নারীর অগ্রগতির অন্তরায়...

নারী-পুরুষের সমগোত্রীয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নির্ণয়ে জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার (১৮৫১) বলেন, ‘the feeling between male strangers or acquaintances was ‘mere indifference’; for women it was ‘actual enmity’। নারীর প্রতি নারীর অসহিষ্ণু মনোভাব জার্মান দার্শনিকের চোখ এড়ায়নি।
আমাদের আলোচনার বিষয়, নারীর অগ্রগতিতে নারী-পুরুষ উভয়েই কেন বড় বাধা? তবে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে, আসুন দেখা যাক আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবস্থান কি?
পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অবদান অস্বীকার করা যায় না। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ বছরে ২৪ লাখ ৫১ হাজার ৯৩ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৭৪ হাজার ২১৩ জন নারী কর্মী। বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১০–এর তথ্য মতে, দেশে মোট ৫ দশমিক ৪১ কোটি শ্রমিক বিভিন্ন পেশায় কর্মরত রয়েছেন; এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ১ কোটি ৬২ লাখ। এ ছাড়া সরকারিভাবে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। নারীরা যে গৃহস্থালি কর্মকাণ্ড করেন, তার অর্থমূল্য আনুমানিক আড়াই লাখ কোটি টাকা। সে হিসেবে জিডিপিতে নারীর অবদান দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। ফলে দেশের অর্থনীতিতে নারীদের গুরুত্ব যে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নারীর এই সাফল্য সত্ত্বেও বহু বছরের পুরোনো পারিবারিক রীতি ও কিছু সামাজিক কুসংস্কারের কারণে বিভিন্নভাবে নারী বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। কখনো পারিবারিকভাবে, কখনো সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে, কখনো পুরুষের মাধ্যমে, আবার কখনো অন্য নারীর মাধ্যমে। এটা কেবল আমাদের দেশে নয়, বিদেশেও নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
নারীর উত্তরণে নারী এবং পুরুষ উভয়ই কেন অনেক ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ান—এই তথ্যের ওপর ছোট্ট একটি জরিপ চালিয়েছি আমি, যাতে কাব্য ও কবিতা ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজের প্রায়ই ২৬ জন নবীন লেখক/লেখিকা অংশ নিয়েছেন। সেই জরিপের তথ্যমতে, ২৬ জনই বলেছেন, নারীর উত্তরণে নারীর সহিংসতা বা বিরূপ মনোভাবের কারণ হলো—নারী জন্মগতভাবেই ঈর্ষার মনোভাব নিয়ে জন্মায় এবং তারা অন্য নারীর সাফল্য কামনা করতে ব্যর্থ হোন। তারা বলেন, নারীর উত্তরণে পুরুষের সহিংসতা বা বিরূপ মনোভাবের কারণ—পুরুষ শোষণ করতে পছন্দ করেন এবং নারীর উত্তরণে পুরুষ স্বভাবসুলভ কারণেই নিজেকে নারীর কাছে দুর্বল ভাবেন।
প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব। জীবনের কোন না কোন সময়, কিছু সময়ের জন্য আপনি কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়বেন না, এটা অসম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি, যেখানে এখনো সমাজ একজন পুরুষকে যতটা স্বাধীনতা দেয় তার মনের ভাব, ইচ্ছা বা রাগ-ঘৃণা প্রকাশ করার, একজন নারীকে সে স্বাধীনতা দেয় না। সে ক্ষেত্রে একজন নারী হিসেবে আমরা কি করি? নিজের মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতা বা উত্তেজনা সবকিছু ঝেড়ে ফেলতে চাই অন্যের ওপর। আমরা শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রতিযোগিতামূলক অনুভূতি মোকাবিলায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হই।
দেশের সমষ্টিগত সমস্যা নিয়ে আলোচনায় যাব না। বহু বছর দেশের বাইরে এবং যেটা আমার কাছে প্রকট দৃশ্যমান, আমি সেটি নিয়েই আলোচনা করব। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিদেশেও এই সমস্যাটা ব্যাপক। নিজের ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ না করলেই নয়।
একদিন আমি জ্যাকসন হাইটসের সেভেন্টি থ্রি স্ট্রিট ও থার্টি সেভেন অ্যাভিনিউয়ে স্মৃতি ফ্যাশনে গেলাম লেইস কেনার জন্য। দোকানের একজন সেলস গার্ল বলল, তাদের কাছে লেইস নেই। তারপরও আমি এদিক-ওদিক উঁকি দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আরেকজন সেলস গার্ল এসে জানাল, তাদের দোকানের নিচে বেসম্যান্টে লেইস পাওয়া যায়। আমি গেলাম বেসম্যান্টে। একজন মধ্য বয়স্কা ভারতীয় নারী, (নাম প্রকাশ করলাম না) সরু একটি বেসম্যান্টে কাপড় ও লেইসের ব্যবসা করছেন। ভদ্র মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, শুরুতে আমাকে ওপর থেকে লেইস পাওয়া যাবে না বলল কেন? চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে জবাবে তিনি যা জানালেন, তা নাই বা বললাম! তবে তিনিও যে কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ের বৈষম্য ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে চিরাচরিত ঈর্ষার শিকার, তা আমার বুঝতে অসুবিধা হল না।
