভাবে যুগভেরীতে প্রকাশিত হতো। ছড়ার মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজের নানা অসংগতি তুলে ধরতেন কবি। প্রতি সপ্তাহে প্রায় শত লাইনের ছড়ার এই সিরিজ ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এই সিরিজের মধ্য দিয়ে দিলওয়ার প্রমাণ করলেন, তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় শক্তিমান ছড়াকারও।
ওই সময় প্রায় প্রতি সপ্তাহে দিলুভাই যুগভেরীতে আসতেন। কখনো সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন ওই সপ্তাহের ‘সেই দেশ কোন দেশ?’ আবার কখনো অফিসে বসেই সবার সঙ্গে গল্প করে করে লিখে দিতেন। দিলু ভাই যে দিন যুগভেরীতে আসতেন, সেদিন অফিসে জমজমাট আড্ডা হতো। যুগভেরীর সহকর্মীরা ছাড়াও অতিথি লেখক-সাংবাদিকেরা এসে জড়ো হতেন। আড্ডা মূলত দিলু ভাইকে ঘিরেই। তিনিই মধ্যমণি। পকেট থেকে টাকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলতেন, ‘সবাইকে আপ্যায়ন করাও।’ না না বলেও কাজ হতো না। বলতাম, ‘দিলুভাই, যুগভেরীতো হোস্ট, আমরাই করব।’
বলতেন, ‘আমি কি পর? যুগভেরীর কেউ নই? তোমরাতো সবদিনই করো, আজ না হয় আমি করলাম।’ অগত্যা রাগ করবেন ভেবে দিলু ভাইয়ের কথা মেনে নিতাম। আর এর পুনরাবৃত্তি হতো ঘনঘন। দেওয়ার মধ্যেই যেন তাঁর আনন্দ।
যে কবির মনটা এমন মানবিকতা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসায় ভরপুর, তাঁর সৃষ্টিতে জয়গান থাকবে মানবতার, এটাই তো স্বাভাবিক।
একুশে পদক ও বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি দিলওয়ারের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সভা ও কবিতা পাঠের আয়োজন করেছে। দিলওয়ারকে স্মরণ করায় তাঁদের অসংখ্য ধন্যবাদ। বিশেষ করে ইব্রাহীম চৌধুরী ও ইশতিয়াক রুপু আহমদের উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
আগেই উল্লেখ করেছি, কবি দিলওয়ারের ‘কিনব্রিজে সূর্যোদয়’ আমার এক প্রিয় কবিতা। ‘উদ্ভিন্ন উল্লাস’ বা ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’র মতো বিপুল প্রশংসিত আরও কাব্যগ্রন্থ কবির রয়েছে। কিন্তু কেন জানি ‘কিনব্রিজে সূর্যোদয়’ বারবার সামনে চলে আসে। কিন্তু লজ্জার বিষয়, কবিতাটি আমার সংগ্রহে নেই। নিউইয়র্কে বসবাস করেন কবির জ্যেষ্ঠ ছেলে শাহীন ইবনে দিলওয়ার। তাঁকে অনুরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে কবিতাটি আমার ইনবক্সে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেটা পত্রস্থ করে আমার লেখাটির সমাপ্তি টানছি—
এখন প্রশান্ত ভোর। ঝিরঝিরে শীতল বাতাস
রাত্রির ঘুমের ক্লান্তি মন থেকে ঝেড়ে মুছে নিয়ে
আমাকে সজীব করে। ঊর্ধ্বে ব্যাপ্ত সুনীল আকাশ
পাঠায় দূরের ডাক নীড়াশ্রয়ী পাখিকে দুলিয়ে।
নিচে জল কল্ কল্ বেগবতী নদী সুরমার,
কান পেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা
গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা,
সৃষ্টির পলিতে সে-ই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার।
সহসা ফিরিয়ে চোখ চেয়ে দেখি দূর পূবাকাশে
তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ
পাখির কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে
দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী করুণ।
ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা
কিনব্রিজে আঘাত হানে। শুরু হয় জনতার চলা।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক