তুই বন্ধু থাকিস...

বন্ধু...দুই অক্ষরের ছোট্ট একটি শব্দ; কিন্তু মানুষের জীবনে ক্ষুদ্র এই শব্দটির প্রভাব এতটাই যে, সে তার বর্ণহীন জীবনকে বর্ণিল করে মুহূর্তে। বন্ধুত্ব জীবনের পরম পাওয়াগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমার ধারণা, খুব ভাগ্যবানদেরই একজন ভালো বন্ধু জীবনে জোটে। কারণটা সহজ, বন্ধুত্ব জন্মসূত্রে পাওয়া কোনো সম্পর্ক নয়। বরং বন্ধু বাছাই করি আমরা নিজেরা, নিজের মতো করে। যাদের সঙ্গে নিজেদের ভাবনাগুলোকে অবলীলায় বলা যায়, মিলে যায়, চিন্তা চেতনা আর বিশ্বাস...তারাই মনের অজান্তে হয়ে যায় প্রিয়জন...প্রিয়ভাজন!

ক্ষুদ্র এই স্পর্শকাতর শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে থাকে মানুষের জীবনের সেই সম্পর্কের কথা, যে বা যারা রংধনুর সব রং নিয়ে এসে জীবনকে রঙিন করে দেয়। একমুঠো রোদ হয়ে আমাদের মধ্যে ছড়ায় উষ্ণতা। বিশ্বাসে বাড়িয়ে দেয় হাত, যে হাত নানা বিপদেও শক্ত করে ধরে রাখে। বন্ধু হচ্ছে সেইজন যার সঙ্গে নেই কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব। নেই কোনো হিংসা। বাগানের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটির হয় বন্ধু, যে তার ভালোবাসার সুবাস ছড়িয়ে সম্পর্কটাকে আরও গাঢ় করে গড়ে তোলে। এটি এমনই একটা সম্পর্ক যে শুধুই ভালোবাসা আর আনন্দেরই গন্ধ ছড়ায়। অদৃশ্য সুতার টানে ভালো বন্ধু হয়ে যায় সেইজন, যার সঙ্গে মানুষ তার জীবনের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ সব ভাগাভাগি করে নেয় অবলীলায়। তবে, বলাই বাহুল্য, যে কেউ চাইলেও ভালো বন্ধু হতে পারে না। ভালো বন্ধুর জন্য চাই সমমানের ভালো মন, সঙ্গে ভালো মন-মানসিকতার।

প্রকৃতির এক অদ্ভুত নিয়মে, খুব অল্প সময়ে একজন খুব কাছে চলে আসে, যেটা অনেকের সঙ্গে অনেক কাল থেকেও তৈরি হয় না! কিন্তু কেন জানি না, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই সুখটার চির শত্রুতা। কিন্তু কেন এই অবিচার?...নিয়তির কাছে প্রশ্নটা আমার বরাবরের!

বন্ধু হওয়ার জন্য সব গুন তোর ছিল। বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর থাকে দারুণ বোঝাপড়া। ছোট ছোট বিষয় নিয়ে তুমুল ঝগড়া করা। বন্ধুর কাছে যা প্রত্যাশা থাকে, তা হল একে অপরকে সবকিছু বিনা দ্বিধায় বলা, একে অন্যের মঙ্গল চাওয়া, চোখের আড়াল হলে অজান্তেই খুঁজে বেরা। আর রাগ করলেও সব ভুলে গিয়ে আবার কথা শুরু করা।

ভালো বন্ধুর সব গুন তোর মধ্যে ছিল। তোর হৃদয় ছিল শুভ্র।

জীবনের এমন বন্ধু যখন জীবন থেকে হারিয়ে যায়, এক নিমেষেই শেষ হয়ে যায় জীবনের সব আনন্দ। বন্ধু, তুই আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছিস ওপারে। জানি না কেমন আছিস, কি করছিস ওখানে। তবে এটুকু বলতে পারি, তুই যেখানেই থাকবি ভালো থাকবি, আশপাশের মানুষগুলোকে ভালো রাখবি।

