এখানেও আছে 'বড় ভাইয়েরা'

প্রতিদিনের মতোই বিকেলে হাঁটতে বের হয়েছি। হেমন্তের পড়ন্ত বিকেল। হেমন্তে এ দেশে গাছের পাতা রং ধরে তারপর ঝরে পড়ে। এই সময়কে এখানে ফল বলে ‘ফল কালার’। প্রকৃতি দেখার জন্য এই সময় মানুষ শহরের বাইরে যায়। গাছে গাছে লাল, হলুদ, সবুজ, বাদামি, খয়েরি, কমলা—নানা রংয়ের খেলা। প্রকৃতি এখন অপরূপা। অল্প ঠান্ডা, তাই গায়ে পাতলা জ্যাকেট পরেছি। হাঁটছিলাম ফুটপাতের রাস্তা ধরে, চোখে পড়ল চারজন কিশোর গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তাদেরকে কিশোর না বলে প্রাক–কিশোরও বলা যায়। খুব কাছে না গেলে হালকা গোঁফ নজরে আসে না। এই জায়গায় হাঁটতে বের হলে এমন শিশু–কিশোরদের জটলা পাকিয়ে খেলা করতে চোখে পড়ে। আমি হাঁটছিলাম টিলি পার্ক হয়ে হিলক্রিস্ট স্কুলের হিল সাইড এলাকা ধরে।

জ্যামাইকাকে এখন বাঙালি পাড়া বললেই চলে। বাঙালি, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, চাইনিজ, গায়ানিজ, আফ্রিকান ছাড়াও কিছু সংখ্যক আমেরিকান সাদা মানুষের বসবাস এই এলাকায়।

আমি কিশোরদের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো, ছেলেগুলো বাঙালির হবে। গায়ের রং, চুলের কাট, পোশাক দেখেই আমার মনে হলো এরা আমাদের সন্তান। দেখলাম কী নিয়ে যেন তারা কাড়াকাড়ি করছে। তাদের জন্য ফুটপাতে যথেষ্ট জায়গা না পেয়ে আমি খানিকটা গাড়ি চলাচলের রাস্তায় নেমে তাদের অতিক্রম করছিলাম। তারাও আমাকে খেয়াল করল না। এই বয়সটাই এমন, কোনো কিছু খেয়াল না করা, কোনো কিছু নজরে না আসার।

কৈশোর কাল ভাবতেই সময়টা ভাবি, ঘরের আঙিনায় পাটি পেতে আকাশের চাঁদ–তারা দেখা বা খাঁ খাঁ রোদ্দুরে টো-টো করে ঘোরাফেরা। সময় কাটত ঘাস ফড়িং আর ঝিঁঝি পোকা ধরে ধরে। কখনো আকাশে ঘুড়ি উড়ানো, আবার কখনো বা মরা গাঙ পাড়ে আনমনে ঢেলা ছোড়া। এ দেশে এসব তারা কোথায় পাবে। ইট–কংক্রিটের সমাজে এখন শুধুই ইন্টারনেট আর বাহারি ট্যাব আর ফোন ল্যাপটপের মধ্যে এদের বেড়ে ওঠা। এরা কই পাবে বাঁশ বাগান আর কই পাবে মরা গাঙ।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, আমি আজকে শুধু ছেলেদের কিশোর কাল নিয়েই লিখব। আমার ভাইদের কিশোর বেলা কেটেছে পাখিদের ডিম, বাসা, ছানা এসব খুঁজে খুঁজে। সারা দিন বাগানে-বাগানে একটানা ছোটাছুটি করে মায়ের বকুনি–পিটুনি খেয়ে। যত রকম দস্যিপনা আছে সব এই কিশোর বয়সেই সম্ভব। হাঁটছি আর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, আমার সময়ে দেশের কিশোরদের জীবনযাপন কেমন ছিল সেই বিষয়টি।

কিশোর-প্রাক-কৈশোর বলতে মানুষের বিকাশের একটি পর্যায়কে বোঝায়, যা শৈশবের শেষ পর্যায়ে কৈশোরের আগের অবস্থাকে ধরা হয়। তবে অনেক সময় ১৩ বছর বয়সে পড়াকেও প্রাক-কৈশোরের সমাপ্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। বিভিন্ন অভিধানে প্রাক-কৈশোরকে ১০ থেকে ১৩ বছর বয়স দিয়ে বোঝানো হয়। তবে ৯-১৪ বছর বয়স দিয়েও এই পর্যায়টিকে বোঝানো হতে পারে।

