মাতৃত্ব কোনো দায়িত্ব নয়, অন্তরের আহ্বান

অল্পদিন আগেই এক চমকে ওঠার মতন খবর দেখলাম। চার বছরের এক শিশুর দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করছেন বাবা-মা দুজনই। আদালত হতবাক। হতবাক মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষেরাও। খবরটি যেখানে শেষ, সেখান থেকে যেসব মানবিক প্রশ্ন উত্থাপিত হলো—ছিঃ, ছিঃ কোন সমাজে এলাম? এ কী করে সম্ভব? তা বাপ যাও পারল, মা কী করে পারল? আরও এক কাঠি সরেস এক পোস্টও দেখলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে—অন্য পুরুষের প্রেমে অন্ধ হয়ে মাও অস্বীকার করল সন্তানকে ব্লা, ব্লা, ব্লা। কূলটা, ইতর, নিষ্ঠুর নারী ইত্যাদি।

দাঁড়ান, দাঁড়ান, দাঁড়ান; নারী অস্বীকার করায় আপনাদের গায়ে বিছুটি কেন পড়ল? জন্ম দেবে বলে তার দায়িত্ব নিতেই হবে? সন্তানের দায়িত্ব অস্বীকার করা বাপ কোনো দিন চোখে পড়েনি? মানে, ঘটনাটা বহুকাল ধরে ‘কমন’, ‘আনকমন’ কেবল পুরুষের সঙ্গে নারীরও অস্বীকার করায়। তাই তো! তা অস্বীকার করার কারণ কী কী থাকতে পারে? একজন নারী পুরোনো জঞ্জাল ঝেড়ে নতুন জীবন গড়তে আগ্রহী। সে পরপুরুষে আসক্ত, সে বহুগামী বিধায় সন্তানের লালন-পালনের চেয়ে নিজেকে নিয়ে থাকতে আগ্রহী—এগুলো হলো সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আসা কারণ। অন্য কারণের মধ্যে রয়েছে আর্থিক সামর্থ্যের অভাব, সন্তানের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতা ইত্যাদি ইত্যাদি। এখন প্রথম যে কারণগুলো লিখলাম, বাবাদের ক্ষেত্রে তার অজস্র উদাহরণ রয়েছে। তাই নয় কি? কই, তাদের তো সমাজ একঘরে করে না! আমার দেখা এমন ঘটনাও আছে যে, ছাড়াছাড়ির পর মেয়েকে না নিয়ে ছেলেকে নিয়ে গেছে বাবা।

এইটুকু পড়েই অনেকে হয়তো আমার গোষ্ঠী উদ্ধারে নেমে পড়বেন। বলবেন, প্রজননের মতো মাতৃত্বও এক প্রাকৃতিক ব্যাপার। মায়ের সঙ্গে থাকে নাড়িছেঁড়া সম্পর্ক। ফলে মায়ের সান্নিধ্য ছাড়া একজন সন্তান কখনো সুস্থভাবে বিকশিত হতে পারে না। আরও বলবেন, জগতের সব প্রাণীর মধ্যেও মায়ের সঙ্গেই ছানা-পোনাদের চলতে দেখা যায়। আমার জানামতে পেঙ্গুইন এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। পেঙ্গুইন ডিম পাড়ার পরই বাপের হাতে ছেড়ে সমুদ্রে চলে যায় খাবার জোগাড় করতে। আর বাবা পেঙ্গুইন মাসের পর মাস প্রায় না খেয়ে ওম দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। এর পরে আসে মা পেঙ্গুইন শক্তি সামর্থ্য নিয়ে বাচ্চা পালন করতে। যা হোক, আসি মানুষের সমাজে। মাতৃত্বের প্রকৃতিদত্ত ক্ষমতা নিয়ে আমার কোনো বিরোধিতা নেই। বিরোধ আছে কেবল মাতৃত্বের পুরুষতান্ত্রিক ব্যাখ্যা নিয়ে।

