নীলবাসর

আগস্ট মাস, এ মাসটি মৌমিতার কাছে একটা বিশেষ মাস!

আজ ২৬ আগস্ট। আকাশে জোছনার রাত, সুন্দর মিষ্টি হাওয়া, তার সঙ্গে অল্প ঠান্ডা একা একা বসে আছি চেয়ারে, আর আপন মনে ভাবছি, আজই তো আমাদের বিবাহবার্ষিকী। সত্যিই তো, ১৯ বছর আগে ঠিক এই দিনটিতেই আমাদের বিয়ে হয়েছিল। সেদিন বউ সেজে নিজের মধ্যে সংশয় আর স্বপ্ন নিয়ে দুরুদুরু বুকে কত ধরনের জল্পনা আর কল্পনার আলপনা এঁকেছি এই মনটার মধ্যে। কিন্তু আজ এতটা বছর গড়িয়ে গেছে, এখনো তার বাস্তবরূপ দিতে পারিনি। এখন আর আগের মত কষ্ট পাই না, সব যেন সয়ে গেছে।

বিয়ের রাতেই বুঝে গিয়েছিলাম, আমি একটি ব্যতিক্রম ধর্মী মানুষ জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। জ্ঞান থেকে এবং নিজেদের বন্ধু–বান্ধবদের কাছ থেকে যতটুকু জেনেছিলাম, বিয়ের রাতের গল্পের কোন কিছুই যেন সেদিন মেলেনি আফজালের সঙ্গে। অতৃপ্ত আত্মা যেন আজও অধীর আগ্রহে থাকে, কখন কবে সেই স্বপনের রাজকুমার আফজাল তার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, আমি তোমার জন্য, তোমার মত করেই ভালোবাসবো। এই বিশেষ দিনে কাছে এসে বলার মত আমার আজ কেউ নেই—মৌমিতা, শুভ বিবাহবার্ষিকী। কত রোমান্টিক হয়ে মৌমিতা কথাগুলো মনে মনে ভাবছিল এই বিবাহবার্ষিকীর দিনে।

জেনেছি জন্ম মৃত্যু, বিয়ে—তিনটিই বিধাতার ইচ্ছায় হয়। তাই অভিমান হলেও অভিযোগ কোনো দিনই ছিল না। ভেবেছিলাম, একদিন আমি পারব তাকে আমার মনের মত করে তুলতে। সেদিনই এটা ছিল আমার ভুল ভাবনা। তাইতো আজ আকাশের সব তারার মধ্যে একটি শুকতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে জ্বলতে পারিনি। শুকতারার মত বারবার ঝরে পড়েছি। তবুও হাল ছাড়িনি আজও। মনের মাধুরী দিয়ে করেছি প্রতিদিন রচনা। বাস্তবতার কষানলে ছুটে চলেছি বেঁচে থাকার পথ খুঁজে বের করতে। বেলায়–অবেলায় যে চলে গেছে আমার পথ অনেক দুরে বহুদিকে। জীবন তো জীবনের নিয়মে বয়ে চলে, তাই না। তেমনি আমার সময় যাচ্ছে চলে জীবনের নিয়মে। কথাগুলো মৌমিতা আপন মনে ভেবেছিল।

আজ থেকে ১৯ বছর আগে এই দিনে মৌমিতা আর আফজালের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানের সব পর্ব শেষে বসেছিল মৌমিতা হ্রদয়ের কাঁপুনি নিয়ে আফজালের অপেক্ষায় তাদের বাসর ঘরে। বাইরে অন্যরা কত কী ইয়ার্কি করছিল ওদের নিয়ে। তার কিছুই আফজালের মধ্য খুঁজে পেল না। আফজাল ছিল বড় শান্ত। ধীর রাগান্বিত কণ্ঠে বলতে লাগল, এ দেশের মানুষগুলো বড় জংলি। ওরা অযথা সময় নষ্ট করে এটা–ওটা বলে। আফজাল শেরওয়ানি খুলছিল আর বলছিল কথাগুলো। এ দেশের লোকেরা সস্তা সেন্টিমেন্ট আর সময় নষ্ট করা ছাড়া কিছুই বুঝে না। আমি এ দেশে এসে এদের সঙ্গে মিশে যেতে পারি না।

মৌমিতা কথার কিছুই বুঝতে পারছিল না। ওরা দুজন দুজনের জন্য আজ নতুন। যেন অনেক দিনের পুরোনো। বাসর রাত সম্পর্কে বন্ধু–বান্ধবের কাছে মৌমিতা অনেক গল্প শুনেছে। অনেক মধুর রাত। কিন্তু আফজাল তাহলে কেন এমন! সে যেন বিয়ের আনন্দকে উপভোগ করছিল না। সবকিছুতে বিরক্তি। মৌমিতার পরিবার থেকে আফজালকে উপহার দিয়েছিল দামি ঘড়ি। তার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুমিয়ে পরো, রাত অনেক হয়েছে। মনে মনে ভেবেছিল, এ কোন জায়গায় সে বাসর সাজিয়েছে। বাইরে মানুষের হইচই আনন্দ এখনো শেষ হয়নি। আফজাল কেন ওর সঙ্গে কথা না বলে শুয়ে পড়ল। আফজাল পাশে শুয়ে গভীর নিদ্রামগ্ন। মৌমিতা চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছে, কিন্তু পারেনি। সেদিনের সে স্মৃতি আজও মৌমিতার বুকে বাজে। বোধকরি, সব মেয়েরাই একটা কল্পনার জাল বুনে তার জীবন সঙ্গীকে নিয়ে স্বপনের পরিপূর্ণতায়। আজ এই শুভ দিনে মৌমিতা প্রস্তুত ছিল না এত শক্ত কথা শোনার।

মৌমিতার ইচ্ছে হচ্ছিল, আফজালকে কাছে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে, কী কষ্ট তোমার! মৌমিতা যেন চমকে গেল। এ কেমন বাসর রাত আজ ওর। তবে কি আফজালের ভালো লাগেনি আমাকে। এ কীভাবে সম্ভব! আমাদের দুজনের বিয়ের আগে তেমন কোন পরিচয় ছিল না। আলাপচারিতা ছাড়া কীভাবে দুজনে এত সহজে এক রুমে থাকব!

