কালজয়ী কবি দিলওয়ার

বাংলা সাহিত্যে যে কজন শক্তিমান কবি তাঁদের মেধা–মনন ও সৃষ্টিকর্ম দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে করেছেন সমৃদ্ধ, কবি দিলওয়ার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান দেশের অন্য যেকোনো জাতীয় পর্যায়ের কবিদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ কবি শামসুর রহমান, কবি সুফিয়া কামাল, কবি শামসুল হক, কবি আল মাহমুদ ও কবি নির্মলেন্দু গুন প্রমুখ বরেণ্য কবি সাহিত্যিকদের সমপর্যায়ের এবং সমসাময়িক কালের কবি। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে তাঁর বিচরণ ছিল না। তিনি একই সঙ্গে ছিলেন কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, গীতিকার ও অনুবাদক। তার সৃষ্ট অমূল্য সাহিত্য ভান্ডার আমাদের জন্য এক অনন্য সম্পদ। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এগুলোকে সংগ্রহ, সংরক্ষণ, গবেষণায় কাজে লাগানো এবং তাঁর লেখা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।
কবি দিলওয়ার ১৯৩৭ সালে সিলেট শহরের সুরমা নদীর পাড়ের ভার্থখলা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৌলভি মোহাম্মদ হাসান খান ও মাতা রহিমুন্নেছা খানমের আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। লেখালেখিতে হাতেখড়ি কিশোর বয়সেই। তিনি যখন মাত্র ১২ বছরের কিশোর, তখন সাইফুল্লাহ হে নজরুল নামে তাঁর লেখা প্রথম কবিতা যুগভেরী পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল। এক সময়ের দুরন্ত কিশোর দিলওয়ার জীবদ্দশায় কখনো এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে পারেননি। সিলেট রাজা জি সি হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক ও ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানে লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই প্রবেশ করেন কর্মজীবনে। যোগ দেন দক্ষিণ সুরমা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু মুক্ত জীবনে যিনি অভ্যস্ত, তাঁকে কি আর শৃঙ্খলিত জীবনে বেঁধে রাখা যাবে? মাত্র দুই মাসের মাথায় তিনি শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে যুক্ত হন সাংবাদিকতায়। ১৯৬৭ সালে যোগ দেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। ১৯৬৯ সালে তিনি দৈনিক সংবাদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ফিরে আসেন সিলেটে। এ সময় তিনি সিলেটে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা। তিনি ১৯৭৩ সালে আবার কিছু সময়ের জন্য অধুনালুপ্ত দৈনিক গণকন্ঠেও কাজ করেন। তা ছাড়া দীর্ঘ একটা সময় রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে অনুবাদক হিসেবে কাজ করেন।
আমার কিংবদন্তিতূল্য এই কবির সান্নিধ্য লাভের অসংখ্যবার সৌভাগ্য হয়েছিল। আমার এখনো মনে আছে, ২০০৪ সালে নিউইয়র্ক থেকে আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ফেঞ্চুগঞ্জ নামে একটি সংকলনের জন্য লেখা আনতে শেষবারের মতো তাঁর ভার্থখলার খান মঞ্জিলে গিয়েছিলাম। কবি তখন কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। বিছানা থেকে উঠতে পারছিলেন না। তাঁর ছেলে অকালপ্রয়াত কবি (যিনি নব্বই দশকে কবি হিসেবে বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন) কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারকে ডেকে বলেছিলেন, তাঁর একটি কবিতা আমাদের দেওয়ার জন্য। তিনি একবার আমাদের অনুরোধে আমার উপজেলা ফেঞ্চুগঞ্জকে উৎসর্গ করে ‘ফেঞ্চুগঞ্জে রোদ ওঠে’ শীর্ষক একটি কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি এ রকম—
‘ফেঞ্চুগঞ্জে রোদ ওঠে
কাঞ্চন বর্ণের সেই রোদ আসে দুর, বহু দূর আকাশের অন্তঃপর হতে
ফেঞ্চুগঞ্জে রোদ ওঠে
হাঁসি যেন কপোতীর ঠোঁটে
যে বিহঙ্গী অরণ্যের বাসর
শাখায় রাঙা মুখে
সঙ্গীর সংগীতে শোনে,
রক্তের তরঙ্গ দোলে বুকে।’
দিলওয়ারের লেখা অনেক গান ও ইসলামি সংগীত আজও মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য লেখা গান ‘আয়রে চাষি, মজুর, কুলি, মেথর, কামার–কুমার’, কিংবা ‘জয় জয় দুর্জয় বাংলা’, ইসলামি সংগীত ‘তুমি রহমতের নদিয়া, তুমি রহমতের নদিয়া, আমার মুর্শিদ আছে চাইয়া’ ইত্যাদি। তাঁর লেখা গানের সংখ্যা কয়েক হাজার। তিনি অসংখ্য গল্প লিখেছেন। তাঁর লিখিত জনপ্রিয় গল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘সাদা কালো বিড়াল’ এবং ‘ইলিশ মাছের কাঁটা’। তাঁর লিখিত মঞ্চ নাটকের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে ‘আসল মুক্তিযুদ্ধ এবং রুধিরাক্ত কাল’। বিদেশি ভাষায় রচিত বহু গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও গদ্য বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন তিনি। তিনি অনুবাদ করেছেন মার্কিন কবি নরমান, কোরীয় লেখক মোগউ, জার্মান কবি কাল ক্রালাউ, রুশ কবি আইওন, ইতালিয়ান কথা সাহিত্যিক মোরাকিয়ানসহ অগণিত বিখ্যাত লেখকের বই।
