আমেরিকায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী

‘একটি চন্দ্রই অন্ধকার দূর করে, সকল তারা মিলেও তা পারে না’—চাণক্য শ্লোক। আর এ কারণেই শিক্ষার ওপর সব দেশ সব কালে এত গুরুত্ব দিয়ে এসেছে। জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনে যাওয়ার কথাও বলা হয়েছে। যে সময়ে এ উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, সেই সময়ে চীন ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে। আজকের দিনে এমনটি বলতে হলে চীনের বদলে আমেরিকার কথাই আসবে বরং।
আজকের পৃথিবীতে আমেরিকা জ্ঞান-বিজ্ঞানে তর্কাতীতভাবে অন্য দেশগুলো থেকে এগিয়ে। তাই আক্ষরিকভাবে তেমন কোনো নির্দেশনা না থাকলেও জ্ঞানপিপাসুরা ঠিকই ভিড় জমাচ্ছে আমেরিকায়। এই দলে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে অবশ্য চীনই। বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ডেটা ওপেন ডোর নামের একটি সংস্থার গবেষণা বলছে, ২০১৭-১৮ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০ লাখ ৯৪ হাজার ৭৯২ শিক্ষার্থী আমেরিকায় পড়াশোনা করতে এসেছে। এ সংখ্যা আগের বছর থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে চীনের শিক্ষার্থীরা। মোট আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর প্রায় ৩৩ দশমিক ২ শতাংশই চীনের। এর পরেই রয়েছে যথাক্রমে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব ও কানাডা। বাংলাদেশ রয়েছে ২৪তম স্থানে। সংখ্যার হিসাবে আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বর্তমানে ৭ হাজার ৪৯৬ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। আগের বছরের তুলনায় এ সংখ্যা প্রায় ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।
আমেরিকায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি ভীষণভাবে আশাবাদী করে। দুটি কারণে। প্রথমত, মার্কিন সরকার বর্তমানে যে কঠোর অভিবাসন নীতি অনুসরণ করছে, তা শিক্ষার্থী ভিসার ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হচ্ছে। ফলে এই সময়ে আমেরিকায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিচায়ক। দ্বিতীয়ত, দেশে উচ্চশিক্ষার হাল খারাপ—এ কথা দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মাস্টার্স, পিএইচডি পর্যায়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের সুযোগ পাওয়াটা আশার আলো দেখায়। বলে দেয় যে, এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। সঠিক পদক্ষেপ নিলে এখনো বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব।
এই একই সুসংবাদ বাংলাদেশকে আরেকটি দুঃসংবাদও দেয়। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে আমেরিকায় পড়তে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৩ শতাংশ ৫ শতাংশ বেড়েছে। এ তথ্য আমাদের একই সঙ্গে আশাবাদী ও শঙ্কিত করে। কারণ, এই যে শিক্ষার্থীরা যাচ্ছেন, তাদের কত জন ফিরে আসছেন। কতজন দেশে ফিরে তাঁদের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে পারছেন? উত্তর হচ্ছে, খুবই কম। আর এই উত্তরই শঙ্কার কারণ। কারণ, এর মাধ্যমে দেশ পরোক্ষে তো মেধা হারাচ্ছে, যা সে কাজে লাগাতে পারত, যা দিয়ে সে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারত।
এটা সত্য যে, জ্ঞানীর কোনো দেশ নেই। একজন জ্ঞানীর জন্য সারা বিশ্বই তার দেশ। এ কথা যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য যে, এই জ্ঞানের ফল জন্মমাটিরও প্রাপ্য। কিন্তু নানা বাস্তবতার কারণে এই ফলটি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাজনীতি, মেধাকে অবজ্ঞা করার সংস্কৃতি এ বাস্তবতার নির্মাণ করছে। এ বিষয়ে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি। না হলে, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে। এ ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষায় নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থীদেরও সচেতন হবে। হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এই দেশকে গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁদের অগ্রণী হতে হবে। সংকট আসবে, কিন্তু তা মোকাবিলা করেই এটি করতে হবে। হাজার হোক এ তো জন্মভূমি।