আমরা অনেকেই দেশ ছেড়ে বাইরে থাকি। কেউ খুব ছোটকাল থেকে, কেউ পরিণত বয়সে পাড়ি জমিয়েছি। এখানেও পুরুষের পাশাপাশি বাঙালি নারীরা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছেন। তারা ব্যবসা করছেন, চাকরি করছেন, বিভিন্ন সাহিত্য সমিতি ও সংগঠন চালাচ্ছেন। কিন্তু সবক্ষেত্রেই নারীকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে যথেষ্ট হিমশিম খেতে হয়। একজন নারী যখন ভালো কোন চাকরির খোঁজে স্বদেশি কারও সাহায্য চান, অনেকেই জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও কোন তথ্য দেন না। পড়াশোনার বিষয়ে ভালো কোন উপদেশ বা তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন না। এমনকি সাহিত্যমনা অনেকেই মাইকে এসে কবিতার সুরে খুব নীতিবাক্য আওড়ালেও একটি সাহিত্য সংগঠনকে এগিয়ে নিতে মানসিক বা আর্থিক কোন সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন না। যখন একটি বাঙালি পত্রিকা বা ম্যাগাজিন নিয়ে কোন নারী বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেন, নারীর অধিকার আদায়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন, তখন সেখানেও চলে ঘরোয়া রাজনীতি। এক সংগঠনের প্রধান চান না, অন্য সংগঠন এগিয়ে যাক। এক ব্যবসায়ী চান না অন্য কেউ ব্যবসায় উন্নতি করুক। একজন প্রতিষ্ঠিত কেউ চান না, অন্যজন তার সমকক্ষ হোক।
এই যে আমাদের নিজেদের মধ্যেই এই শ্রেণি বৈষম্য, এমন প্রতিযোগিতামূলক হিংসাত্মক মনোভাব, এর কারণ কি? কারণ একটাই—প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব মানুষের প্রকৃতিগত স্বভাব। তবে এর সঙ্গে, বিশেষজ্ঞরা আরও উপকরণ যোগ করেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুরুষের তুলনায় একজন নারীর আর্থিক সক্ষমতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, গুন বা পেশাদারি সাফল্য, পারিবারিক ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা যখন বেশি হয়, তখন পুরুষ নিরাপত্তাহীনতা ও হীনমন্যতায় ভোগেন। আর এর থেকেই জন্ম নেয় নারীর প্রতি সহিংসতা, যা নারীর উত্তরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
আর নারীর বেলায় উপরিউক্ত কারণগুলো বর্তালেও আরও কিছু অদ্ভুত কারণ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যেমন—নিজের থেকে অন্য নারীর দৈহিক গঠন ও সৌন্দর্য বেশি হলে, মেধা ও জনপ্রিয়তা বেশি হলে...ইত্যাদি কারণেই এক নারীর কাছে অন্য নারী হয়ে ওঠেন হিংসার পাত্রী। তবে শুরুতেই যা বলেছি—নিজের অক্ষমতা, ব্যর্থতা, প্রতারণা–বঞ্চনা ও নির্যাতনের কথা প্রকাশ করতে না পারাটাই এক সময় নারীর মনে ক্ষোভ-ঘৃণা ও হিংসার জন্ম দেয় এবং তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে অন্য নারীর ওপর। একজন বঞ্চিত ও ব্যর্থ নারীর নৈতিক চিন্তাশক্তি শক্ত হলে অবশ্যই তিনি নিজের ব্যর্থতার জন্য অন্য নারীকে দায়ী করবেন না এবং অন্য নারীর প্রতি সহনশীল ও উদার হবেন।
কিন্তু যদি তার পারিবারিক ভিত্তি, পারিপার্শ্বিক প্রভাব এবং নৈতিক আদর্শ সমষ্টিগতভাবে একতাবদ্ধ হয়ে তার চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত না করে, তাহলে তার আচরণে অন্যের প্রতি কখনোই ‘Empathy’ আসবে না; বরং তার মাঝে ‘Antipathy’ আচরণ প্রকট হবে।
প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে পুরুষের প্রতি নারীর সে আচরণ পরিলক্ষিত হয় না কেন? কেন শুধুই নারীর ওপর? কারণ, পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষ ক্ষমতাধর, নারী এক প্রকার মেনেই নিয়েছে যে, পুরুষের সঙ্গে পারা যাবে না। সে ক্ষেত্রে নারী সহনশীল, দুর্বল। নারীকে হেয় করে পার পাওয়া সহজ।
নারী সম্পর্কে আমেরিকার একজন বিখ্যাত লেখক হেনরি মিলার বলেন, ‘There are only three things to be done with a woman. You can love her, suffer for her or turn her into literature.’
নারীকে দিয়ে সত্যিই অনেক কিছু হয়। নারী যেমন মমতাময়ী, আবার নারীও হতে পারেন বিষাদের কারণ! আরও অস্বস্তির ব্যাপার হলো, সেই নারীই কিন্তু হচ্ছেন ভুক্তভোগী! বিষয়টা অনেকটা ত্রি-জ্যামিতিক অঙ্ক।
জীবনের কোন না কোন ক্ষেত্রে অন্যের প্রতি প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হওয়া কিংবা হিংসাত্মক হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সেটা আমারও হতে পারে, আপনারও হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, জীবনের নিত্য–নৈমিত্তিক বিষয়গুলো যেন বিষফোড়া হয়ে দেখা না দেয়। সহনশীলতা ও সমঝোতার মাধ্যমে সাময়িক উৎকণ্ঠা সহজেই কাটানো সম্ভব। আসুন, একে অপরের প্রতি সহিষ্ণু হই, মানবিক হই।