মন্ত্রীর সঙ্গে মোলাকাত

বাংলাদেশি পত্রিকা খুলতেই দেখি বাংলাদেশ সরকারের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী মন্ত্রী আবদুল মান্নান (পরিকল্পনামন্ত্রী) নিউইয়র্কে আসছেন। দূর থেকে যতটা জেনেছি, তাতে আমি নিজেও তাঁকে পছন্দ করি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। সুনামগঞ্জ শহর নদী ভাঙন থেকে রক্ষায় জরুরিভিত্তিতে মাস্টার প্ল্যান নেওয়ার জন্য তাঁর মনযোগ আকর্ষণ করতে হবে। এলাকার মন্ত্রী হিসেবে তিনিই এখন একমাত্র ভরসা।
মাঝে শহরের কাছে সুরমা নদীর ভয়াবহ ভাঙন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মতিউর ভাইয়ের ফেসবুকে স্ট্যাটাস আমাকে খুব বিচলিত করে। কিছুদিন পর পর সেটা তিনি বিভিন্নভাবে উত্থাপন করেন। তেমন কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না অথবা জানা যায়নি। ধরে নেওয়া যায়, ভাঙন এভাবে অব্যাহত থাকলে কিছুদিন পর সুরমা নদী শহরটির কিছু অংশ গিলে ফেলবে। শহরবাসী অসহায়ভাবে অবলোকন করা ছাড়া বিকল্প কিছু করার থাকবে না।
নিউইয়র্ক শহরে দীর্ঘদিন থেকে বসবাস। কোনো রাজনৈতিক দল বা আঞ্চলিক সংগঠনের সঙ্গে জড়াইনি। স্বাভাবিকভাবেই এদের কারও সঙ্গে কোনো ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি। তাই কী করা যায় ভাবছিলাম।
প্রথমে বাংলাদেশি কমিউনিটির পরিচিত মুখ সউদ ভাইকে কল দিলাম। মন্ত্রীর বাড়ির কাছাকাছি সউদ চৌধুরীর বাড়ি। সুনামগঞ্জ শহরে তাঁর বেড়ে ওঠা। টেলিফোনে পাওয়া গেল না। ম্যাসেজে চলে গেল।
মন্ত্রী মহোদয় আগামীকাল আঞ্চলিক সংগঠন সুনামগঞ্জ সমিতির পিকনিকে আসবেন। সুনামগঞ্জের কয়েকটি সমিতি আছে। কোনোটার সঙ্গেই আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। অবশ্য মারুফ চৌধুরীর নেতৃত্বে যে অংশটি রয়েছে, বাল্যকাল থেকেই চেনাজানা থাকায় তাদের প্রোগ্রামে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে যেতে হয়।
শাহি ভাইকে কল দিলাম। তিনি একটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও উপদেষ্টা। আশ্বাস দিলেন, ‘চিন্তা করো না, মন্ত্রীর সঙ্গে তোমার কথা বলিয়ে দেব। তুমি শুধু বিষয়টি লিখে নিয়ে আসবে, পিকনিকেও তোমাদের অনেক সম্মানিত করা হবে, এমনকি খাবারও লাইন দিয়ে আনতে হবে না, স্টেজে মন্ত্রীর সঙ্গে বসে থাকবে।’ মনে মনে ভাবলাম, খাবার লাইন না দিয়ে আনলে সেখানে পিকনিকের মজা থাকে না।
হাতে একদম সময় নেই। বিকেলে আমার পূর্বনির্ধারিত একটা প্রোগ্রাম আছে। সেখানে যেতেই হবে। শহীদ ভাইকে কল দিয়ে আইডিয়াটা জানালাম। প্ল্যান অনুযায়ী ড্রাফট লিখতে অনুরোধ করলাম। শহীদ ভাই রাত দশটায় ফ্রি হলে আবার কল দিলেন। ইসতিয়াক আহমেদ রুপুর কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, মন্ত্রী মহোদয় বিকেল চারটায় সুনামগঞ্জ সমিতির অনুষ্ঠানে পৌঁছাবেন। দুপুরে আরেকটি প্রোগ্রাম আছে। অতএব আমরাও চারটায় যাব।
পরদিন সাড়ে ১২টায় শহীদ ভাইয়ের কল, টেক্সট মেসেজ পেয়েছি কি-না? বললাম, না দেখিনি। চেক করে দেখি, মন্ত্রী মহোদয়ের প্রশংসা এবং বন্যার হাত থেকে সুনামগঞ্জ শহরকে রক্ষা করার কথা শুধু লিখেছেন। আমার আসল প্ল্যানটিই লিখতে ভুলে গেছেন।
