আ.লীগ নেতৃত্বকে নেত্রীর বার্তা বুঝতে হবে

যুক্তরাষ্ট্র শাখা আওয়ামী লীগ গত কয়েক বছর ধরেই প্রবাসী বাংলাদেশি রাজনীতিকদের মধ্যে আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু সুবিধাবাদী ছাড়া সবারই প্রত্যাশা একটি নতুন কমিটির। কিন্তু আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু–কন্যা শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতা-কর্মীদের প্রত্যাশিত ও বহুল আকাঙ্ক্ষিত কমিটি এখনো দেননি। তিনি বলেছেন, ‘সময় হলেই তিনি কমিটি দেবেন’।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘তাঁর হাতে গড়া যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আছে। তবে সময় হলেই তিনি একটি নতুন কমিটি দেবেন।’ এতে দলনেত্রী এও বলেছেন, ‘তাঁকে কাউকে চিনিয়ে দিতে হবে না, তিনি সবাইকে চিনেন। সুতরাং দলের যুক্তরাষ্ট্র শাখার নতুন কান্ডারি কে হবেন, তা তিনিই ঠিক করবেন।’
সংবাদ সম্মেলন থেকেই আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি পুরোনো কমিটি’ শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সংবর্ধনা ২৮ সেপ্টেম্বরের সভায় যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতাদের একটি ম্যাসেজ দিয়েছেন। কিন্তু জননেত্রী শেখ হাসিনার সেই ম্যাসেজ বর্তমান নেতা-কর্মীরা বুঝতে পারলেন বলে মনে হল না। একইদিন সংবাদ সম্মেলনে তিনি নতুন কমিটির প্রত্যাশিত নেতা-কর্মীদেরও একটি ম্যাসেজ দিয়েছেন। আশা করি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব সেই ম্যাসেজটি ধারণ করতে পারবেন।
নিউইয়র্কে সংবাদ সম্মেলন শেষে যখন শেখ হাসিনার নিউইয়র্কের অস্থায়ী আবাসস্থল লটে নিউইয়র্ক প্যালেসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দেলর যুক্তরাষ্ট্র শাখার শীর্ষ কয়েকজন নেতা এসে হ্যান্ডশেক করলেন বেশ খোশমেজাজে। তাদের এই খোশমেজাজ দেখে প্রতিভাত হল, নতুন নেতৃত্ব তাঁর দেওয়া ম্যাসেজটি পড়তে পারেননি।
২০১৮ সালে শেখ হাসিনার নিউইয়র্কের সংবর্ধনাস্থল ‘নো মোর সিদ্দিক’ স্লোগানে উত্তাল ছিল। যুক্তরাষ্ট্র শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ শেখ হাসিনার টেবিল ভর্তি হয়েছিল। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। সিদ্দিকুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফাইল শেখ হাসিনার টেবিলে পাঠানো হয়েছে। তাঁর সঙ্গে সফররত উচ্চপর্যায়ের নেতা-কর্মী, পদস্থ কর্মকর্তা এমনকি সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও দফায় দফায় বৈঠক করেছে দলের যুক্তরাষ্ট্র শাখার তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান (গোলাপ) লটে প্যালেস হোটেলের লবিতে এসে ঘোষণা দেন, ‘শেখ হাসিনার সংবর্ধনা সভায় নেত্রী নিজেই সভাপতিত্ব করবেন এবং একমাত্র বক্তা হিসেবে তিনিই প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন।’
আবদুস সোবহানের এই ঘোষণায় সেদিন যুক্তরাষ্ট্র শাখা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা স্বস্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যান। সবার মনেই নতুন কমিটির ব্যাপারে আশা সঞ্চার হয়। কিন্তু সভানেত্রীর সংবর্ধনা সভায় ড. সিদ্দিকুর রহমানসহ বর্তমান কমিটির জায়গা না–হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষিত হয়নি প্রত্যাশিত নতুন কমিটির। সংবর্ধনা সভায় শেখ হাসিনা ড. সিদ্দিকুর রহমান ও তার অনুসারীদের মঞ্চে বসতে না দিয়ে যে ম্যাসেজটি দিলেন সেটি হল, ‘যুক্তরাষ্ট্র শাখা আওয়ামী লীগ আছে এবং থাকবে। কিন্তু এই সংবর্ধনা সভার মধ্য দিয়ে সিদ্দিকুর রহমান ও তার কমিটির এক ধরনের অলিখিত অবসান হল।’ এটিই মূলত বোঝার বিষয়।