নিজের ভাই বা চাচাতো, ফুপাতো ভাইয়েরা বাড়িতে এই কিশোর বয়সে কেমন ছিল, তা নিয়ে ভেবে হাঁটতে হাঁটতে আবার আমি এই ছেলেদের সামনে নিজের অজান্তেই চলে এসেছি। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ এই ছেলেগুলোকেই তো দেখেছি। ওরা এখনো ঠিক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কী নিয়ে যেন ঝগড়ার মতো করছে। একটু দাঁড়িয়ে ভাবলাম, বিষয়টি এড়িয়ে উল্টো দিকে হাঁটি। আমি তো হাঁটতে বের হয়েছি। হাঁটা ও ভাবনা দুটো সমানে চলবে। ছেলেদের জটলা পেরিয়ে উল্টো পথে হাঁটাও শুরু করলাম। ঠিক তখনই কানে আসল গোঙানির মতো শব্দ। তখনই আবরারের কথা মনে হলো। এই সময়ে সারা দেশ উত্তাল আবরারে হত্যাকাণ্ড নিয়ে। টুকটাক লেখালেখির কারণে সময় দেখা এখন অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মোবাইল ফোনে দেখলাম সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিট।

ছেলেদের অবস্থা দেখে আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। তাদের মধ্যে তিনজন একজনের নাক টিপে ধরে সিগারেট খাওয়াতে জোরাজুরি করছে। ছোট ছেলেটিকে তিনজন মাটিতে ফেলে তার হাত দুজনে চেপে ধরেছে, অন্যজন মুখে সিগারেট দিয়ে টান দিতে বলছে। মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটি ‘নো নো, স্টপ, আই ক্যান্ট টেইক ইট, আই ক্যান্ট’—এসব বলছে।

তাতে কী, বাকি তিনজনের কেউই তার কথা শুনছে না। এবার একজন মনে হয় বয়সে একটু বড় হবে। সে মাটিতে শোয়ানো ‘নো’ ‘নো’ করা ছেলেটিকে কয়েকটা চড় মারল। ছোট ছেলেটি বলছে, ‘সরি, সরি, নো মোর, লেট মি গো হোম, আই ওয়ান্ট টু গো হোম।’ তার মানে চড় খেয়ে সে কয়েকটি টান দিয়েছে। তারপরও তাকে বাকিরা ছাড়ছে না।

আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। একটু দূরে ছিলাম, তাই প্রথমেই চিৎকার করে থামাতে চেষ্টা করলাম। তারা আমাকে পাত্তাই দিল না। দৌড়ে কাছে গিয়ে মাটিতে শোয়ানো ছেলেটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। ও আমার হাত চেপে ধরল। তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কী হয়েছে। তারা ওকে ছেড়ে দিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম, কেন ওকে জোর করে সিগারেট খাওয়ানোর চেষ্টা করছ? তোমাদের বাসা কোথায়? এখানে তোমারা কার সঙ্গে আসছ? কোনো জবাব নেই। ছোট ছেলেটি আমার হাত আরও জোরে চেপে ধরেছে এবং কাঁপতে কাঁপতে বলছে, এই যে সামনেই আমাদের বাসা। বললাম আমাদের মানে? আর কে আছে তোমার সঙ্গে? আঙুল উঁচিয়ে দেখাল দুরে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের একজন তার কাজিন। কাজিন–ই তো তোমাকে চেপে ধরেছিল। জিজ্ঞেস করলাম, বাকিদের বাসা কোথায়? সে বলল, পরের ব্লকে।

