একটি রোলেক্স

দেরি, প্রতি দিনই দেরি। প্রবাসের এই কর্মব্যস্ত জীবনে যন্ত্রচালিত রোবটের মতো যতই তাড়াহুড়া করুক না কেন এই দেরিটা এমনভাবে ঘাড়ে চড়ে বসেছে, যেন কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারছে না রাকিব। কর্মস্থলে রওনা দিতে প্রতি দিনই দেরি করে ফেলে সে। যাত্রার প্রাক্কালে ছোটখাটো বিভিন্ন কাজ ভয়ানক অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাচ্চাদের স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি। ঘরে বসে সারা দিন হই-হল্লা ছোটাছুটি। কাজে যাওয়ার আগে তাদের গোসল করানো, খাওয়ানো, পরিচর্যা করে তবে বেরোনো। স্ত্রী সেই সকাল ৭টায় ছুটে গেছে নিজ কর্মে; আসবে বিকেল ৩টায়।
এক ছেলে এক মেয়ের ছোট সংসার রাকিবের। স্ত্রী কাজ করে সকালে, তাই সে কাজ নিয়েছে বিকেলের শিফটে। তার শিফট শুরু বেলা দুটায়। আজও ভেবেছিল, যে করেই হোক সোয়া ১টার মধ্যে বের হবে। কিন্তু অবশেষে দেরি হয়েই গেল। বের হবে, ঠিক সে মুহূর্তে এক টেলিমার্কেটিংয়ের ফোন। ফোনটি তুলে বিপদে পড়তে হলো। সে কিছুতেই ফোন রাখতে চায় না। একজন ফোন না রাখলে তো তার মুখের ওপর ধপ করে রেখে দেওয়া যায় না। এটা ভারী অভদ্রতা। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার সঙ্গে বকবকানি করতে করতে দেরি হয়ে গেল। প্রস্রাবের একটা চাপ অনুভূত হয়েছিল এ সময়, কিন্তু প্রস্রাবখানায় যেতে চায়নি, এমনিতেই ১টা ৪০ বেজে গেছে।

সে যে কোম্পানিতে চাকরি করে তার সুপারভাইজারটা বেশ ভালো। হিস্পানিক ভদ্রলোক, নাম লুইস। সব সময় হেসে হেসে কথা বলে। দেখা হলেই সে বলবে, ‘আমিগো ক্যাপাছো?’ এটা হিস্পানিক শব্দ, যার অর্থ, ‘হে বন্ধু কেমন আছ?’ এর আগে রিচার্ড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ ছিল, ব্যাটা বদের হাড্ডি। তার মুখে হাসির ছিটেফোঁটা দেখেনি গত দু বছরে। যেকোনো সামান্য ব্যাপারেই একটা বিরাট ঝামেলা বাঁধিয়ে বসত। তার অত্যাচারে চাকরিটা তো প্রায় ছেড়েই দিতে চেয়েছিল রাকিব। ফ্রিটোলে, আমেরিকান স্ন্যাক অ্যান্ড চিপস কোম্পানি। ভালো একটি কোম্পানি। মেডিকেল, ইন্স্যুরেন্স, সিক পে, ভ্যাকেশনসহ ভালো বেনিফিট আছে এখানে। তা না হলে এত দিনে চাকরিটা ছেড়েই দিতে হতো। লুইস আসার পর মনে একটা স্বস্তি এসেছে, না চাকরিটা বোধ হয় ছাড়তে হবে না।

বাড়ি থেকে বের হয়ে জিমি কার্টার বুলেভার্ডে লেফট টার্ন নিলেই কয়েক লাইট পরেই মহাসড়ক এইটিফাইভ। খুব জোরেশোরেই গাড়ি চালাচ্ছিল রাকিব। এর মধ্যে প্রস্রাবের বেগটা আরও প্রবল হলো, না করলেই নয় দশা। কারণ, হাইওয়েতে নামলে তো আর প্রস্রাব করার সুযোগ থাকবে না। হাইওয়েতে নামার আগেই সেল পেট্রল ফিলিং স্টেশনে। ঢুকতে বাধ্য হলো সেখানে।