ড্রাফটটি কারেকশন করে যোগ করলাম, ‘সুনামগঞ্জ শহরের উত্তর পাশে সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে পুরোনো আনসার ক্যাম্প থেকে আবদুর জোহর সেতু পর্যন্ত ৪/৫ মাইলের একটা রাস্তা নির্মাণ করতে হবে। এই রাস্তাটি বাঁধ হিসেবে কাজ করবে। শহরটিও আধুনিক নগরে রূপান্তরিত হবে। বিশ্বের বড় বড় শহরগুলো এভাবেই রক্ষা হয়ে থাকে।’
প্রথমে শাহি ভাইয়ের নাম, পরে ক্রমান্বয়ে শহীদ ভাই, আমার, ইসতিয়াক আহমেদ রুপু, সাব্রী সাবেরীন ও মাসুদের নাম আবেদনে লিখলাম। আত্মবিশ্বাস নিয়ে আবেদনটি প্রস্তুত করি। আমার প্রিন্টারের কালি নেই। কি করা যায়? পিডিএফ ফাইল ছাড়া স্টেপল থেকে বাংলা প্রিন্ট করা যাবে না। হাতে সময় মাত্র এক ঘণ্টা। মেয়ের শরণাপন্ন হলাম। ইউনিভার্সিটি কিছুদিন বন্ধ থাকায় এখন সে বাসায়। অল্প সময়ের মধ্যে আবেদনটি রেডি করে আমার ই–মেইলে দিয়ে দিল। বাসা থেকে ৪/৫ ব্লক দূরে স্টেপলস। রোববার ৬টা পর্যন্ত খোলা।
শহীদ ভাইয়ের কল, ‘গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল হাইওয়ে থেকে এক্সিট নিচ্ছি।’ বললাম সবকিছু রেডি। আমার বাসার কাছে স্টেপলসে চলে আসেন। প্রিন্ট করে চলে যাব।
ছেলে তাঁকে নামিয়ে দিয়ে গেল।
‘আপনি একা? রুপু আসেনি?’ শহীদ ভাইকে প্রশ্ন করলাম।
ওর শরীর ভালো নেই, আসতে পারেনি।
আমরা হাঁটতে লাগলাম অ্যাস্টোরিয়া পার্কের দিকে। মন্ত্রী মহোদয় নিশ্চয় ইতিমধ্যে এসে গেছেন। চারটা প্রায় বাজে। শাহী ভাইকে কল দিলাম।
‘তোমরা কোথায়, এত দেরি করলে কেন? মন্ত্রী তো চলে গেছেন। পিকনিক স্পটে একটার দিকে এসেছিলেন। আমিও চলে যাচ্ছি’—শাহী ভাই বিরতিহীনভাবে বলতে লাগলেন।
মুহূর্তে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা করুন। আপনার কাছেই আবেদনটি দিয়ে দিই। মন্ত্রীর হাতে পৌঁছিয়ে দিয়েন। কিন্তু শাহী ভাই খুব ব্যস্ত। বিকেলে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকে যেতেই হবে।
কী আর করা! শহীদ ভাইকে বললাম, চলেন অ্যাস্টোরিয়া পার্কে যাই। এই দুই দিনের চেষ্টা কি বৃথা যাবে?
তখন সাড়ে চারটা বাজে। পিকনিক প্রায় শেষের পথে। আমাদের খেতে বললে শুধু কোল্ড ড্রিংকস নিলাম। সেই মুহূর্তে সমিতির একজন অত্যন্ত পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তিত্ব বলে বসলেন, ‘অ্যাপ্লিকেশনে আমার নাম নেই কেন?’ বললাম, ‘আপনার নাম কি করে থাকবে? সুনামগঞ্জ শহরবাসীর পক্ষ থেকে আমাদের এই আবেদন। আপনারা ইচ্ছা করলে আরও চমৎকারভাবে দাবি জানাতে পারেন। মন্ত্রী তো আপনাদের পিকনিকে এসে চলেও গেলেন। কিছু কি বলেছেন?’ তিনি নিরুত্তর।
কয়েকজনের কাছে সংবাদ পেলাম, মন্ত্রী সন্ধ্যা সাতটায় জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। পার্কে কিছু সময় কাটিয়ে শহীদ ভাইকে নিয়ে বাসায় আসলাম। কিছু সময় গল্প করে সাতটার মধ্যে উডসাইডে চলে যাব। যখন পৌঁছলাম তখনো মন্ত্রী আসেননি। জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছেন। ততক্ষণে নামাজের সময় হয়ে গেছে। মন্ত্রী নিশ্চয় নামাজের পরে আসবেন। আমি ও শহীদ ভাই অন্যদের সঙ্গে পাশেই একটা মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়তে গেলাম। উডসাইডে এত বড় মসজিদ! চিন্তাও করিনি। নামাজের পর অনুষ্ঠানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি কখন মন্ত্রী আসেন। আসার কোনো লক্ষণ নেই। আবার অপেক্ষা। আটটায় তিনি আসলেন সদলবলে। সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এর আগে জালালাবাদ সমিতির সভাপতিকে বলে রেখেছিলাম, মন্ত্রীকে আমরা একটা অ্যাপ্লিকেশন দেব। সেই সুযোগ যেন আমাদের দেন।