এরই মধ্যে সিগারেট ও লাইটার আমি নিয়ে নিয়েছি। বাকি তিনজন আমার ওপর একটু বিরক্ত হয়েই এসব দিল। পিচ্চির মুখে মনে হল একটু হাসি দেখলাম। বললাম, চলো বাসায় যাই। পিচ্চি আমার হাত ছাড়ল না। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, তার নাম রিহান। রিহান সিক্স গ্রেডে পড়ে আর তার খালাতো ভাই শিহান সেভেন গ্রেডে। লক্ষ্য করলাম, শিহান একটু বড়, তাই কেমন ত্যাড়া হয়ে হাঁটছে। এরই মধ্যে জানলাম, তাদের এ দেশেই জন্ম। তারা সিলেটী বাংলায় কথা বলছে। আমি বাকিদেরও কাছে ডাকলাম। মনে হলো, এদের কাছে আরও সিগারেট আছে। বললাম, পুরো প্যাকেটটাই আমাকে দিতে হবে, তাহলে আমি তোমাদের বন্ধু হব, বাসায় কেউকে কিছু বলব না। একজন পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল। তাদের বলি, আমি প্রতিদিন এ পথে হাঁটি।

—কোথায় পেলে পুরো প্যাকেট?
—বলল বাবার। তাদের একজন এইটে, অন্যজন নাইনে পড়ে। তারা সিলেটী না, কিন্তু বাংলা বলছে সিলেটী টানে। বুঝলাম সঙ্গে থাকতে থাকতে শিখেছে।

রিহান আর শিহানকে পৌঁছে দিতে গিয়ে দেখলাম, তাদের একজনের বাবা বাসায় আছে। পরিবারের বাকি সদস্যরা কাজে। ভদ্রলোক ঘুমে ছিলেন। ছেলে দুটি দৌড়ে বাসার ভেতরে ঢুকে গেল। আমাকে তাদের সঙ্গে দেখে একটু অবাক চোখে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন। বললাম, আপনার স্ত্রীর ফোন নম্বরটা দিন, ওনার সঙ্গে একটা বিষয়ে কথা বলতে চাই। কেন বা কী জন্য কোনো প্রশ্ন না করে নম্বরটা একটা কাগজে লিখে তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। বুঝতে দেরি হলো না, বেচারা রাতে কাজ করে। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই।

এরপর অন্য দুজনকে বললাম, চলো তোমাদের বাসায় যাব। নাইনে পড়া ফাইয়াজ জানাল, তার বাসায় শুধু দাদু আছেন, বাবা–মা কাজে। তারা রাতে ফিরবেন। জানতে চাইলাম, কে কখন ফেরে? বলল, মা রাত নয়টা আর বাবা কোনো দিন রাত ১২টা। কোন কোন দিন সারা রাত কাজ করে সকালে ফেরেন। ফাইয়াজের সঙ্গে তার বাবার খুব কমই দেখা হয়। ফাইয়াজের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করলাম। সে বলল, তার বাবার কাছ থেকে সিগারেট না বলে নিয়েছে। সে জানে, সিগারেট খাওয়া শরীরের জন্য ভালো না। বাবাকে না বলে নেওয়া খারাপ হয়েছে এবং সে আর এ কাজ করবে না।

অন্যজন অভি, সেও বলল একই কথা। তারা আর সিগারেট হাতে নেবে না। তবে চোখের সামনে পড়লে হয়তো নেবে এবং খাবেও। দুজনেই বলল, বড় হলে তারা নিজেরাই কিনে খাবে। এত সোজা উত্তর দিল যে, আমি আঁতকে উঠলাম। তাদের দুজনের–ই ধারণা, বড় হতে হলে একটু–আধটু সিগারেট খেতে হয়। পৌঁছে দিলাম ফাইয়াজকে। ফাইয়াজ ও অভির কাছ থেকে জানতে চাইলাম, কেন রিহানকে সিগারেট খাওয়ানোর জন্য জোরাজুরি করছিলে? বলল, ধূমপান শেখানোর জন্য। বড় হতে হলে সিগারেট খাওয়া শেখাতে হবে। তাদেরকেও তাদের বড় ভাইয়েরা এমন করে শিখিয়েছে। আবারও আবরারের বড় ভাইদের কথা মাথায় চলে আসে। এখানেও বড় ভাইয়েরা আছেন নাকি?