মূল স্টোরের পেছনে পার্কিং স্পেসের কাছ ঘেঁষে রয়েছে দুটো শৌচাগার। একটি পুরুষের, অন্যটা নারীদের। রাকিব শৌচাগারে ঢুকতে গিয়ে দেখে সেখানে পার্ক করা রয়েছে কালো রঙের একটি বিলাসবহুল মার্সিডিজ বেঞ্জ; দারুণ বাহারি গাড়ি। পুরুষদের শৌচাগার থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলেন এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। এর পরপরই মহিলাদেরটি থেকে ফুটফুটে এক শ্বেতাঙ্গিনী; অর্ধ উলঙ্গ, হাই হিল পড়া বক পাখির মতো কোমর দোলাতে দোলাতে গাড়িতে উঠে গেল। উঠেই বলল, লেটস গো।

শৌচাগারের দরজা খুলতেই রাকিবের চোখ পড়ল বেসিনের ওপর কী যেন চকচক করছে? তার ওপর দু-চার ফোটা পানিও মুক্ত দানার মতো বিকিরণ ছড়াচ্ছে। রাকিব আঁতকে ওঠে। ওমা, ‘একটি রোলেক্স’। রোলেক্স ঘড়ি, ডে ডেট সুপার প্রেসিডেন্টাল রোলেক্স, যার মূল্য কম করে হলেও দশ হাজার ডলার। নিশ্চয় ওই ভদ্রলোকের, যিনি দরজা খুলে কেবল বেরিয়ে গেলেন। শৌচাগার ব্যবহার করে হাতমুখ ধোয়ার সময় ঘড়িটি খুলে বেসিনের ওপর রেখেছেন। তাড়াতাড়ি বের হতে গিয়ে হাতে দিতে ভুল করেছেন। রাকিব তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ভদ্রলোককে খোঁজ করল। কোথায় ভদ্রলোক? গাড়ি চড়ে তিনি হাওয়া। তাকে কি আর পাওয়া যায়?

রাকিব ঘড়িটাকে পকেটস্থ করল। শৌচাগারের দরজা বন্ধ তবুও চারদিকে তাকিয়ে নিল। কেউ তাকে দেখেনি তো ঘড়িটাকে পকেটে ঢোকাতে। প্রস্রাব করার পর মাথাটা বেশ ভালোই কাজ করছে। দরজা খুলে বেরিয়ে এল। সামনে পাম্পে লোকজন যে যার গাড়িতে পেট্রল ঢোকাচ্ছে। আরেকটা গাড়ি এসে সেখানে দাঁড়াল।

ফ্যাক্টরিতে ঢুকতে সামান্য দেরি হয়ে গেল। কী আর করা যাবে। বেশ আত্মবিশ্বাসী পায়ে ব্রেক রুমে ঢুকল। নিজস্ব পোশাকটা পাল্টে কোম্পানির ইউনিফর্মটা গায়ে ঢোকাল। চোখে মুখে অস্থির উজ্জ্বলতা, হাঁটাচলা সাবলীল। ভেন্ডিং মেশিনে তিনটি কোয়ার্টার (৭৫ সেন্টস) ঢোকাল; টপ করে একটা কোকাকোলার ক্যান বেরিয়ে এল। তাতে চুমুক দিতে দিতে ডিউটি রুমের দিকে এগিয়ে গেল।

কো-ওয়ার্কারগুলো এ ওর দিকে চাওয়া চাওই করছিল। অন্যদিন ছোকরা চুপচাপই থাকে। আজ ব্যাপার কী! আজ একদম অন্য রকম লাগছে। একজন তো বলেই ফেলল, ‘হোয়াটস আপ বাডি? লুকস ভেরি হ্যাপি, হ্যাভ ইউ হিট দ্য জ্যাকপট? অর গট এ নিউ গার্লফ্রেন্ড?’

