আমেরিকার ভূমিকার নিন্দা, যশোর শত্রুমুক্ত

(পর্ব ৩০)

যুদ্ধ শুরুর দুই দিনের মাথায় আমেরিকা পাকিস্তানের সমর্থনে ভারতকে দোষারোপ করে একটি বিবৃতি দেয়, যা আমেরিকাতেই তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। দুই দফায় পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রথিতযশা সাংবাদিক অ্যান্থনি লিউস আমেরিকার ভূমিকার সমালোচনা করে লন্ডন থেকে একটি প্রতিবেদন লেখেন, যা ৬ ডিসেম্বর সংখ্যায় ছাপা হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘হাত কচলানো’ [wringing of Hands]

প্রতিবেদনটি সংক্ষেপে এমন—
ধরে নেওয়া যাক এটা ১৯৩০ সাল। ব্রিটেন হিটলারের অসভ্যতার জবাবে তুষ্টির পরিবর্তে সামরিক শক্তি ব্যবহারের কথা বলল, আমেরিকায় নিক্সন প্রশাসন তখন ক্ষমতায়। তারা কোন একজন কর্মকর্তাকে পাঠালেন এই কথা বলতে যে, ব্রিটেন কাজটি ঠিক করেনি।

সুতরাং এই সপ্তাহান্তে যখন আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন আচরণের জন্য অভিযুক্ত করে বিবৃতি দেন, তখন তিনি তাঁকে চার্লস ডিকেন্সের ডেভিড কপারফিল্ড উপন্যাসের মোসাহেবি চরিত্র ‘উইরিয়া হিপ’–এর সঙ্গে তুলনা করেন।

এই দ্বন্দ্বের শুরু যখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বাঙালিদের তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং গায়ের জোরে নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করেন। গত মার্চে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীকে উড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আনা হয়, তারা অংশ নেয় রাজনীতিকসহ সাধারণ নাগরিকদের হত্যা, গ্রামের পর গ্রাম আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়ার মিশনে। ইয়াহিয়ার কার্যক্রম হিটলারের প্রথম দিকের কাজের সঙ্গে তুলনীয়। তাদের অত্যাচারের ফলে প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এই নৃশংসতার বলি বাঙালি অথবা হিন্দু—তারা চেক, পোলিশ বা ইহুদি নয়। হয়তো তাই এই অত্যাচার পশ্চিমের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। এই তাণ্ডবের কাহিনি বিশ্বের কাছে গোপন নেই। নৃশংসতার চোখে দেখা কাহিনিও সম্প্রতি প্রচার হয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তাঁর বহির্বিশ্ব কর্মকর্তা দল কিছু না দেখার ভান করে চোখ বন্ধ করে ছিলেন।

এই সময়ে মাসের পর মাস বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সমস্যা নিয়ে প্রেসিডেন্ট একটি শব্দও বলেননি। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কূটনীতির কোন লক্ষণ দেখা যায়নি যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওপর শরণার্থী সমস্যা বা পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের রাজনৈতিক সমস্যার জন্য তার ওপর কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। পাকিস্তানের যুক্তি ছিল, এটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, যেমনটি জার্মান ইহুদিদের বিষয়ে নাৎসিরা বলেছিল। ইন্দিরা গান্ধী রাজনৈতিক কারণে কাজ করেছেন। ভারত বাংলা দেশের গেরিলাদের সাহায্য করছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছে সবই সত্যই। কিন্তু ভারত যে এসব ক্ষেত্রে অনেক সহনশীলতা দেখিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।

৮ ডিসেম্বরের মধ্যেই যশোর শহর শত্রুমুক্ত হয়। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস–এর বিশেষ সংবাদদাতা সিডনি সেনবার্গ যশোরে প্রবেশ করেন। তাঁর প্রতিবেদনে যুদ্ধে জয়ে উচ্ছ্বসিত মানুষের আবেগ স্থান পায়। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল “যশোরের ‘মুক্তিতে’ বাঙালির নৃত্য ও চিৎকার” [Bengalis dance and shout at ‘Liberation’ of Jessore]

যশোর মুক্ত হওয়ায় বাঙালিরা বাসের ওপর উঠে নৃত্য করে, স্বাধীনতার স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে আবেগে এক অপরকে জড়িয়ে ধরে। আজ বাঙালিদের জন্য ‘যশোরে মুক্ত দিবস’ গতকাল পর্যন্ত আট মাস যাবৎ এই শহরটি পাকিস্তান আর্মির দখলে ছিল। মুক্তিদাতারা ছিল ভারতীয় বাহিনী। তারাও বাঙালিদের মতো উচ্ছ্বসিত ছিল কিন্তু থেমে আনন্দ করার মত সময় তাদের ছিল না। তারা এগিয়ে চলছিল দক্ষিণ পূর্বে আরেক শহর খুলনার দিকে। তবুও তারা তাদের সামরিক যান আর ট্যাংক থেকে বেরিয়ে হাত নাড়ছিল, মানুষের সঙ্গে হেসে ছবি তুলছিল।