জানলাম, তাদের বড় ভাইয়েরা ক্লাস ১১/১২–এ পড়ে। এখানের বড় ভাইদের মধ্যে শুধু বাঙালি না, সব দেশীয় আছে। নানান দেশীয় বড় ভাই আছে এদের। কেউ সিগারেট খাওয়ায়, এরপর গাঁজাও খেতে শেখায়। সাবলীল আলাপ হয় আমাদের মধ্যে। এ দেশে বাচ্চারা মিথ্যা বলতে পারে না। এমনকি তাদের কথা শুনে কেউ খুশি হলো না দুঃখ পেল, তাও তারা বুঝতে পারে না। এ দেশে জন্ম নেওয়া বাচ্চারা সব কথা হয়তো বাংলায় গুছিয়ে বলতে পারে না, তবে সোজাসুজি ইংরেজিতে উত্তর দেয়। ওদের কথায় কোনো মিথ্যা নেই। পানির মতো পরিষ্কার। তারা যে শিহানকে চেপে ধরে মাটিতে ফেলে নাকমুখ চেপে ধরেছে, এতে তাদের কোনো অপরাধ বোধ নেই। নেই কোনো দুঃখ বোধ।

অভিকে পৌঁছে দিতে গিয়ে তার মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। তাঁকে আমার ফোন নম্বর দিয়ে বলেছি, পরে কল দিয়েন কথা আছে। কেন আপা অভি কি কোনো সমস্যা করেছে? তার মানে ইনি ধরেই নিয়েছেন, তার ছেলে কিছু করতে পারে। হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। আমাদের সন্তানদের সম্পর্কে পরিবারের সদস্যরাই বেশি জানেন, বোঝেন। মাকে আশ্বস্ত করে বললাম, আমরা পরে কথা বলব। বাচ্চার সামনে না।

এই হলো চার আমেরিকান কিশোর। আমি এখানে নিজেও একজন মা হিসেবে তাদের নেতিবাচক দিকটি তুলে ধরেছি। এরা সবাই হয়তো পড়াশোনায় ভালো। কিন্তু এই বয়সী বাচ্চারা কার সঙ্গে মিশছে, সেদিকে বাবা–মায়ের যত্নবান হওয়া উচিত। এই কিশোরেরা পরিবারের বড়দের কপি করতে পছন্দ করে। বড়দের বদ অভ্যাসগুলো যেন শিশুদের মধ্যে সহজেই না পৌঁছাতে পারে, সেদিকে নজর দেওয়া। বড়দের সাবধান হতে হবে। তাদের যেন একা ছেড়ে না দিই। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলে তাদেরকে তথাকথিত বড় ভাইদের কবল থেকে বাঁচিয়ে রাখি। এই বড় ভাইয়েরা একদিন এই কোমলমতি শিশুদের মাদকে আসক্ত করে তুলবে। বলা যায় না, হয়তো এখান থেকেই শুরু হয় আরও ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। হয়তো বা তার চেয়ে ও বেশি কিছু।

আবার ছোটখাটো অপরাধ করতে দেখলেই যেন রেগে ফেটে না পড়ি। আদর দিয়ে চোখে চোখে রাখতে হবে। এই বয়সটা অভিমানী বয়স। এমনভাবে কথা বলতে হবে, যাতে সন্তান আপনাকে ভয় না পেয়ে ভরসা পায়। শিশুর সঙ্গে কথা বলার সময় কখনো চিৎকার করে কথা বলবেন না। তারা যদি নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, আপনি শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে তাকে বুঝিয়ে বলুন। আপনার ছেলে যদি কান্না করে, তাকে ধমক দেবেন না। আপনার আচরণ তার নরম মনে গেঁথে থাকে। মনে রাখবেন, শিশুদের সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে কথা বললে শিশুর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

আর পরিবারেরও কিছু ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে। বাবা-মায়েরা খেয়াল রাখুন, আপনার সন্তান কীভাবে বড় হচ্ছে, কার সঙ্গে চলাফেরা করছে। সে কোন আদর্শ নিয়ে বড় হচ্ছে সেটাও খেয়াল করুন। এলাকার বড় ভাইদের খপ্পরে পড়ার আগেই আপনি তার দিকে মনোযোগ দিন। নিজে যদি তার সামনে ভোগবাদী, নীতিহীন জীবনযাপনের উদাহরণ রাখেন আর মুখে উপদেশ দেন, তাহলে কোন লাভ হবে না। নিজের জীবনে যে মূল্যবোধ মেনে চলেন, সেটিই সন্তানকে শেখান। আপনার আচরণের ওপর নির্ভর করে আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ। কখনো কখনো দায়িত্বশীল মা-বাবাও এ ব্যাপারে ভুল করে থাকেন। তাঁদের ভুলের জন্য নষ্ট হতে পারে সন্তানের জীবন।