কিচলুকে ভোলার নয়

আমাদের বয়সী যাঁদের ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের আগের জন্ম, তাদের স্কুল, কলেজের পাঠ্যপুস্তকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যক্ষেত্রে মুসলমানদের অনেক ভূমিকা ও উপস্থিতি পরিলক্ষিত হতো। ধীরে ধীরে সিলেবাস বদল হতে হতে, বিশেষত ইতিহাস বারবার পুনর্লিখিত হওয়ার ফলে, ভারতের নানা ক্ষেত্রে মুসলমানদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদানের কথা একরকম ধামাচাপা পড়ে গেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে তা অজানা আর চোখে না পড়ার ফলে বয়স্কদের কাছেও সেসব স্মৃতিও আর বেঁচে নেই। ভারতের স্বাধীনতাপূর্ব, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেই মুসলমানদেরও যে অনেক মূল্যবান অবদান আছে, সে সম্পর্কে পাঠকদের জানাতে এই ধারাবাহিক লেখা

সাইফুদ্দিন কিচলু (জন্ম ১৫ জানুয়ারি, ১৮৮৮; মৃত্যু ৯ অক্টোবর, ১৯৬৩) ছিলেন একাধারে একজন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রণী, ব্যারিস্টার, রাজনীতিবিদ ও জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতা। ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ নামটির সঙ্গে তিনি ভারতীয়দের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম স্তালিন শান্তি পুরস্কার পান।

বাল্য ও শিক্ষাজীবন: জওহরলাল নেহরুর পরিবারের মতো সাইফুদ্দিন কিচলুর পূর্বপুরুষেরাও আদতে কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ ছিলেন। বাড়ামুল্লা অধিবাসী তাঁর পূর্বপুরুষ প্রকাশরাম কিচলু ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর দাদা (ঠাকুরদা) আহমেদ জো ১৮৭১ সালে কাশ্মীরে দুর্ভিক্ষের পর সেখান থেকে পাঞ্জাবের অমৃতসরের ফরিদকোট এলাকায় চলে আসেন। সেখানেই বাবা আজীজুদ্দিন কিচলু ও মা দান বিবির ঘরে সাইফুদ্দিন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার পাশমিনা ও জাফরানের (স্যাফ্রন) ব্যবসা ছিল। তিনি ‘শিশমহল’ নামে একটি মিলনায়তন নির্মাণ করেন, যেখানে সংগীতানুষ্ঠান, সাহিত্যসভা, খেলাধুলা ইত্যাদি অনুষ্ঠান হতো। এ রকম পরিবেশ পরবর্তীকালে সাইফুদ্দিনকে একজন সংকীর্ণতামুক্ত উদার মানুষ হতে সাহায্য করেছিল। কিচলু অমৃতসরের ইসলামিয়া হাইস্কুল শেষ করার পর লন্ডনের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন এবং এরপর বার-অ্যাট-ল’ করেন। তারপর তিনি জার্মানিতে গিয়ে পিএইচডি করেন।

পেশাগত জীবন: পড়াশোনা শেষ করার পর ভারতে ফিরে অমৃতসর শহরে তিনি ওকালতি শুরু করেন। এ সময় তিনি গান্ধীর সংস্পর্শে আসেন। ১৯১৯ সালে তিনি অমৃতসর শহরের কমিশনার নির্বাচিত হন। অচিরেই তিনি সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন এবং নিজের ওকালতি পেশা ছেড়ে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও একই সঙ্গে সর্বভারতীয় খিলাফত কমিটিতে যোগ দেন।

রাজনৈতিক জীবন ও জালিয়ানওয়ালাবাগ—ড. কিচলু ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রথম স্বাদ পান যখন জনসাধারণ ‘রাইলাট অ্যাক্ট’-এর ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়ে প্রতিবাদ গড়ে তোলে। এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে মদদ দেওয়ার জন্য গান্ধী ও ড. সত্যপালের সঙ্গে তাঁকেও জেলে পাঠানো হয়। এই তিনজনকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে জালিয়ানওয়ালাবাগে একটি জনসমাবেশ হয়। সেই সময় জেনারেল রেজিনান্ড ডায়ার ও তার সৈন্যসামন্ত নিরস্ত্র এই সমবেত জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে শত শত মানুষ হতাহত হয়। অতর্কিতে জনসাধারণদের ওপর হামলা করে এই জঘন্য হত্যা, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের জঘন্য হত্যার পরে সবচেয়ে নিচ ও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড। এই গণ্ডগোলের ফলশ্রুতিতে সারা পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ে।