রাকিব ঘাবড়ে গিয়েছিল। তাকে কী কোনোভাবে অস্বাভাবিক লাগছে আজ? একটুতেই শঙ্কিত হয়ে ওঠা ওর চিরকালের স্বভাব। নিজকে একটু সামলে নিয়ে সে উত্তর দেয়, ‘নো, নো, ডুয়িং সাম ইয়োগা এক্সারসাইজ রিসেন্টলি, দ্যাটস হোয়াই লুকিং ফ্রেশ।’ আবার সবাই চুপ। কিন্তু রাকিবের কিছুতেই মন বসছে না। বারবার মনে আসে ঘড়িটার কথা। প্যান্টের পকেটে ওটা খচখচ করছে। গুটিয়ে থাকা সাপের মতো ওটার উপস্থিতি আতঙ্কিত করে তাকে।

শীতাতপনিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেও মনে হচ্ছে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মনটা ভারী অস্থির লাগছে। রাকিব শৌচাগারে ঢুকে পড়ে আয়নার সামনে নিজের চেহারাটা আরেকবার দেখে নেয়। সিঙ্ক ছেড়ে নাকে মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে তা আবার পেপার টাওয়েল দিয়ে মুছে ফেলে। শৌচাগারের দরজার দিকে নজর ফেলে আরেকবার পরখ করে নেয় ওটা ভালো করে বন্ধ করেছে কিনা। এবার পকেট থেকে ঘড়িটাকে বের করে উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে। ঘড়িটা মেড ইন হংকং বা ফিলা মার্কেটের নয় তো? তা হলে এখন সে কী করবে? বুঝে উঠতে পারছে না। ভেতরে-ভেতরে একটা রোমাঞ্চ কাজ করছে। যদি ওটা আসল রোলেক্স হয়, তা হলে অসংখ্য সম্ভাবনা। ওফ, গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সে শৌচাগার থেকে বেরোয়, ‘ইউ আর মাই জ্যাকপট’।

বছরখানেক হলো নতুন বাড়ি কিনতে পারসোনাল লোন নিতে হয়েছে। বাড়ির মর্টগেজ গুনতে হচ্ছে মাসে মাসে পনেরো শ ডলার। আবার ক্রেডিট কার্ডে ঢের বিল পড়ে রয়েছে। তারপর সংসার খরচ। বেতনের ৩ হাজার ডলার যে কোথা দিয়ে উবে যায়, কে জানে। ব্যাংক ব্যালেন্স শূন্যের কোঠায়। নাজেহাল অবস্থা। সামনের মাসের ২০ তারিখে ছেলের জন্মদিন। গত দু বছর ধরে ছেলের জন্মদিনের পার্টি দেওয়া হয় না। এবার ছয় মাস আগে থেকেই বউ বলে আসছে, ছেলের জন্মদিনে পার্টি দিতে হবে। এমন সময় বেশ টাকার দরকার রাকিবের। আর ঠিক এ মুহূর্তেই এল ধন হাতের মুঠোয়; সাক্ষাৎ জ্যাকপট। মরার ঘড়িটা আবার রীতিমতো সংকটে ফেলে দিয়েছে।

রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টাই খোলা ফ্যাক্টরি। রাকিব ডিউটি করে বেলা দুটো থেকে রাত দশটা অবধি। কখন যে দশটা বেজে গেছে সে টেরই পায়নি। টের পেল তখন, যখন রাতের ডিউটিতে আসা জনসন এসে তার ঘাড়ে হাত রেখে বলে উঠল, ‘হেই রকি, হাউ আর ইউ।’ জনসনকে দেখে তার মতিভ্রম হলো, সে তো রাতে কাজ করে, তাহলে কি দশটা বেজে গেছে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে হ্যাঁ, তাই তো দশটা বাজতে আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি। সেই একই পথে বাড়ি ফেরা। দীর্ঘ হাইওয়ে পেরিয়ে জিমি কার্টারে টার্ন নিতেই সেল ফিলিং স্টেশন। তখন রাত সাড়ে দশটা প্রায় বাজে। টার্ন নিল স্টেশনে। তারপর সন্তর্পণে ঢুকল স্টোরে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিল ভয়ে ভয়ে কেউ কোথাও আছে কিনা। না কেউ কোথাও নেই। স্টোরে লোকজন না থাকায় স্টোর ক্লার্ক একটা ডাস্টার হাতে এটা-ওটা ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করছিল। পকেট থেকে ঘড়িটা বের করে তার কাছে জমা দিয়ে বলবে, আজ বিকেলে সে এটা শৌচাগারে পেয়েছে; কেউ এসে খোঁজ নিলে, তা যেন প্রকৃত মালিককে ফেরত দিয়ে দেয়। বের করতে যাবে আর কি, অমনি মনে পরে কাজলের কথা। পাঁচ বছর হলো তাকে নিয়ে এসেছে আমেরিকা।