ভালোবাসা এক স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়। আপনা থেকেই তা উৎসারিত হয়। এখন কেউ যখন ভালোবাসার মাপকাঠি ও পরিসীমা ঠিক করে দেয়, তখন সেই স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়ের ইতি যে ঘটবে, তা বলাই বাহুল্য। মাতৃত্বের স্বাভাবিক রূপকে সবচেয়ে বেশি নষ্ট করে পরিবার ও সমাজ। কারণ, তারা ‘ভালো মা’ ও ‘মন্দ মা’-এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেয়। ‘ভালো মা’ মানে হলো বাচ্চার খাবার বানানো, খাওয়ানো, পড়ানো, পরিচ্ছন্নতা ও বিকাশের জন্য ছুটির দিনে নাচ-গানের স্কুলে নেওয়া, লাইব্রেরিতে নেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছু করা। আর ‘খারাপ মা’ মানে হলো বাচ্চা ফেলে বই পড়া, পিএইচ ডিগ্রি নেওয়া, বিদেশে পড়তে বা কাজ করতে যাওয়া, ছেলে বন্ধু বা অজস্র বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলা, সংগঠন করা ইত্যাদি। এর সঙ্গে যদি ক্লাব, মদ ও ক্যাসিনোর কথা আসে তবে নীরবতাই শ্রেয়। শুধু তাই নয়, ভালো মা ও খারাপ মা নির্ধারণে ব্যক্তির কাজ, পোশাক, যাতায়াত, বন্ধু-বান্ধব, বিনোদন, লালন-পালন থেকে শুরু করে সবকিছুই বিবেচনা করা হয়। এই ভালো মায়ের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেই সমাজ থামে না, সে নানা বিধি-বিধান তৈরি করে, যেখানে কেবল নারীর ভূমিকা থাকে বাস্তবায়ন পর্যায়ে; এসব বিধান প্রণয়নে নয়। হ্যাঁ, কোনো নারী যদি শক্তিশালী হয়, পরিবারের একক কর্তা বা পার্টনারের সঙ্গে অত্যন্ত ইতিবাচক সম্পর্ক থাকে, তবে তাঁর পক্ষে নিজ নিয়মে বাচ্চা লালন-পালন করা সম্ভব হয়। এসব ক্ষেত্রে তাঁদের সন্তানও সুসন্তানেই পরিণত হয়। কিন্তু অধিকাংশ মায়ের জীবনে যা যা ঘটে তা এমন নয়। এক বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পরই তাঁর কর্মজীবন বিদায় নেয়, শুরু হয় তাঁর ভয়ংকর বিশ্রামহীন ব্যক্তিগত জীবনের। আর সিঙ্গেল মায়ের ক্ষেত্রে যন্ত্রণার কথা আর নাই বা বলি।

প্রজাপতির মতো স্বাধীন জীবনের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়েই শুরু হয় মাতৃত্বের? কই অধিকাংশ বাবার তো সেই জীবন ছেড়ে আসতে হয় না? অফিসের কর্মব্যস্ততার পর তাদের ক্লাবে যাওয়া, সংগঠন করা, সৃজনশীল চর্চা তো স্থবির হয়ে পড়ে না! কারণ, সমাজ। নারীর জন্য মাতৃত্বকে সুমহান দেখিয়ে সমাজ মূলত তাকে ফেলতে চেয়েছে এক অন্ধকার জীবনাবর্তে। এই কাঠামো গড়ে উঠেছে হাজার বছর আগে। সময়ের সঙ্গে তা আরও শক্তপোক্ত হয়েছে। ফলে একজন বাবা যখন দায় এড়ায়, তখন পরিবারের ভুক্তভোগী ছাড়া অধিকাংশই তার প্রতি ঘৃণাভাব পর্যন্ত প্রকাশ করে না। কিন্তু কোনো মা যদি একবার অস্বীকার করে, তখন সমাজের মানুষই কেবল না, সন্তানকেও সমাজ শেখায় যে, সে কত বড় এক ইতর নারীর গর্ভে জন্মেছে। আবার যদি নারী ডিভোর্স নিয়ে এককভাবে সন্তান গড়তে থাকে, সেখানেও সমাজ সন্তানকে এমনভাবে বুলিং করে যে, সন্তানও অনেক সময় বিচ্ছেদের জন্য মাকেই দায়ী করে। ফলে সেই সন্তানও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

একটা কাঠামো কত ন্যক্কারজনকভাবে নারীর ওপর সমস্ত দায়ভার চাপিয়ে নারীকে ভয়ংকরভাবে রুদ্ধ করছে। ফলে একজন নারী আর্থিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংকটে পড়ছে। স্বাভাবিক এক মানবিক জীবন তার থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, স্বতঃস্ফূর্ত মাতৃত্বের আনন্দকে করে তুলছে বিভীষিকাময়। এখন নারীরা যে আস্তে আস্তে নিজের শরীর ও মনকে প্রাধান্য দিতে শিখছে, দামি ভাবতে শিখছে নিজের জীবন, ইচ্ছেকে মূল্য দিতে শিখছে, এতে করেই শুরু হতে যাচ্ছে নতুন এই সমস্যা। ভবিষ্যতে এ প্রবণতা আরও বাড়বে, সংকটে পড়বে গোটা জাতি। কিন্তু এই অস্থিরতা তৈরি ছাড়া বোধের জন্মও তো হচ্ছে না। সমাজকে এভাবে আঘাত করা ছাড়া নারী তো তার কথাটি শোনাতে পারছে না।

শেষ কথা, আমার তিন ছেলে তখন বেশ ছোট। শ্রান্তি ক্লান্তিতে পর্যুদস্ত আমি। একদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি অবসন্ন হয়ে। হঠাৎ চোখ পড়ল, বারান্দার গ্রিলে মেলে রাখা তিনটা ছোট ছোট ফতুয়া। এক অদ্ভুত আনন্দ ও সুখে ভরে গেল আমার মন! এই রৌদ্রোজ্জ্বল উদ্ভাসিত মাতৃত্বকে ঘেরাটোপে ফেলে নষ্ট করবেন না। নিয়ম-নীতির বালাই দিয়ে মা ও সন্তানের মধ্যে অফিশিয়াল সম্পর্ক গড়ে দেবেন না। আর সন্তান পৃথিবীতে আসে দুজনের অংশগ্রহণে। তাকে চিন্তা করেই পৃথিবীতে আনুন—যখন আপনি মা হতে চান, যখন আপনি বাবা হতে চান। পারস্পরিক মমতা নিয়ে গড়ে উঠুক নব প্রজন্ম।