জীবদ্দশায়ে কবি দিলওয়ার পাঁচ হাজারের মতো প্রবন্ধ, গদ্য ও কলাম লিখেছেন। এ গুলো প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সংবাদপত্রে। এসব লেখায় দেশ, জাতি, সমাজ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল নিয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তা–চেতনা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি দেশের নির্যাতিত–নিপীড়িত গণমানুষের দুঃখ–দুর্দশার কথাও তিনি বলেছেন। তাঁর সাহিত্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, আমি অদৃষ্টের আত্মজ্ঞানলব্ধ ব্যাখ্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমি বিশ্বাস করতে শিখেছি, অদৃষ্ট কয়েকটি উপাদান দিয়ে তৈরি আলো, বায়ু ও জলের মতো জীবন ধারণে অপরিহার্য বাস্তবতাই অদৃষ্টের উপাদান। তাই আমাকে এদের তত্ত্বাবধান করতে হবে। ‘আমার মৃত্যুর পর’ শীর্ষক লেখা কবিতায় কবি দিলওয়ার বলেছেন—
‘আমার মৃত্যুর পরে যদি তুমি
কখনো খুঁজতে যাও এই মর্মভূমি
মনে রেখো তবে
বাংলার হৃদয় নিয়ে কেটেছে
আমার দিন
প্রতীচ্যের মুক্তির গৌরবে।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও দ্বন্দ্ব–সংঘাতের বিরুদ্ধে কবি দিলওয়ার কলম ধরেছিলেন এভাবে—‘বাংলাদেশে কিছু মানুষের মধ্যে যে হারে অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সা বৃদ্ধি পেয়েছে, তা প্রতিহত করতে না পারলে মানবজাতির জন্য ভয়ানক অকল্যাণ অবধারিত।’ তিনি সামাজিক ভণ্ডামির বিরুদ্ধে মুখোশ উন্মোচন করেছেন এভাবেই—‘অন্যের পাপ সন্ধান ও পাপাচার নিয়ে ওয়াজ–নসিহত করো অথচ তুমি নিজে যে পাপে ডুবে আছ সেই কৈফিয়ত কে দেবে?’
দিলওয়ার মনে করতেন, শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা উপমহাদেশ আজ বিদীর্ণ হচ্ছে এক ধর্মীয় স্নায়ুযুদ্ধে। কবি দিলওয়ারের এ পর্যন্ত বহু বই প্রকাশিত হয়েছে, এর মধ্য উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাব্যগ্রন্থ— ‘জিজ্ঞাসা’, ‘ঐকতান’, ‘উদ্বিগ্ন উদ্ভাস’, ‘রক্তে আমার অনাদি অহি’, ‘স্বনিষ্ঠ সনেট’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘দিলওয়ারের শত ছড়া’, ‘দিলওয়ারের একুশের কবিতা’, ‘দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘ফেসিং দ্য মিউজিক’। গানের বই—‘পূবাল হাওয়া’, ‘বাংলা তোমার আমার’ এবং প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ জন্ম না নিলে’ ইত্যাদি।
দিলওয়ারের আরও অনেক বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। মহান এই মানুষটির সৃষ্টিকর্মের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর অপ্রকাশিত প্রতিটি লেখা প্রকাশে সরকার ও বাংলা একাডেমি অচিরেই উদ্যোগ নেবে এমনটি কবির লাখ লাখ ভক্ত, অনুরাগী ও পাঠক মনে করে। জীবদ্দশায় এই কবি একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ বহু সম্মান ও উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. রাজিব হুমায়ুন কবি দিলওয়ার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, কবি দিলওয়ারের পড়াশোনার পরিধি ছিল ব্যাপক। তিনি ছিলেন একজন আধুনিক ও সমাজ সচেতন মানুষ। তাঁর অকৃত্রিম দেশপ্রেম ও কমিটমেন্ট তাঁকে বিশিষ্টতা দান করেছে। বিশিষ্ট দিলওয়ার গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. সেলু বাসিতের মতে, বাংলা সাহিত্যে তিনি ছিলেন এক রত্ন। তাঁর চিন্তা–চেতনা আজও সমাজ ও জাতিকে আলো দেখায়। কবিকে নিয়ে গবেষণা ও তাঁর সৃষ্টি প্রতিটি শব্দাবলির মূল্যায়ন আবশ্যক। সাম্রাজ্যবাদের পোষ্য অপশক্তি ও ধর্মবাজদের বিরুদ্ধে দিলওয়ার আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। তিনি যে পথ দেখিয়েছেন, তা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারলে জাতি অনেক উপকৃত হতো।
কবির নিউইয়র্কপ্রবাসী ছেলে কবি ও সংগঠক শাহিন ইবনে দিলওয়ার তাঁর বাবা সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, আমি তাঁকে দেখি বিশ্ব মানবতার সোচ্চার একজন প্রতিনিধি হিসেবে। যেখানেই গণমানুষ নির্যাতিত, সেখানেই তাঁর কলমের সরব উপস্থিতি। আমি বিশ্বাস করি, বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থান চিরস্থায়ী হয়েছে সৃষ্টিশীলতায় ও স্বাতন্ত্র্যে।
২০১৩ সালের ২০ অক্টোবর বার্ধক্যজনিত কারণে ইহকাল ত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই প্রধান কবি। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি হলো। বাংলা সাহিত্যে পতন হলো এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের। বাংলা সাহিত্যের এই কলজয়ী মহাপুরুষ কোটি মানুষের ভালোবাসার বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে অনন্তকাল।