তবু বেঁচে থাকা অপরূপ

সাহিরা ওয়ামায়া ২১ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষা, ভালো চাকরি এবং একটি সুন্দর জীবনের আশায় সুদূর নাইজেরিয়া থেকে আমেরিকায় এসেছিল। প্রতিদিন সকালে অফিসেই দেখা হতো। দেখলেই হেসে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতাম দুজন দুজনকে। একদিন বলল, মিস ভায়লা আমাকে তোমাদের কোন রেস্টুরেন্টে খাওয়াবে? বললাম, তাহলে আজকে লাঞ্চ একসঙ্গে করি? দুপুরে আমি, সাহিরা এবং মারিও লাঞ্চে যাই অ্যাস্টোরিয়ার একটি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে। মেয়েটির অনুরোধে সব ঝাল খাবারের অর্ডার করি। এরপর চলে গল্প। গল্পের একফাঁকে জানায়, খুব ছোট বয়স থেকে সে ভীষণ পরিপাটি থাকে। বাবা বর্ডারে ট্রাক চালাতেন, মা বিউটিশিয়ান। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার ছিল তাদের। কিন্তু মেয়েটির চাহিদা ছিল গগনচুম্বী। নামী ব্রান্ডের কাপড়, জুতা, পার্স—বাবা মায়ের কাছে এসবই ছিল তার ডিমান্ড। তারা কখনো পূরণ করতে পারেন, কখনো পারেন না।

হঠাৎ সাহিরার বাবার ক্যানসার ধরা পড়ে। তাঁর মা ভীষণ ভেঙে পড়েন। সাহিরা বলেন, ক্যানসার আমাদের মতো পরিবারের জন্য একটা বিরাট ধাক্কা, তেমন পয়সা নাই। কী করি, সেই দুশ্চিন্তা। আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম। এসব কথা বলতে গিয়ে গলা বুঁজে গিয়েছিল মেয়েটির।

তিনি আরও বলেন, বাবার ক্যানসার হওয়ার পর থেকে আমাদের পরিবারের বাকি সবকিছুই যেন হঠাৎ থমকে যায়। চিকিৎসা করাতে ‘মারজুরি বাশ ক্যানসার সেন্টারে’ বাবাকে নিয়ে যাই; ঘরে তালা। আমার মায়ের সংসার বলতে আর কিছুই থাকে না আর। চিকিৎসা চলাকালে বাবা মারা যান। তার কিছুদিন পর মাও চলে যান। এতটুকু বলার পর রেস্টুরেন্টের ওয়েটার খাবার নিয়ে আসলে সাহিরা গালে হাত দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি লুকান।

খাবার সামনে রেখে কথা বলছি, কথা শুনছি, শুধুই কথা হচ্ছে। তবে মাংসে গড়া মানুষ শুধু কথায় তৃপ্ত নয়। খাবারের মাঝে সাহিরা আবার বলতে থাকে। কিছু শব্দ উড়ে যায়, কিছু শব্দ ডানা মুড়ে থাকে, তরল পারার মতো কিছু শব্দ গলে পড়ে যায়। আমার বাবা–মা আমার জন্য কিছু ব্যাংক ব্যালেন্স রেখে যান। আমি সেগুলো খরচ না করে আমেরিকায় আসার চেষ্টা করি। সব উপায় ব্যর্থ হয়ে শেষে লেখাপড়া করে একটি আমেরিকান এনজিওতে কাজ নিয়ে এ দেশে আসি। কিন্তু তার আগে ভারত–বাংলাদেশেও ঘুরে আসি। সেখান থেকে বাংলাদেশি খাবারের সঙ্গে পরিচয় আমার।

আমেরিকায় এসে এবার আমি কসমেটিকসের ক্লাস করে সার্টিফিকেট নিয়ে ‘এস্টে লর্ডার’ কোম্পানিতে ট্রেড মার্কেটিং অ্যান্ড কমার্শিয়াল ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিই। এরপর একের পর এক সাফল্যের পর ২৭ বছর বয়সে আজ আমি গ্লোবাল ম্যানেজার অফ এস্টে লর্ডার। আমার জীবনটা বিলাসবহুল। অনেক কষ্ট ভোগ করে আজকের এই সাফল্য আমার।

সাহিরা, গত বছর নিজ দেশ নাইজেরিয়ায় গিয়ে বিয়ে করেন। ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সাহিরা সেদিন দেখা হলে জড়িয়ে ধরে বলেন, ভায়লা অনেক চেষ্টার পর আমি এবার মেয়ের মা হব। কেমন এক অচেনা শিহরণ কাজ করছে। বেবি শাওয়ারে অবশ্যই আসবে। এরপর যে যার মতো যার যার কাজে চলে যাই।

কয়েক দিন আগে অফিস থেকে বের হওয়ার সময় দেখি অ্যাম্বুলেন্স। কেমন এক উদ্ভট অনুভূতি কাজ করে। সামনে এগোতেই মাইকেল বলেন, ভায়লা তোমার বন্ধু অ্যাম্বুলেন্সে। প্যানিক অ্যাটাক, ফলস পেইন। ওকে বিদায় দিয়ে ঘরে ফিরি। এরপর ভুলে যাই তাঁর কথা। কাজ করি, ঘরে ফিরি। আজ সকালে এলিভেটরে দেখা হয় তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে। সাহিরার কথা জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, তুমি জানো না সি ইজ নো মোর! সি হ্যাড এ মেসিভ হার্ট অ্যাটাক!!

জীবনটা সত্যিই অদ্ভুত। একদিন চলে যাব, এ তো আমি ভাবতেই পারি না; ভীষণ ভয়ের মানে-ভালোবাসা! পৃথিবীর কি মায়া; মায়ার পাহারা আমি ছাড়তে চাই না। তবুও সংসারে মায়াজাল সৃষ্টি করে কিছুদিন বেঁচে থাকা অথবা না বলে হঠাৎ চলে যাওয়া।

কী অদ্ভুত একটা ব্যাপার! কেউ যখন ডাক দেয়, আসছি বলতেও ভয় লাগে; ভাবি যেতে পারব তো? সেটুকু সময় হাতে আছে তো?

তবুও এই স্বল্প সময়ের মায়াজাল ভেঙে যারা না–ফেরার দেশে চলে যায়, তারা ভালো থাকুক। যারা চলে যাওয়ারও অনেক আগেই চলে যায়, তারা ভালো থাকুক। চলে গিয়ে যাদের বুকে শূন্যস্থান তৈরি করে দিয়ে যায় তারাও ভালো থাকুক।

ভালো বেঁচে থাকুক সব মায়া, স্নেহ, ভালোবাসা—সবকিছু।