ফিরে দেখা স্ট্যাচু অব লিবার্টি

আবারও দেখা হলো স্ট্যাচু অব লিবার্টি। ২০০০ সাল, অর্থাৎ আজ থেকে উনিশ বছর আগে একবার দেখা হয়েছিল স্ট্যাচু অব লিবার্টি। ১৯৯৯ সালে আমার পরিবার অভিবাসী হয়ে আমেরিকায় আসে। পরের বছর আমার স্ত্রীর বড় বোন এলেন লন্ডন থেকে ছেলে-মেয়ে নিয়ে। উদ্দেশ্য, দীর্ঘদিন পর ছোট বোনের সঙ্গে মিলিত হওয়া, সঙ্গে বিশ্বের উন্নত দেশ আমেরিকা পরিদর্শনে দু চোখকে সার্থক করা।

তাঁদের আগমনে আমিও অনেক খুশি। কারণ, তাঁদের আসা উপলক্ষে সবাইকে নিয়ে একটু হই হুল্লোড় করে ক’টা দিন কাটানো যাবে। প্রবাস জীবনে খালি কাজ আর কাজ। ঠিক করলাম কাজ থেকে এক সপ্তাহ ছুটি নেব। তারপর নিউইয়র্কের সব স্থাপনাগুলো তাদের নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখব। সত্যিই একদিন বেরিয়ে গেলাম। নিউইয়র্কসহ আরও কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের বিখ্যাত স্থাপনাগুলো দেখলাম।

প্রথমবার কোনো কিছু দেখে তার সঠিক মূল্যায়ন করা খুবই কঠিন। তাই আমি মনে করি সম্ভব হলে অন্তত দুবার যেকোনো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা পরিদর্শনে যাওয়া উচিত। সেদিন আমার ছোট মেয়ে হঠাৎ ফোন করে বলে, ‘আব্বা আমরা কাল স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখতে যাব। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ, তাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আম্মাকে নিয়ে তোমরাও যাবে আমাদের সঙ্গে।’ বিনা বাক্যে আমিও রাজি হয়ে গেলাম। উইক ডেতে ভোরের পাতাল ট্রেনে ভীষণ ভিড়। বাচ্চাদের নিয়ে ট্রেনে ভ্রমণ করা সমীচীন নয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম উবার নিয়ে নিউইয়র্ক ডাউন টাউনের স্ট্যাটেন আইল্যান্ড ফেরির কাছে নেমে যাব। কাছেই স্ট্যাচু অব লিবার্টি যাওয়ার লঞ্চঘাট। নিউইয়র্ক হারবারে স্থাপিত স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে যেতে একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ ধরনের লঞ্চ। তাই সবাই নিজস্ব যানবাহন রেখে ভিন্ন পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হয়।

সাত সিটের উবারের মিনি ভ্যানে চেপে চলে এলাম ওয়ান নিউইয়র্ক প্লাজার সামনে। মেঘলা ধোঁয়াটে আকাশ, কনকনে ঠান্ডা বাতাস ধেয়ে আসছে পাশের হাডসন নদী থেকে। এ সময় বাংলার শরৎ ঋতুর মৃদুমন্দ বাতাসে সুরমা পারের কৃষকের বোনা আউশ ধানে ঢেউখেলানো দৃশ্যকে মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু নিউইয়র্কের দৃশ্যপট ভিন্ন। কালো পোশাক পরিহিত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী এ এলাকায় খুবই তৎপর। নিউইয়র্ক নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা এখানেই শোভাবর্ধন করছে। আমেরিকার ফিন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট বলে পরিচিত এই এলাকা। এখানেই পুনর্নির্মাণ হয়েছে ঐতিহ্যবাহী ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। তার আশপাশে রয়েছে বিখ্যাত সিটি হলসহ হাজারো স্থাপনা। ওয়ান নিউইয়র্ক প্লাজা, আর এক ঐতিহ্যবাহী ৫২তলাবিশিষ্ট বিশাল অট্টালিকা। আমার ছোট মেয়ে রোমানার অফিস এই অট্টালিকার ছেচল্লিশ তলায় অবস্থিত। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পারদর্শী মেয়ে এত বড় অফিসে কাজ করে শুনে বুকটা ভরে গেল। আবেগাপ্লুত হয়ে মুহূর্তেই দু চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠল। এখান থেকে পাঁচ মিনিট হেঁটে আমরা বিরাট লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। শ পাঁচেক আবালবৃদ্ধবনিতা লাইনে দাঁড়িয়ে লঞ্চে ওঠার অপেক্ষায়।

দ্বিতলবিশিষ্ট লঞ্চ নির্ধারিত স্থানে নোঙর করার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ধীর গতিতে এগোতে লাগল। অল্পবয়সী যাত্রীদের সবাই দ্রুত উঠে গেল দ্বিতীয় তলায় অনেকে আবার চলে গেল ছাদে। অ্যাটেনড্যান্ট মেয়েটি পেছনের করিডোরে দাঁড়িয়ে আমার হাতের বইয়ের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘সিভিল ওয়ার? হয়্যার?’ মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে তার। এ বয়সের ছেলে-মেয়েরা আমেরিকার ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ রাখে না। মেয়েটি কৌতূহল রেখে যাত্রীদের দিকে হাসিমুখে দেখতে দেখতে মরাল গতিতে সামনে চলে গেল। আমি রেলিং চেপে ধরে নিউইয়র্ক হারবার আর হাডসনের সংযোগকারী জলবেষ্টিত মাঝারি সাইজের ঢেউয়ের উথাল-পাথাল নৃত্য দেখছিলাম।