আসার পর থেকে উটকো ঝামেলা ছাড়া কি-ই বা দিতে পেরেছে তাকে। বরাবরই বলে আসছে তোমায় একটা সোনার টুকরা ছেলে উপহার দিলাম; বিনিময়ে তুমি আমাকে কিছুই দিলে না। এবার ছেলের জন্মদিনে সোনার কিছু একটা দিলে নিশ্চয় খুশি হবে। সোনা মেয়েদের অতি প্রিয়। সোনা হলেই হলো। পরে ভাবল, ঘড়িটা যখন ফেরত দিলই না। এক কাজ করি ছেলেটাকে একটু বাজিয়ে দেখি তো। বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, আজ দুপুরে সে তাদের শৌচাগার ব্যবহার করেছিল। ভুল করে সে তার চাবির ছড়া ফেলে গেছে সেখানে। কেউ কি পেয়ে তার কাছে জমা দিয়ে গেছে? ছেলেটা জবাবে বলল, ‘না না কেউ কোনো চাবি দিয়ে যায়নি।’ যাক, বাঁচা গেল ঘড়িটার খোঁজে তখনো কেউ আসেনি। এলে নিশ্চয় সে বলত চাবির ছড়া নয়, এক ভদ্রলোক তার ঘড়ি ফেলে গেছে; তারই খোঁজে এসেছিল সে। সে সিদ্ধান্ত ঠিক করে ফেলে। পন শপ। পন শপে বেচে দেবে এটা। এত রাতে তো সব পন শপ বন্ধ। কাল সকাল ৯টার আগে খুলবে না। কিন্তু ঘড়িটাকে নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। ওটা যতক্ষণ সঙ্গে থাকবে, স্বস্তি দেবে না, বিষ মেশাবে মগজে।

পরদিন সকল ১০টায় মল অব জর্জিয়ায় বিখ্যাত পন শপ ‘আমেরিকান পন শপ’-এ রাকিব সাহস করে ঢুকে পড়ল। স্বচ্ছ কাচের খাঁচার মধ্যে স্টোর ক্লার্ক বসে আছে। সামনে একটা কম্পিউটারাইজড ক্যাশ রেজিস্ট্রার। খাঁচায় আবার দুটো জানালাও আছে। যাক গে, তার একটি দিয়ে হাত পুরে ঘড়িটাকে সে দেয় ভদ্রলোকের দিকে, দেখুন তো এটা কত দাম আসে। বলার সময় তার গলা কেঁপে উঠেছিল সংশয়ে। আসল রোলেক্স না হলে তো ভয়ানক অপমান। তবু রক্ষা আশপাশে কোনো চেনা-জানা লোক নেই। এত দামি জিনিস যদি মালিকানার ডকুমেন্ট চেয়ে বসে। বলবে, আউট অব স্টেট থেকে এসেছে, হঠাৎ ক্যাশ টাকার দরকার হয়ে পড়ায় বেচতে বাধ্য হয়েছে; ডকুমেন্ট তো কাছে নেই।

লোকটা তার কাছে এসব কিছুই জিজ্ঞেস করল না। ঘড়িটা হাতে নিয়ে কম্পিউটারে কয়েকটা বোতাম টিপাটিপি করল। কি টিপল সেই জানে। কিছুক্ষণ বাদে বলল, ‘ডে ডেট সুপার প্রেসিডেন্টাল রোলেক্সের মার্কেটে মূল্য আছে ১০ হাজার ৬৫৫ ডলার। দু বছরের পুরোনো; তাই তার কোম্পানি চার হাজার ডলারের বেশি দেবে না।