মূল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া: সাইফুদ্দিন কিচলু পাঞ্জাবে কংগ্রেস পার্টির প্রধান হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি হিসেব দায়িত্ব পান। সেই ১৯২৪ সালের পরিপ্রেক্ষিতে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ ছিল। শুধু তাই নয়, ১৯২৯-৩০ সালে লাহোরে কংগ্রেসের যে অধিবেশন বসে, তিনি সেই আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতির জীবনের সেই গুরুত্বপূর্ণ সেশনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের বীজ বপন করে।

কিচলু ‘নওজোয়ান ভারত সভা’ বা ‘ইন্ডিয়ান ইয়ুথ কংগ্রেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণ-তরুণী জাতীয়তাবাদে আকৃষ্ট হয়ে এতে যোগ দেন। তিনি জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া কমিটিরও একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। ১৯২০ সালের ২৯ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত এই কমিটির এক সভায় ‘জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কিচলু ‘তানজিম’ নামে একটু উর্দু পত্রিকা চালু করেন। তরুণদের জাতীয় কাজকর্মে ও হিন্দু-মুসলিমকে একতার বন্ধনে আকৃষ্ট করার জন্য ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ‘স্বরাজ আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এসব কার্মকাণ্ডের জন্য ১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে তাঁকে বারবার কারাগারে যেতে হয়েছে। এভাবে কিচলু তাঁর জীবনে মোট ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন।

স্বাধীনতার পর: চল্লিশের দশকের শেষের দিকে কিচলু পাঞ্জাব কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি ও ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের ঘোরবিরোধী ছিলেন। তিনি দেশে বিভিন্ন জনসভায় তার এই বিরোধিতার কথা ঘোষণা করেন। অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি তাদের সেশনে যখন শেষ পর্যন্ত দেশ বিভাগের পক্ষে রায় দেয়, তখন তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিচলু এটিকে ‘সাম্প্রদায়িকতার কাছে জাতীয়তার আত্মসমর্পণ’ অর্থাৎ ‘সারেন্ডার অফ ন্যাশনালিজম ফর কমিউনালিজম’ বলে আখ্যায়িত করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। দেশ বিভাগের কয়েক বছর পরে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি সর্ব ভারতীয় শান্তি পরিষদের (অল ইন্ডিয়া পিস কাউন্সিল) প্রতিষ্ঠাত সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে অল ইন্ডিয়া পিস কাউন্সিলের চতুর্থ অধিবেশনেরও তিনি সভাপতিত্ব করেন। এ ছাড়া তিনি বিশ্বশান্তি পরিষদেরও (ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল) সহসভাপতি ছিলেন।

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় কিচলুর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলে তিনি পাঞ্জাব ছেড়ে দিল্লিতে চলে আসেন। বাকি জীবনটা তিনি রাজনৈতিক ও ডিপ্লোম্যাটিক লেভেলে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন। এ জন্য তাঁকে স্তালিন শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়, পরে যার নাম লেনিন শান্তি পুরস্কার নামে অভিহিত করা হয়েছে। এর আগে ১৯৫১ সালে সরকারের এক নীতিমালা অনুসারে জওহরলাল নেহরু, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ও সাইফুদ্দিন কিচলুকে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ ন্যাশনাল মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর ট্রাস্টি বানানো হয়।

পারিবারিক জীবন: সাইফুদ্দিন কিচলু সাদাত বানু মন্টোকে বিয়ে করেন। সাদাত বানুও স্বাধীনতা আন্দোলন ও অল ইন্ডিয়া উইমেন্স ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাইফুদ্দিন কিচলু ১৯৬৩ সালের ৯ অক্টোবরে মারা গেলে তাঁকে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। তিনি এক পুত্রসন্তান ও পাঁচ কন্যাসন্তান রেখে যান।

পাঞ্জাবের লুধিয়ানায় কিচুলর নামে ‘কিচলুনগর’ কলোনি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতীয় ডাক বিভাগ ১৯৮৯ সালে তাঁর নামাঙ্কিত একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেছিল। ২০০৯ সালে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া তৃতীয় বিশ্ব সম্বন্ধে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে তাঁর সম্মানে ‘সালাউদ্দিন কিচলু চেয়ার’ প্রবর্তন করেছে।