যশোর ও খুলনার মাঝে একটি প্রধান সেতু, সীমান্ত থেকে প্রায় ২৩ মাইল ভেতরে পাকিস্তানি বাহিনী খুলনার দিকে চলে যাওয়ার সময় দুই রাত আগে সেটি ধ্বংস করে। সেতুটির ছয়টি স্পেনের মধ্যে পাঁচটি স্টিলের স্প্যান নদীতে পড়ে যায়। সেখানে একটি পন্টুন স্থাপনের জন্য তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাঠের গুঁড়ি বসাতে ভারতীয় সেনাদের সাহায্য করে। প্রকৌশলীরা বাতাস দিয়ে বিশালাকার পন্টুনটি ফোলালে জনতা সেটিকে ব্রিজের জায়গায় আনতে সাহায্য করেছিল। সবাইকে মনে হচ্ছে খুব খুশি।

একজন পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা
এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এক পুরোনো বন্ধুর দেখা হলো। ব্রিজের দাঁড়িয়ে থাকা স্প্যানের পাশ থেকে একজন ইংরেজিতে বলল, ‘ইউ রিমেমবার মি?’ আমি চিনলাম। তিনি ২৫ বছর বয়সী বাঙালি লেফটেন্যান্ট আখতার উজ্জামান। মুক্তিবাহিনীর একজন কমান্ডার। দক্ষিণ–পশ্চিমে যশোরে গেরিলাদের দখল করা একটি ছিটমহলে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল (পূর্বে সিডনি সেনবার্গের একটি প্রতিবেদনে লেফটেন্যান্ট আখতারের কথা উল্লেখ আছে)। তখন তিনি বলেছিলেন, বিজয়ী হতে মুক্তিবাহিনীর কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। আজ তিনি বললেন, ‘সেটি ছিল যদি আমরা একা যুদ্ধ করতাম, কিন্তু এখন আমাদের বড় সাহায্য আছে।’

যখন বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে জিপ ঝিকরগাছা যশোর রোডে আসল, তখন রাস্তার পাশ থেকে মানুষ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে লাগল আর দৌড়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে হাত মেলাতে লাগল। যশোরের অবস্থা ছিল আরও উচ্ছ্বসিত। ভারতীয় সাঁজোয়া গাড়ি যুদ্ধ ক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেলে পেছনে কানায় কানায় মানুষে পরিপূর্ণ একটি বাস স্বাধীন বাংলা আর শেখ মুজিবের নামে স্লোগান দিতে দিতে আসল। কিছু বাঙালি ছেলে লাল, সবুজ, সোনালি পতাকা হাতে রাস্তায় নাচতে লাগল। যশোরে ৩০ হাজার মানুষের বাস। অনেকেই তখনো শহরের বাইরে।
মিশনারি ও অন্যান্য সূত্র থেকে জানা গেল, এখানে কমপক্ষে ৫ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। ভারতীয় নবম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের প্রধান মেজর জেনারেল ডালবার সিং বললেন, পাকিস্তানিরা প্রতিরোধ গড়েছিল। কিন্তু তার সৈন্যদের আক্রমণে দ্রুতই তারা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। তিনি ক্যান্টনমেন্টে সাংবাদিকদের বর্ণনা দিচ্ছিলেন। গতকাল ২টার মধ্যে তারা পুরো এলাকার দখল নিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা খুলনার দিকে ১৫ মাইল পেছনে অবস্থান নিয়েছে। ৩০০ সৈন্যের একটি দল মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যাদের তার বাহিনী যশোরের ৪ মাইল দূরে আটক করে। ওই এলাকায় ঘুরে দেখা গেল, ১৪টি মাঝারি ট্যাংকের কলাম, ৪০টি সাঁজোয়া গাড়ি (৪০০–৫০০ সৈন্যসহ) খুলনার দিকে সরে যাওয়া পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণের আদেশের অপেক্ষায় আছে। বেশ কিছু অ্যাম্বুলেন্সও সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। (চলবে)

লেখক: কুইন্স পাবলিক লাইব্রেরি হলিস শাখার ম্যানেজার।
ইমেইল: [email protected]