‘না, এ দামে দেওয়া যাবে না’, বলে রাকিব একটা মোড় দিল দামটা যদি একটু বাড়ানো যায়। দোকানিও তার দামে অনড়। চার হাজারের বেশি দেবে না। অবশেষে রাকিব বাজি হয়ে গেল ওই দামে। মনে মনে বলল, ‘ভিক্ষার চাল কাড়া, আর আকাড়া। বাবা দামটা দে এখান থেকে সটকে পড়ি।’ মুখে বলল, ‘আমার একটু তাড়াহুড়া আছে। হুট করে টাকার দরকার হয়ে পড়ল, না হলে কেউ শখের জিনিস বেচে বলুন তো।’

-দ্যাটস অল রাইট। বলে লোকটা জিজ্ঞে করল, ক্যাশ নেবেন না চেক?’
-না, না আমার ক্যাশ দরকার। চেকটা আবার কোথায় ভাঙাব। আপনি ক্যাশই দিন।

লোকটা ৪০টা এক শ ডলারের নোট কাউন্টারের উয়িন্ড দিয়ে একটা একটা করে গুনে দিল রাকিবের হাতে। রাকিব ওগুলোকে পকেটে পুরে চট করে এসে নিজের গাড়িতে স্টার্ট দেয়। চলন্ত গাড়িতে একহাতে গাড়ির স্টিয়ারিংটা শক্ত করে ধরে অন্য হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে মাঝে মাঝে ডলারগুলো টাচ করে তার গন্ধ শুকে নেয়। ওফ কি সুঘ্রাণ! মুহূর্তে সে কুঁকড়ে যায়। ছিঃ কতটা নিচে নেমে গেছে সে।

কিন্তু আর কি-ই করতে পারত সে। ২০ হাজার ডলার লোন নিয়ে গাড়িটা কেনা হয়েছে। মাস শেষে সেখানেও দিতে হয় আড়াই শ ডলার। গাড়িটা বেশ জোরেশোরেই চালাচ্ছিল, বাচ্চা দুটোকে অ্যাট্যান্ডেন্টস রেখে এসেছে বাড়িতে। বেশি জোরে গাড়ি চালালে আবার পুলিশ টিকিটেরও ভয় আছে। সামনের ট্রাফিক সিগন্যালে আবার রেড লাইট পড়ে গেল। থামতে হলো সেখানে। একটু বিরক্ত হয়ে উঠল, ‘রেড লাইট তুই আর জ্বলার সময় পেলি না।’ গ্যারেজে গাড়ি রেখে যখন ঘরে ঢুকল, মেয়েটা এসে বলল, ‘বাবা ভাইয়া কেঁদেছে। মনে হয়, ক্ষুধা পেয়েছে। ওকে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ভেজে দেবে?’ ঠিক আছে দিচ্ছি। বলে, ড্রয়ারটা খুলে টাকাগুলো রেখে ঢুকল রান্নাঘরে। মনে মনে বলল, সামনের উইকেন্ডে ছেলের জন্মদিন উদ্‌যাপনের সিদ্ধান্তের কথা বউকে জানাবে।

শনি ও রবি দুদিন সাপ্তাহিক ছুটি। রাকিবের ঘুম ভেঙেছে সেই সকালেই। তবুও সে চোখ বুঁজে শুয়েছিল। ছাইপাঁশ চিন্তা করে ওর মগজটা ক্লান্ত। এখন ওটাকে একটু রেহাই দিতে হতো। কিন্তু তলেতলে চোরা স্রোতগুলো কে ঠেকাবে? সে যা করল ঠিক করল তো? এর ফল কী? বাথরুমে তো কেউ তাকে দেখেনি ঘড়িটি পকেটস্থ করতে? কিন্তু পন শপে বিক্রি করেছে এ তথ্যটা যদি বেরিয়ে আসে? পরে কেউ তার পিছু নেবে না তো? ঘড়িটার কাল্পনিক কলুষ নিশ্চয় ছুঁতে পারবে না রাকিবকে। নিশ্চয় এটা কোনো অন্যায় হবে না। পরক্ষণেই আত্মধিক্কারে সোচ্চার হয়ে ওঠে সে। বিবেক বলতে তো একটা কথা আছে? আরে বিবেক করে কী হতো প্রকৃত মালিককে সে কোথায় খুঁজে পাবে? রাতে যখন সে সন্ধান নিতে গেল, তা যে ঘড়িটার সন্ধানে কেউ এসেছে কিনা? না কেউ আসেইনি। হয়তো সে মনেও করতে পারেনি কোথায় সে খুইয়েছে তার ঘড়িটা। বোকার মতো তার কাছে জমা দিলে হয়তো সে নিজেই আত্মসাৎ করে ফেলত ওটাকে।