ভেবেছিলাম, কথার মালায় রজনী পার হবে আজ। কিন্তু ভালোবাসা ছাড়া স্বামীর অধিকার শুধু মৌমিতা উপলব্ধি করতে পারল সেই রাতে। পর দিন সকালে মৌমিতা বুঝতে পারছিল, পরিবর্তন তার জীবনে ঘটে গেছে, সেটা কি ভালোবাসা ছিল নাকি স্বামীর অধিকার ছিল। প্রথম রাত শুধু নয়, এমন বহু রাত ভালোবাসাহীন মৌমিতা আফজালের অধিকারের কাছে পরাজিত। অজানা ভীতি মৌমিতা অনুভব করল। পরের দিন বাইরে অন্যরা কত কী আনন্দ, হাসি তামাশা করছিল আফজাল আর মৌমিতাকে নিয়ে! আফজালের যেন কোন কিছুতেই ছুঁয়ে যায়নি। মৌমিতা সেদিন লজ্জাবতী লতার মত নতজানু হয়ে গিয়েছিল।

এমন অচেনা মানুষটা অচেনাই রয়ে গেল। মৌমিতা ভাবছে, কেন হতে পারল না আফজালের হ্রদয়ের রানি। যেখানে তার সমস্ত হৃদয়জুড়ে মৌমিতা থাকবে। বিবাহ দুটি হৃদয়ের বন্ধন নাকি শুধু অধিকার। এভাবে কেটে গেল ১৯ বছর মৌমিতা আর আফজালের। প্রথম রাত শুধু নয়, বহু রাত যখন মৌমিতা আফজালের অধিকারের কাছে পরাজিত, অজানা ভীতি অনুভব করল সে। তাকে অনেক দূরে নিয়ে গেল আফজালের কাছ থেকে।

আজকাল দূরত্বটা আরও বেড়েছে। আর এক ঘরে থাকাও হয় না। মৌমিতা প্রায়ই শুনে, ওর পাশের ঘরে আফজাল ফিশ ফিশ করে ফোনে অন্য কারও সঙ্গে কথা বলে। রাগ হয় না, কষ্ট হয়। প্রিয় কোন একজনের সঙ্গে কথা বলেছে বোঝা যায়। স্বামীর মধুর ধৈর্য কণ্ঠ শুনে তাই মনে হয়। সে আফজালের খুবই আপন কেউ হবে।

ফোনে কথা বলার পর মৌমিতা আফজালকে একদমই চিনতে পারে না। এ যেন এক অচেনা পৃথিবীতে তার স্বামীর বাস। যেখানে প্রবেশ করার অধিকার তার নেই। প্রথম প্রথম মৌমিতা মেনে নিয়েছিল। দিনের পর দিন আফজাল তার ফোনে কথা বলে অন্য কারও সঙ্গে। কারণে–অকারণে অবহেলা করে তাকে। কখনই সময় দেয় না, তাকে ঘিরে আফজালের কোনো আনন্দ নেই। যখনই মৌমিতার কথা বলার সময় তখনই ব্যস্ততা। কারণে–অকারণে তাকে দোষারোপ করা।

হঠাৎ একদিন ফোনে শুনতে পাওয়া আফজালের কথা মৌমিতাকে স্বচ্ছ আয়নার মত পরিষ্কার করে দিল সবকিছু। আজ দুজনের দূরত্বের কারণ কি! মৌমিতা একি শুনেছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না। প্রাণ খুলে মৌমিতা কাঁদতে থাকল একা তার রুমে। তার প্রিয় স্বামী ফোনে একজনকে বলছে, মৌমিতাকে বিয়ে করেছি ঠিকই, সে আমার বউ নয়, আমার ঘরের শিক্ষিতা চাকর। আমাদের বাচ্চাকে মানুষ করার জন্য তাকে রেখেছি। বিয়ে হলেই বউ হয় না।

এত সত্য কথা এভাবে শোনার জন্য মৌমিতা প্রস্তুত ছিল না। ওদের দুজনের সম্পর্কের এতটা তীব্রতা মৌমিতা বুঝতেও পারেনি। তা বাস্তবে এত নিষ্ঠুর রূপ নিয়ে আসবে। এই আগস্ট মাসে এলেই তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই মাসেই যে মৌমিতার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ঘটেছিল। জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখের পরিমাণ এতটাই বেশি যে, সুখগুলো কবে এসেছিল সেটাই সে ভুলে গেছে।

কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না। কথা বলার প্রয়োজনও মনে করে না। আজকাল বড় একা লাগে, জীবনের পরাজয়ের কাছে বড় অসহায় মৌমিতা। রাতের আঁধারে বসে বসে সে ভাবছে, ২৬ আগস্ট দুঃখের রজনীর নীলবাসরের স্মৃতি বিজড়িত সঙ্গীহীন আমি। আজ তুমি ছাড়া আমার কেবলই একলা জীবন।