মন্ত্রী আসার পর মঞ্চে ওঠার জন্য যে প্রতিযোগিতা শুরু হলো, তা দেখে রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলাম। মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলার দুর্লভ সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতে চাচ্ছেন না। মন্ত্রীকে সামনে রেখেই একসময় চরম হুলুস্থুল কাণ্ড শুরু হলো। সাবেক কর্মকর্তারা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে হল ফাটিয়ে বলতে লাগলেন, তাদের কেন আগে ডাকা হচ্ছে না। যদিও সমিতির সব সাবেক কর্মকর্তাকে সংবর্ধনা দিতেই এই আয়োজন। বাংলাদেশি স্টাইলে আমেরিকার মাটিতে এমন পরিস্থিতি দেখে হতভম্ব হয়ে যাই। যেহেতু এর আগে এ রকম কোনো অনুষ্ঠানে আমার আসা হয়নি, তাই মেনে নিতে পারছিলাম না। সুদূর প্রবাসে স্বদেশিদের একি আচরণ!
শহীদ ভাইকে বললাম, চলেন ফিরে যাই। এই অবস্থায় মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্ভব হবে না। তিনি বললেন, ‘এভাবেই মঞ্চে গিয়ে অ্যাপ্লিকেশন মন্ত্রীর হাতে দিয়ে আসতে হবে।’ সমিতির সহসভাপতি (সুনামগঞ্জ) মোশাররফ ভাই সেই পরামর্শ দিয়েছেন। কাউকে তোয়াক্কা না করে আমি আর শহীদ ভাই সোজা মঞ্চে গিয়ে একেবারে নির্লজ্জের মতো মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে চলে গেলাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মন্ত্রীকে অ্যাপ্লিকেশনের বিষয়বস্তু বললাম। উনি শুধু বললেন, ‘ইয়েস, ইয়েস, আমি অবশ্যই এটা করব।’
আমার মনে হল, মন্ত্রী মহোদয় আমাদের সান্ত্বনা দিতে তাৎক্ষণিকভাবেই এই পন্থা অবলম্বন করেছেন। নিশ্চয় পরে আবেদন পড়ে দেখবেন। এই ভয়ানক কোলাহলের মাঝে সুষ্ঠু কিছু আলোচনা বা আশ্বাস দেওয়া অসম্ভব। অবশ্য আগে শাহি ভাই বলেছিলেন, মন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে কথা বলেছেন।
অনেকে মনে করছিল, আমরা মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুলতে মঞ্চে গেছি। আমারও খুব অস্বস্তি ও লজ্জা লাগছিল। তাড়াতাড়ি নেমে পড়লাম। তখন দেখি অ্যাপ্লিকেশন ছাড়া এনভেলপটা আমার হাতেই রয়ে গেছে। মুহূর্তে সংকল্প করলাম, মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে আবার কথা বলব। তাই মন্ত্রী যখন মঞ্চ থেকে নেমে চলে যাচ্ছেন, দৌড়ে গিয়ে ওনার হাতে খালি এনভেলপটা দিতে চাইলে তিনি বললেন, অ্যাপ্লিকেশন আছে, এনভেলাপ লাগবে না। আমি এই সুযোগে আবার তাকে সুরমার ভাঙনের হাত থেকে সুনামগঞ্জ শহরকে রক্ষা করতে কয়েকবার বিনীত অনুরোধ জানালাম। মন্ত্রী আবারও আমাকে আশ্বাস দিলেন। এভাবে অপরিচিত কাউকে হয়তো সহজেই কিছু বলে বিদায় করা যায়। মনে মনে তাই ভাবছিলাম।
মন্ত্রী মহোদয়ের নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফির কি আদৌ এই আশ্বাস মনে ছিল অথবা নিউইয়র্কেই হোটেলের কোনো লবিতে বাতাসে উড়তে উড়তে হারিয়ে গেছে আবেদনটি? কোনো দিন হয়তো আর জানার সুযোগ হবে না। তবুও সান্ত্বনা, দূরদেশে থেকে নিজের শহরকে রক্ষা করতে একটু বৃথা চেষ্টা করেছিলাম।