এমন সময় স্ত্রী কাজল ঢুকল রুমে, ‘কী গো এখনো ঘুমিয়ে আছ?’ উঠবে না?
-হ্যাঁ, উঠব তো! তুমি এদিকে একটু এসো।
-না, আসব না, আমার অনেক কাজ আছে! বাচ্চা দুটোকে ওঠাব, ওদের নাশতা তৈরি করব ইত্যাদি ইত্যাদি।
-না আসই না! জরুরি কথা আছে।

কাজল এসে পাশে বসল। কী তোমার জরুরি কথা শুনি?
-আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি ছেলেটার জন্মদিন। বিগত কয়েক বছর ধরেই তো ওর জন্মদিনে কোন পার্টি-টার্টি দেওয়া হয় না। সংসারে টানাটানি তো লেগেই আছে, আর তা থাকবেও। সে তো আমার চলার পথের সাথি, তাকে যতই তাড়াতে চাও, তাকে কখনো তাড়াতে পারবে না। তুমিই

তো বলে আসছ—এবার ছেলের জন্মদিনে পার্টি দিতে হবে, না হলে বাবু খুব মন খারাপ করবে।
-হ্যাঁ, বলেছিলাম তো? কোনো লটারি-ফটারি পেয়েছে নাকি?

-লটারি ফটারি নয়। গতকাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট সাহেব বললেন, গত মাসে আমাদের ফ্যাক্টরিতে প্রোডাকশন ভালো হয়েছে এবং ব্যবসাও নাকি বেশ ভালো হয়েছে। তাই আমরা আগামী মাসে একটা ভালো বোনাস পাচ্ছি। তা ছাড়া খ্রিষ্টমাসের বোনাসটা তো পাচ্ছিই। সব মিলায়ে বেশ ভালো টাকাই হাতে আসছে। আগে থেকে পরিকল্পনা নিলে হয়তো সময়মতো পার্টিটা করতে খুব একটা অসুবিধা হবে না।

-ও মা! তা হলে তো ভালোই হয়। কত দিন বাবুটার জন্মদিনে পার্টি দেওয়া হয় না। এবার কিন্তু আমাকে সোনার একটা কিছু দিতেই হবে। ছেলে তো আর তোমার একার নয়! কত কষ্ট করে গর্ভে ধরেছি।
-আচ্ছা দেব।

কাজল মুখটাকে রাকিবের গলার মধ্যে গুঁজে দিয়ে অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে, ‘এবার ছেলে-মেয়েদের গ্রীষ্মের ছুটিতে চল না ফ্লোরিডা যাই। ডিজনি ওয়ার্ল্ড ঘুরে আসি। ওরা কতবার যেতে চেয়েছে। রাকিব কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। প্রায় আচ্ছন্ন অবস্থায় সায় দিয়ে যাচ্ছিল স্ত্রীর যাবতীয় আরজিতে। পরিণতি যা-ই হোক। সে আজ একজন সার্থক স্বামী হয়ে উঠতে পেরেছে, এই সাফল্যটুকুই বা কম কীসে? খুশিতে ডগমগ হয়ে কাজল বেরিয়ে গেল।