নিশ্চিত মৃত্যুর পৃথিবীতে কিছু কিছু মৃত্যু বড় বেশি ছাপ ফেলে যায় জীবনে। কাছের দূরের বন্ধুদের হৃদয়ে দাগ রেখে যায়। বন্ধুর এভাবে চলে যাওয়া মেনে নেওয়া খুব কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই জীবন যেন হারিয়ে ফেলে গতি। চারপাশে সবাই থাকার পরও নিঃসঙ্গ লাগে। কোনো কিছুতেই আর আগ্রহ আসে না। জানি, কোন মানুষ মারা গেলে প্রথম দিন সবাই খুব খুব কাঁদে আর স্মৃতিচারণ করতে থাকে। দ্বিতীয় দিন কাঁদবে আর পুরোনো স্মৃতিকথাগুলো মনে পড়বে। তৃতীয় দিন কান্নাকাটি কিছুটা থামবে আর মরে যাওয়া মানুষটির কথা কমে আসবে। একসময় আবার সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আগের জীবনে চলে যাওয়ার চেষ্টা করবে। আমিও হয়তো তাই করব। দিনের পর দিন হয়তো মানুষটি একটু একটু করে দূরে চলে যাবে। এটাই হয়তো নির্মম বাস্তবতা।

একজন মানুষের বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ, একজন ভালো বন্ধু। বন্ধু এমন প্রিয় একজন, যে কিনা আত্মার আত্মীয়। সত্য মেনে নিচ্ছি, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে সব মিথ্যা। তুই আজ চলে গেছিস কয়েক দিন হলো, এখনো ফেসবুক বা মেসেঞ্জারে তোকে খুঁজে বেড়াই। মন বলে সব ভুল প্রমাণ করে চলে আসবি এখনই, আমাকে কতগুলো ইমোজি দিয়ে বলবি, কি খবর আছিস কেমন? দেখছিস তোকে কীভাবে বোকা বানালাম।

তোর উল্টাপাল্টা আর বেখেয়ালি কথার ওপর দারুণ রাগ ছিল আমার সব সময়। বিশ্বাস কর, আজ যদি তুই এই মিথ্যা বলিস, তুই কোথাও যাসনি; বিশ্বাস কর, আমি তোর ওপর এক বিন্দু রাগ করব না। তুই ফিরে আয়। মা তোর জন্য অপেক্ষার চাদর বিছিয়ে বসে আছে।

মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে তুই বাবার কবরটা ঠিক করলি, রং দিয়ে গাছ লাগিয়ে সাজালি। তুই কি জানতি, তুই থাকবি ওখানে? সব সময় এত পরিচ্ছন্ন থাকতি, আর সুন্দর সুন্দর কাপড় পরতি, শেষ দিনটিও তুই শ্যাম্পু করে নতুন ফতুয়া পরে তৈরি হয়েছিলি। তুই কি বুঝতে পেরেছিলি, তুই চলে যাবি?

আমার সঙ্গে এত কথা বলতি, এই কথাটা তো বলতে পারতি। বলিস নি। তোর ওপর ভীষণ রাগ আমার। তুই কখনো আমাকে তোর বেষ্ট ফ্রেন্ড বলবি না। তুই তোর কোনো কথাই আমাকে বলিস নি। তুই বলতি, মাকে ছাড়া তুই এক বেলা থাকতে পারিস না। তুই বড্ড বেশি মিথ্যুক, তা না হলে মাকে ছেড়ে এত দিন থাকছিস কীভাবে?

মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি স্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভাঙলে দেখব, সবকিছু আগের মতো হয়ে গেছে।

ভাবব এটা নিছক একটা দুঃস্বপ্ন, তাই না রে?...কী রে, উত্তর দিচ্ছিস না কেন বোকা?