সংবর্ধনা সভা শেষে সবার কাছে একই প্রশ্ন, কখন হবে যুক্তরাষ্ট্র শাখার প্রত্যাশিত নতুন কমিটি। কখন শেখ হাসিনা নতুন নেতৃত্ব ঘোষণা করবেন। জল্পনা–কল্পনা গিয়ে শেষ হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে। সবার ধারণা ছিল তিনি সংবাদ সম্মেলনে নতুন নেতৃত্বের ঘোষণা দেবেন।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব নিয়ে সাংবাদিক লাভলু আনসারের করা এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র শাখা আওয়ামী লীগ আমার হাতের গড়া সংগঠন। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আছে এবং থাকবে। কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে। আমি সবাইকে চিনি। সময় হলেই আমি নতুন কমিটি করে দেব।’
শেখ হাসিনার এই ঘোষণায় যেমন হতাশ হয়েছে প্রত্যাশিত নতুন নেতৃত্ব, তেমনি খুশিও হয়েছে। পুরোনো নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছে, শেখ হাসিনা যেহেতু নতুন কমিটি দেননি, তাহলে আমরা এখনো বহাল আছি। ফলে অতি উৎসাহী এই নেতাদের বেশ খুশি হয়ে উঠতে দেখা গেছে খুব দ্রুত। কিন্তু বিষয়টি কি আসলে তাই? শেখ হাসিনার বিচার–বুদ্ধি ও বিবেচনার সঙ্গে যে ম্যাসেজটি দলের যুক্তরাষ্ট্র শাখার বর্তমান নেতৃত্বকে দিয়েছেন, সেটি তারা আসলেই বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারলে হয়তো আবারও তাঁরা বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে লাফিয়ে উঠতেন না। শেখ হাসিনার নতুন কমিটি ঘোষণা পর্যন্ত তাঁরা নীরবে অপেক্ষা করতেন।
২ অক্টোবর সন্ধ্যায় ওয়াশিংটনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাংসদ মুহাম্মদ ফারুক খান। মতবিনিময় সভায় তিনিও দলের যুক্তরাষ্ট্র শাখার বর্তমান নেতৃত্বকে দলীয় সভাপতির ম্যাসেজটি বুঝবার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নিউইয়র্কে নাগরিক সংবর্ধনা সমাবেশে সভাপতিত্ব করার সুযোগ পাননি সিদ্দিকুর রহমান। এমনকি তাঁর কমিটির কেউই সেটি পরিচালনারও সুযোগ পাননি। এখান থেকেই তাঁকে বুঝতে হবে, তাঁর নতুন করে কিছু করা উচিত হবে না। কোন সিটি অথবা স্টেটে সম্মেলন অথবা কমিটির প্রক্রিয়ায় না–যাওয়াই তাঁর জন্য শ্রেয় হবে। কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপের অপেক্ষায় থাকা উচিত তাঁর। এ সময়ে কোন ধরনের কোন্দল বা বিরোধে লিপ্ত হওয়া সমীচীন হবে না। ফারুক খান উল্লেখ করেন, এতত্সত্ত্বেও সিদ্দিকুর রহমান যদি নতুন করে কিছু করতে চান, তাহলে তাঁকে পরামর্শ দেবেন বিরত থাকতে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খানের মন্তব্যের পর আশা করছি, দলের যুক্তরাষ্ট্র শাখার বর্তমান নেতৃত্ব তার কর্মপরিধি বুঝতে পারবেন এবং কেন্দ্রের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবেন। শেখ হাসিনা ও মুহাম্মদ ফারুক খানের বার্তা ও পরামর্শ যুক্তরাষ্ট্র শাখার বর্তমান নেতৃত্ব দ্রুতই বুঝতে পারবেন, আশা করতে দোষের কিছু নেই বলে আমি মনে করি।
বুজলে বুজপাতা, না বুজলে তেজপাতা। কথা কিন্তু ক্লিয়ার।