রাকিব বিছানা ছেড়ে ওঠে বলল, ‘শুভ কাজে দেরি করতে নেই। আজকে যখন তোমার-আমার দুজনেরই ছুটি, তাহলে প্রস্তুতিটা আজকেই করা যাক। একটা লিস্ট করে ফেল, কাকে কাকে নিমন্ত্রণ করবে, যেন কেউ বাদ পড়ে না যায়। পরে আবার কেউ কেউ মান ধরবে। সবাইকে তো আনতে হবে ওই দিন। সিদ্ধান্ত হলো আজ সন্ধ্যাবেলা কোহিনূর রেস্টুরেন্টে যাবে ক্যাটারিংয়ের ব্যাপারে আলাপ করবে। সুবিধা না হলে ডিকেটরে রয়েছে ‘মরিচ মসলা’, সেখানেও যাওয়া যেতে পারে। আর তার চেয়ে বড় কথা হলো ‘বিন্দি’ অথবা ‘এশিয়া জুয়েলার্স’ যেতে হবে। ওখানে বেশ খানিকটা সময় লাগবে। গয়না পছন্দের ব্যাপারে তো তাড়াহুড়া করলে চলবে না। রাতে আজ রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেব।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল। কাজলের সাজগোজ প্রায় শেষ। বাইরে কোথাও গেলে সে কখনো আগেভাগে রেডি হতে পারে না। রাকিব তৈরি হয়ে গাড়িতে গিয়ে দু-তিনবার হর্ন বাজাবে, তবুও সে তৈরি হয় না। আর আজ হলো তার উল্টো। সবার আগে সে তৈরি। এটা মেয়েদের স্বভাব। নিজের কাজে তাদের কখনো আলসেমি নেই। যত তাড়াতাড়ি পারে তৈরি হয়ে যাবে। রাকিব তখনো তার রুমে বসে কম্পিউটারে ফেসবুক ঘাঁটাঘাঁটি করছিল। কাজল একবার এসে তাড়া দিয়ে গেল। আবারও যখন এল, তখনো রাকিব ফেসবুকে। তৃতীয়বারে কাজল রেগেমেগে বলল, ‘তুমি যদি এখনো ওখান থেকে না ওঠ, আমি কিন্তু আজ তোমার সঙ্গে যাব না বলে দিচ্ছি। আর তুমি সেখানে গিয়ে যে বলবে তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি কর তা কিন্তু চলবে না।’

এবার চেয়ার ছেড়ে হুড়মুড় করে ওঠে রাকিব। বেছে বেছে ভালো প্যান্ট-শার্ট গলিয়ে নিল শরীরে। চুল আঁচড়াল সযত্নে। আয়নার সামনে দাঁড়ায়। বেশ ভালোই দেখাচ্ছে, স্মার্ট স্মার্ট লাগছে। কিন্তু আয়নার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না সে। ঘড়ির মালিকটা এসে ঘাড়ে হাত দিয়ে কানে কানে যেন বলছে, ‘কী রে ভায়া পরের ধনে পোদ্দারি!’ রাকিব যেন আনন্দিত হতে পারছে না। ফালতু চিন্তাভাবনা করা একটা বদ অভ্যাস হয়ে গেছে। কী দরকার ছিল এই বাহানার। পরের জিনিস আত্মসাৎ করে নিজের মনকে ধোঁকা দেওয়া।

কাজল ইতিমধ্যে কাপড়ের আঁচলটাকে গুটিয়ে নিয়ে গাড়ির সামনের একটি আসন দখল করে বসেছে। ছেলে-মেয়েরাও পেছনের আসনে বসে পড়েছে। রাকিব চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে এসে গাড়িতে ওঠে। গাড়ির সামনে-পেছনে আরেকবার দেখে নেয় সব ঠিকঠাক আছে কি না। স্ত্রীর কাছে জিজ্ঞেস করে, ‘বাড়ির দরজা-জানালাগুলো ভালোভাবে দিয়েছ তো?’ যেন এক বিরাট দায়িত্ববান পুরুষ। স্ত্রীর জবাব আসে, ‘হ্যাঁ।’ অমনি রিমোট টিপে গাড়ি গ্যারেজের ঝাঁপটা নামিয়ে দিল। এবার আসে ক্যার ক্যার শব্দে গাড়ি স্টার্টের আওয়াজ। আর হুস করে পেরিয়ে যায় গলির মোড়টা। সামনে রাইট টার্ন নিলেই কোহিনূর রেস্টুরেন্ট।