ছোট ছোট পালতোলা বোটগুলোর প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠা দেখতে দেখতেই মাত্র পনেরো মিনিটে পৌঁছে গেলাম স্ট্যাচু অব লিবার্টির পাশে। অথই পানিবেষ্টিত চমৎকার বৃক্ষরাজি, আর বর্ণালি ফুলের সমারোহের দ্বীপের মধ্যখানে স্থাপন করা হয়েছে এই স্ট্যাচু অব লিবার্টি, অর্থাৎ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতীক এই মূর্তিটি। বিডলো আইল্যান্ড নামে খ্যাত এই দ্বীপের নাম আমেরিকার বিপ্লবের সময় করা হয় লিবার্টি ইন দি লাইটিং ওয়ার্ল্ড।

স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে স্বস্ত্রীক লেখক
স্ট্যাচু অব লিবার্টির সামনে স্বস্ত্রীক লেখক

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এই স্থাপত্যটির কাজ শুরু করে ফ্রান্স। আর্থার বাটার্লি নামের এক বিখ্যাত ভাস্কর মূর্তিটির বাইরের ডিজাইন করেন। তাঁর মা সারলটের চেহারার সঙ্গে মিল রেখে এই নারী মূর্তিটির নকশা করেন। পরে আলেক্সান্ডার গুতাফি আইফেল করেন ভেতরের ফ্রেমের কাজ, যিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ারটি নির্মাণ করেন। মূর্তিটির ভেতরের অংশের ফ্রেম লোহা বা স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ২২৫ টন স্টিল ও ৩০ টন তামার সংমিশ্রণে ফ্রেমটি তৈরি করা হয়। এর ওজন দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার লাখ পাউন্ড। যে বেদিটির ওপর মূর্তিটি দাঁড়িয়ে আছে, তার উচ্চতা পা থেকে হাতের মশাল পর্যন্ত একটি বাইশতলা বিল্ডিংয়ের সমান। প্রায় নয় বছরেরও বেশি সময় লেগে যায় এটির কাজ শেষ করতে। ফ্রান্সে নিযুক্ত আমেরিকার তদানীন্তন রাষ্ট্রদূতের কাছে আমেরিকার স্বাধীনতার শত বর্ষপূর্তিতে উপহার হিসেবে মূর্তিটি হস্তান্তর করে ফ্রান্স। ১৮৮৪ সালের জুলাই মাসে নিউইয়র্কে আনা হয় মূর্তিটি।

মূর্তিটির বাইরের অংশটি তামা বা কপারের তৈরি পাত দ্বারা আবৃত করা হয়। কিন্তু শুনলে অবাক লাগে, মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে তামার উজ্জ্বল বর্ণটি পরিবর্তন হয়ে হালকা সবুজ রং ধারণ করে, যা আজও দৃশ্যমান। বিজ্ঞানীদের ধারণা তামার সঙ্গে বাতাসের কার্বনের সংমিশ্রণের কারণে এই বর্ণ ধারণ করেছে।

মূর্তিটির ডান হাতে একটি প্রজ্বলিত মশাল ও বাম হাতে একটি ডাইরি আছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ডায়েরির ওপরে রোমান হরফে লেখা; ৪ জুলাই ১৭৭৬ সাল, যা আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণার তারিখ। হাতে ধরা মশালটি ১৯১৬ সাল পর্যন্ত দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত ছিল।

দর্শকেরা চাইলে মশালটি ওপরে উঠে স্পর্শ করতে পারতেন। কিন্তু পরে যখন ব্লাকটয় বিস্ফোরণে মশাল ও মূর্তিটির বিরাট ক্ষতিসাধন হয়, তারপর থেকে নিয়মকানুনে অনেকটা পরিবর্তন আসে। ১৯৮৬ সালে মূল মশালটি সরিয়ে নতুন একটি মশাল চব্বিশ ক্যারেট সোনার পাত দিয়ে তৈরি করে আগের মশালের জায়গায় স্থাপন করা হয়। মূল মশালটি পার্শ্ববর্তী মিউজিয়ামে রেখে দর্শকদের দেখার ব্যবস্থা করা হয়। লেডি লিবার্টি যে জুতাটি পরে দাঁড়িয়ে আছেন, তা ৭৭৯ নম্বরের। মূর্তিটির মাথায় যে মুকুটটি দেখা যায়, তাতে ২৫টি জানালা আছে। মুকুটের কাছে পৌঁছাতে দর্শকদের ৩৫৪টি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ভালো করে লক্ষ্য করলে মুকুটের মধ্যে সাতটি পাইট দেখা যায়। এই সাতটি পাইট সাতটি মহাদেশ ও সাতটি মহাসাগরের চিহ্ন বহন করছে। মূর্তিটির ডান পা একটু উঁচুতে স্থাপন করা। ডান পায়ের পাতার সামনে একটি ভাঙা শিকল রাখা আছে। এটি অত্যাচার ও দাসত্বের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মূর্তিটি তৈরি করতে তখনকার দিনে ফ্রান্সের খরচ হয়েছিল ২ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।

মূর্তিটির নিচের অংশ তৈরি করতে আমেরিকানদের খরচ হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার ডলার। অর্থাৎ বর্তমান বাজারমূল্যে ১ কোটি ডলার। প্রতি বছর গড়ে ৪০ লাখ দর্শনার্থী স্ট্যাচু অব লিবার্টি পরিদর্শনের সুযোগ গ্রহণ করেন। আমেরিকার অধিবাসী ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে।